Tuesday, May 26, 2020

ছোটোগল্প - মঙ্গলপ্রসাদ মাইতি


অনুভব
মঙ্গলপ্রসাদ মাইতি

আজ যখন মণিকার ঘুম ভাঙল তখন ঘড়িতে ঠিক ছটা বেজে দশবিছানা ছেড়ে যাবার আগে কি মনে করে সে পাশেই রাখা রেডিওর নবটায় হাত রাখলআর তখনই একটা খুশির আনন্দ ভাসিয়ে নিয়ে গেল ওকেএকটা ভালোলাগার জগত্‍ হঠাত্‍-ই ধরা দিল ওর কাছেওর সারা দেহ-মনে খেলতে লাগল অনাস্বাদিতপূর্ব এক পুলক শিহরণ! মনের মধ্যে অনুভব করল যেন তার কতকালের পরিচিত একটি গানের সুমধুর সুর-তরঙ্গ তাকে রাঙিয়ে দিয়ে, তাদের শোবার ঘরটাকে ভরে দিয়ে খোলা জানলার ফাঁক দিয়ে বাইরের সকালবেলাকার নির্মল-স্বচ্ছ বাতাসের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লযেন খাঁচায় বন্দি পাখি হঠাত্‍ ছাড়া পেয়ে একটা সোনার পালক ফেলে রেখে উড়ে গেল দূর সীমানায়, নীল আকাশের কোলে। যেন একটা সুখের খবর শুভ বার্তা পৌঁছে দিয়ে গেল সকলের ঘরে ঘরে। রেডিওতে তখন প্রভাতী অনুষ্ঠান সঙ্গীতাঞ্জলির আসর থেকে পরিবেশিত হচ্ছে দেবব্রত বিশ্বাসের রবীন্দ্রসঙ্গীত – তুমি ডাক দিয়েছ কোন সকালে কেউ তা জানে না আর তা শুনেই মণিকার আজ এই ভাবান্তর – এই খুশির সাগরে মধুর সন্তরণ।
   অন্যদিন ঘুম ভাঙলেই কাজের মধ্যে চলে যেত মণিকা। ঘর-গেরস্থালির কাজ। প্রথমেই রান্নাঘর। সেখান থেকে এঁটো বাসনপত্র নিয়ে সোজা কলতলা। তারপর সেখান থেকে বালতি ভরে জল এনে তাতে গোবর গুলে ছড়া-ঝাঁট দেওয়ার কাজে লেগে পড়ত। কিন্তু কেন জানি না আজ মণিকা উঠতে গিয়েও উঠল না। বরং রেডিওটাকে কোলের কাছে টেনে এনে বিছানাতে বসে রইল। রেডিওর গানটা ওকে উদাস করে দিয়েছে, ও বিভোর। ভুলিয়ে দিয়েছে প্রাত্যহিক কাজের কথা। বিমুগ্ধ নেত্রে দেওয়ালে টাঙানো ক্যালেণ্ডারটার দিকে তাকাল। এতক্ষণ তার খেয়াল হল – ও, আজ তো পঁচিশে বৈশাখ, কবিগুরু রবিঠাকুরের জন্মদিন! এতক্ষণে বুঝতে পারল, কেন আজ সকালে রেডিওতে এত সুন্দর সুন্দর গান হচ্ছে। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি যে পঁচিশে বৈশাখ চলে আসবে ভাবতেই পারেনি মণিকা। এই তো সেদিন পয়লা বৈশাখ গেল। এরই মাঝে তেইশ-তেইশটা দিন কবে এল আবার কবেই বা গেল তা সে জানে না। কাজের চাপে হারিয়ে যাওয়া সময়টা ফিরে পাবার চেষ্টা করে – কিন্তু কী করে তা সম্ভব? বুকের মধ্যে একটা বেদনা অনুভূত হয় তার। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই সেটা উবে যায়। রেডিওতে শিল্পীর সুললিত কণ্ঠের সুর সবকিছু তিক্ত ব্যথার ভাবনা ভুলিয়ে দেয় তাকে। আবার ঝলমলিয়ে উঠে মনটা। বাঁধভাঙা এক খুশির জোয়ার আপ্লুত করে তোলে তাকে। শিল্পীর সাথে নিজের অজান্তেই গুনগুনিয়ে ওঠে সেও।
   অনেকদিন পর ওর আজ এমন হচ্ছে। নাচতে ইছে করছে, গাইতে ইচ্ছে করছে। হারিয়ে যাওয়া সুরটা যেন সে বহুদিন পরে হঠাত্‍ আজ খুঁজে পেয়েছে। মনটা অতীতে ফিরে যায় তার। স্কুল কলেজে পড়ার সময় তার এমনটা হত। ও! ফেলে আসা দিনগুলি তার কি সুন্দর ছিল! কত লাবণ্য – কত স্বপ্ন ছিল তাতে! মণিকার মনে পড়ে- বৈশাখ মাস পড়লেই, ও: কি অদ্ভুত এক মায়াময় আবেশ ঘিরে ধরত তাকে! প্রহরগুলোকে তখন একান্ত নিজের করে নিয়ে এই পঁচিশ তারিখটার জন্য দিন গুনত। আবৃত্তি-গান-নাটকে অংশগ্রহণ করতে হবে; তারজন্য কত প্রস্তুতি, কত জল্পনা-কল্পনা, সঞ্চয়িতা নিয়ে সেকি ছোটাছুটি মন মাতাল করা কি মাধুর্য-মাদকতা ছিল সে সব সুখের দিনগুলিতে। তার জীবনবীণাতে সত্যিকারের একটা সুর ছিল। এক কথায় মণিকার জীবনটা ছিল হাসি-আনন্দ-গানে পরিপূর্ণ, অপূর্ব এক আলোর সুরভিতে দোলায়িত।
   এ হেন মণিকা যখন স্বামীর হাত ধরে শ্বশুরবাড়িতে এল তখনই ওর চারপাশটা কেমন যেন ফাঁকা-শূন্য বলে মনে হল। বুকের মধ্যে সযত্নে লালিত আশার পৃথিবীটা তার মনে হল কেমন ধূসর- ধোঁয়াটে-বিবর্ণ। নতুন সংসারে পা দিয়েই মণিকা বুঝল এখানে কোনো দাম নেই। বাড়ির সবাই আভাসে-ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিতে চায় সখ-আহ্লাদ মেটাবার জায়গা বাপের বাড়িতে, শ্বশুরবাড়িতে নয়। অথচ বিয়ের আগে মণিকা ভেবেছিল শিক্ষক স্বামীর সঙ্গে যখন তার বিয়ে হচ্ছে
তখন নিশ্চয়ই সে সুখকর আলোর পৃথিবী গড়ে নিতে পারবে। মনের মাধুরী মিশিয়ে আরো উন্নততর সম্ভাবনাময় উজ্জ্বল একটা জগতের বাসিন্দা সে হতে পারবে। কিন্তু তার সে আশায় ছাই পড়ল।
   মণিকা উপলব্ধি করল এ সংসারে হৃদয় বলতে কিছু নেই। কেমন যেন ম্যাজম্যাজে, প্রাণহীন। সারাটাদিন ঘর-গেরস্থালির কাজ নিয়ে পড়ে থাকো তাহলেই বেশ সবাই আনন্দিত, খুশিএর বাইরে কিছু করতে গেলে সহানুভূতি তুমি পাবে নাসবচেয়ে বেশি যেটার অভাব সে অনুভব করল সেটা হল এ পরিবারে সংস্কৃতির কোনোরকম চর্চা নেইমানুষগুলোর মধ্যে নেই কোনো সংস্কৃতিবোধএমনকি তার শিক্ষক স্বামীও এ সবের ধার ধারে নাসবাই ভোগসর্বস্ব জীবন নিয়েই বাঁচতে চায় এখানে। প্রথম কয়েকটা মাস খুব কষ্ট হয়েছিল মণিকার। কষ্টেরও মনে হয় একটা স্বাভাবিকতা সাধারণত্ব আছে। তাই মনিকাও কেমন করে যেন সংসারের চরম নির্মমতাটাকেও সহজ স্বাভাবিক করে নিতে চাইল। সংসার যা চায় তাতেই হাত মেলাল। নিজের সুখ-স্বার্থটাকে বেশ খানিকটা সঙ্কুচিত-ছোট করে নিল। ধীরে ধীরে ভুলে যেতে লাগল নিজের মতো করে গড়া সুস্থ-সংস্কৃতি মেশা তার স্বপ্নময় জীবনের কথা। সে যে ভালো গান গাইতে পারে, সুন্দর আবৃত্তি করতে পারে, ভালোবাসে রবীন্দ্রকাব্য পড়তে তা যেন ক্রমে ক্রমে ভুলতে শুরু করল।
   কিন্তু আজ সকালবেলাতেই রেডিওর একটা গান ওকে আবার নতুন করে জাগিয়ে তুলল, মাতিয়ে তুলল। চাপা পড়ে থাকা কাব্যপ্রেমিক প্রাণটা একটা সুন্দরের ছোঁয়ায় ঝলমল করে উঠল। উ:, কি ভালো লাগছে তার আজকের এই সকালটা! ভালোলাগার অনুভূতিটা জানাতেই বুঝি মণিকা তার পাশেই শুয়ে থাক ঘুমন্ত স্বামী সুখরঞ্জনকে ঠেলা দিয়ে তুলল।
  -এই শুনছো, ওঠো না।
   একবার উঁহু করে আবার পাশ ফিরে শুল সুখরঞ্জন।
  -এই! ওঠো না’- মণিকা পুনরায় ঠেলা দিল স্বামীকে।
   সুখরঞ্জন চোখ মেলে তাকায় এবার। চোখ রগড়াতে রগড়াতে জিজ্ঞেস করে – কী কী হয়েছে? এমন করে চিত্‍কার করছো কেন?’ তারপর রেডিওর শব্দটা কানে যেতেই একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলে ওঠে – ও: রেডিওটা আবার চালিয়েছ কেন? বন্ধ করো ওটাসকালবেলায় ওসব ঘ্যানঘ্যানানি আমার মোটেই ভালো লাগে না
   মৃদু প্রতিবাদ করে ওঠে মণিকা। ঘ্যানঘ্যানানি কি গো! কত সুন্দর রবীন্দ্রসঙ্গীতটা হচ্ছে।
  -হুঁ, সুন্দর তো কত! তাচ্ছিল্যেভরা একরাশ অবজ্ঞা সুখরঞ্জনের কথায়।
   অন্য সময় হলে এই তাচ্ছিল্য করার মজাটা টের পাইয়ে দিত মণিকা। সে আর যাই করুক রবীন্দ্রনাথকে না জেনে তার কবিতা কিংবা গানকে নিয়ে বিরূপ মন্তব্য সে গায়ে মাখবে নাএকটা ঘটনার কথা মনে পড়লদুবছর আগে তখনো তার বিয়ে হয়নি, তারই কলেজের একটি ছেলে একদিন তার কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্যানপ্যানানি এরকম একটা বিকৃত মন্তব্য করেছিলতার উত্তরে মণিকা সেদিন এমন জবাব দিয়েছিল যে ছেলেটি আর কোনোদিন তার সামনে দাঁড়াবার সাহস হয়নিআজ স্বামীর মধ্যে সেই ধরনের কটুক্তি শুনেও ও যেন কেমন রাগতে পারল নাসহজভাবে শান্তকন্ঠে স্মরণ করিয়ে দিয়ে শুধু বলল – হ্যাঁগো, আজ যে পঁচিশে বৈশাখএমন করে বলছ কেন?’
  -ও তাই বুঝি
  -এই শোনো না
  -বলো না কী বলছ?’
  -চলো না গো আজ একটু কোথাও বেড়িয়ে আসি
সাত সকালেই মণিকার মুখে বেড়াতে যাবার কথা শুনে একটুখানি অবাক হয় সুখরঞ্জনপাশ বালিশটাকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে আড় হয়ে শুয়ে জিজ্ঞেস করে – বেড়াতে যাবে! কোথায়?’
  -যেখানে হোক। রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী পালিত হচ্ছে এমন কোনো অনুষ্ঠানের জায়গায়সত্যি চলো না গো ছোট্ট মেয়ের মতো মণিকা বায়না ধরেরীতিমতো তাতে আবেগ মেশা
   মণিকার কাণ্ড দেখে সুখরঞ্জন হাসে। সে হাসির মধ্যে কিছুটা বিদ্রূপের ছটাবলে – কোথায় যাবে ডিয়ারএ তো আর কলকাতা নয় যে রবীন্দ্রসদন কিংবা জোড়াসাঁকো ঘুরিয়ে আনবো
   স্বামীর মুখে এমনতরো কথা শুনে মরমে মরে যেতে ইচ্ছে হয় মণিকারকী সব অবান্তর কথা বলছে তার স্বামী? রবীন্দ্রজয়ন্তী অনুষ্ঠান দেখার জন্য রবীন্দ্রসদন কিংবা জোড়াসাঁকো পাড়ি দিতে হবে এমন মাথার দিব্যি তাকে কে
দিয়েছে? সে ভাবতে থাকে তার বাপের বাড়িও তো গ্রামেএকেবারে অজ পাড়া-গাঁ বলতে যা বোঝায় ঠিক তাই। তবু আজকের দিনে তাদের পাড়ার ক্লাব এই উপলক্ষে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। পাশাপাশি স্কুলগুলোতেও দিনটি শ্রদ্ধার সঙ্গে পালিত হয়। সারাদিন কত আয়োজন। কত অনুষ্ঠান কর্মসূচি! তার আনন্দ তো কম নয়। তার স্বাদ তো রবীন্দ্রসদনের থেকে আলাদা কিছু নয়। স্বামীর দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে সে।
  -কী ভাবছ?’ সুখরঞ্জন প্রশ্ন করে।
  -তোমাদের স্কুলেই যাব চলো না। সেই আগের মতোই অনুরোধ, বেড়াতে যাবার জন্য আকুতি।
  -আমাদের স্কুলে! বিদ্রূপভরা হাসি হাসে সুখরঞ্জন।
  -হাসছ যে বড়ো? কেন তোমাদের স্কুলে পঁচিশে বৈশাখ হয় না?’
  -কেন হবে না। রবিঠাকুরের প্রতিকৃতিতে ফুল মালাটা পড়ে বৈকি। জনাদশেক ছাত্রছাত্রী কবিতা-টবিতাও আবৃত্তি করে।
  -তবে যে তুমি এখনো শুয়ে আছো। যাবে না?’
  -দূর! বৈদ্যনাথবাবু একাকেই লাগবে না, আবার আমরা।
  -তবে আজকের দিনটা কিভাবে কাটাবে তুমি?’ মণিকা প্রশ্ন করে।
  -কেন, আর পাঁচটা ছুটির দিন যেমন করে কাটাই তেমন করেই কাটবে। বৌয়ের সোহাগ খাব আর বসে থাকব।
  -তুমি কী গো?’ মণিকার গলার স্বরে একটা কষ্টকর অনুভূতি। কিন্তু এতে করে কিছু যায় আসে না সুখরঞ্জনের। তার কথায় মণিকা যে ব্যথা পাচ্ছে এটা বোঝার ক্ষমতা নেই তার। চাপা হাসি নিয়ে সে বলে – তোমার ওই মহাপুরুষটা জন্মেছিল বলে আমাদের ছুটির কোটায় আর যাই হোক একটা দিন তো বেড়েছে। এটাই তো আমাদের ভাগ্যের কথা! বলেই মাথার গোড়ায় রাখা সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরায়।
   সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রতি তার স্বামীর তেমন আকর্ষণ নেই এতদিন মণিকা শুধু শুনেই এসেছিল, আজ তার পূর্ণ পরিচয় পেল সে। একজন শিক্ষক কি করে এতখানি রবীন্দ্রবিমুখ হতে পারে তা সে বুঝতে পারছে না। উদাস চোখে ভাবতে লাগল – দেশের বুকে অজ এই যে চরম অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে, লোভ-হিংসা-বিভেদ-হানাহানি ক্রমশ বেড়েই চলেছে। প্রতি মুহূর্তে ক্ষয় হচ্ছে মানবভিত্তি, নিরক্ষরতা এখনো যেখানে পাহাড়প্রমাণ – এ সব থেকে মুক্ত হবার একটা বড়ো আশা রবীন্দ্রনাথ; তাকে ভালো করে চেনা-জানা, সর্বোপরি তার রচনাবলি ও বাণীকে ভালো করে বোঝা। আর এই ধ্যান-ধারণা সকলের কাছে পৌঁছে দেবার একটা বড়ো দায়িত্ব শিক্ষক সমাজের। সেই শিক্ষকরাই যদি রবীন্দ্রনাথকে বুঝতে না চায়, তার রচনাবলির যোগ্য সম্মান দিতে না শেখে, তাকে মূল্যায়ণ করার মানসিকতা যদি না জন্মায় তাহলে সে দেশের মানুষ হতভাগ্য হবে না তো হবে কারা?
   নিজের স্বামীর প্রতি মনটা বিতৃষ্ণায় ভরে যায় মণিকার। এমন স্বামীর জন্যে লজ্জা হচ্ছে তারএকটা চাপা ক্রোধ জমতে থাকে মনের গহনেসুখরঞ্জন এতক্ষণ মণিকার দিকেই তাকিয়েছিলমণিকা কিছু বলে নাকি অপেক্ষা করছিলমণিকা যখন কিছু বলল না তখন সিগারেটে একটা সুখটান দিয়ে মুখভর্তি ধোঁয়া ছেড়ে সেই-ই জিজ্ঞেস করল – মণিকা, তুমি যে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী অনুষ্ঠানে যেতে চাইছ – আচ্ছা ওই সবে তোমরা কী পাও বলো তো?’
   অবান্তর এ প্রশ্নে মণিকার ভারি রাগ হলবুকের ভিতর সৃষ্টি হল ব্যথাভরা একরাশ অস্বস্তি। তবু সেটা প্রকাশ না করে যতটা সম্ভব চেপে রেখে শুধু বলে – এর উত্তর আমি ঠিক দিতে পারবো না গো। তবে এইটুকু বলতে পারি – সত্যিকার আলো থেকে তুমি কনতু অনেকখনি বঞ্চিত।
  -বঞ্চিত1 আমি? হা হা হা- সুখরঞ্জন হেসে লাফিয়ে ওঠে। -কোনদিক থেকে বঞ্চিত আমি? দেখো মণিকা, এ যুগে কোনো যুবকের সবচেয়ে বড়ো পাওয়া বলতে চাকরিএকটা চাকরিই জীবনের বাঁচার স্বর্গমনে রেখো সেই চাকরি কিন্তু আমি একটা করছিতাই আজ আমার কিসের অভাব? সেইসঙ্গে তোমার মতো সুন্দরী স্ত্রী যখন পেয়েছি বলেই কৌতুকভরা দৃষ্টি নিয়ে দুহাত বাড়িয়ে মণিকাকে কাছে টানতে চাইল
   এবার রীতিমতো ক্ষেপে উঠল মণিকা। স্বামী সুখরঞ্জনকে একপ্রকার জোর করে ঠেলে দিয়ে তক্তপোশ থেকে নেমে নিচে দাঁড়ালক্রোধে ওর সর্বাঙ্গ রি রি করছে তখন। পুরুষের যে মনোবৃত্তিকে মণিকা এতদিন ঘৃণা করে এসেছে স্বামীর মধ্যে তার পরিচয় পেয়ে মনটা ওর বিষাদে ভরে গেলবুকটা ওর দু:খে-ক্ষোভে-অন্তর্দাহে জ্বলে যাচ্ছেএমনটা তো সে চায়নিসে তো চেয়েছিল তার জীবনের সঙ্গী হবে এমন একজন আদর্শ পুরুষ যে অন্তত নারীমনের প্রকৃত স্বরুপটিকে


উপলব্ধি করতে পারবে – একটুখানি মূল্য অন্তত দেবে। তা না – তার স্বামীও তাকে পেতে চাইছে তার দেহটার জন্য! কান্নায় অবশ হয়ে আসছে ওর কণ্ঠটাসীমাহীন বেদনায় ওর চোখের পাতা ভিজে ওঠে
   রেডিওতে তখন সঙ্গীতাঞ্জলি শেষ হয়ে খবর শুরু হয়ে গেছে। খবরের প্রথমেও সেই একই কথা –আজ পঁচিশে বৈশাখবিপুল উত্‍সাহ ও উদ্দীপনার সাথে দেশের সর্বত্র আজকের এই দিনটি যথোচিত মর্যাদায় উদযাপিত হচ্ছে এই উপলক্ষে- সংবাদপাঠক আরো কি সব বলছিলেন তা আর শোনা হল নাতার আগেই মণিকা বিরাট একটা ক্ষোভের সঙ্গে রেডিওটা বন্ধ করে দিলঅবাক হয়ে সুখরঞ্জন জিজ্ঞেস করে – কী ব্যাপাররেডিওটা বন্ধ করলে কেন?’
   এ প্রশ্নের কোনো উত্তর না করে মণিকা ঘর থেকে দ্রুত বের হয়ে গেলসুখরঞ্জন বুঝতে পারল মণিকা বেশ রাগান্বিত
   কলতলায় বাসন মাজতে মাজতে বারেবারেই আনমনা হয়ে পড়ছিল মণিকা। ভারি খারাপ লাগছে তারঅল্পক্ষণ পরেই সে ভাবটা কেটে গেল তার। সে দেখল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন-ঝকঝকে জামা-প্যান্ট পরে একটি সাত-আট বছরের ছেলে কলতলার পাশের রাস্তাটা দিয়ে খুশি মনে হেঁটে যাচ্ছে। হাতে কিছু কৃষ্ণচূড়ার ডাল। তাতে থোকা থোকা লাল টকটকে ফুল। মণিকার একটা অভ্যাস ছোট ছেলে-মেয়ে দেখতে পেলে তাকে কাছে ডেকে তার সঙ্গে হেসে দুটো কথা বলবেই। বাচ্চা ছেলেদের ও প্রচণ্ড ভালোবাসে। সহজাত অভ্যাস মতোই ছেলেটিকে কাছে ডাকে মণিকা। ছেলেটিকে ও চেনে। ও পাড়ার হারু ঘোষের নাতি সৌমেন।
   সৌমেন সামনে আসতেই মণিকা জিজ্ঞেস করে – সকালবেলাই সেজেগুজে কোথায় চললে? হাতেও ফুল দেখছি। কী ব্যাপার?’
   সৌমেন মিষ্টি হেসে উত্তর দেয় – তুমি জানো না কাকিমা, আজ যে পঁচিশে বৈশাখ।
   পঁচিশে বৈশাখ কথাটা কানে যেতেই মণিকা আবার অবাক হয়। ভাবে এ গ্রামেও তাহলে রবীন্দ্রজয়ন্তী হয়। আসলে তার স্বামী এ সবের কিছু খোঁজ-খবরই রাখে না। কিংবা জানলেও দূরে দূরেই থাকতে চায়। তার পরিচয় তো কিছুক্ষণ আগেই পেয়েছে সে। যাইহোক - দু:খ ভারাক্রান্ত হৃদয়টা আবার খুশিতে ঝলমল করে ওঠে তার। আনন্দের সঙ্গে তাই আবার জিজ্ঞেস করে – কোথায় তোমাদের অনুষ্ঠান হবে?’
  -কেন, ওই বুড়ো শিবতলায়।
  -কী কী হবে সেখানে?’
  -আবৃত্তি, গান – আরো কত সব আলোচনা হবে। আমি দামোদর শেঠ কবিতা আবৃত্তি করবো।
  -তাই নাকি?’ মণিকা হাসে।
  -হ্যাঁ। আর সমীরদা দেবে বক্তৃতা
  -সমীরদা কে?’
  -সমীরদাকে চেনো না? গ্রামসুদ্ধ লোক সবাই জানেসমীরদাই তো আমাদের সব। যা কিছু উত্‍সব-অনুষ্ঠান সে তো ওই সমীরদার জন্যেই। এমনভাবে কথাগুলো বলে যেন সমীরদাকে জানে না এমন লোক গ্রামে থাকতেই পারে না। সমীরের নামটা এর আগে মণিকাও শুনেছে। খুব ভালো ছেলে বলে গ্রামে একটা বিশেষ পরিচিতই আছে তার। যদিও সে দুএকবার তাকে দেখেছে, তার সঙ্গে ভালো পরিচয় এখনো হয়নি।  একটা ছোট ছেলে পর্যন্ত তাকে কত সম্মান করে, ভক্তি-শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে, সৌমেনের কথায় আজ সে বুঝতে পারল।
  -কাকিমা, আমি যাচ্ছি। বলেই যাবার জন্য পা বাড়ায় সৌমেন। মণিকা বলে – তুমি চলে যাচ্ছ যে, আমাকে নিয়ে যাবে না?’
   সৌমেন যেতে যেতে ঘুরে দাঁড়াল। ভাবল তার কাকিমা হয়তো রহস্য করছে। তবু বলল –হুঁ, নিজে যাবে কত!
  -নিয়ে গেলে নিশ্চয় যাব!
  -সত্যি বলছ?’
  -সত্যি।
  ও তাহলে তো খুব মজা হবে। আমাদের সমীরদাও খুব খুশি হবে। তবে বেরিয়ে এসো তাড়াতাড়ি।
  -একটুখানি দাঁড়াও। শাড়িটা পরে আসি। দাঁড়াবে কিন্তু-চলে যাবে না- বলেই ধোয়া বাসনগুলো নিয়ে ঘরের মধ্যে চলে গেল মণিকা। সৌমেন কলতলায় দাঁড়িয়ে রইল। কাকিমা তার সঙ্গে যাবে এটা তার খুব ভালো লেগেছে। চোখে-মুখে তাই খুশির রেখা।
  
   শোবার ঘরে ঢুকে মণিকা দেখে স্বামী সুখরঞ্জন তখনো বিছানায় বসেএকটা সিগারেট শেষ করে আর একটায় আগুন ধরিয়েছেরেডিওতে দিল্লির খবর শুনছে। মুখটা বেশ গম্ভীর। মণিকা আলনা থেকে একটা সাদা ধরনের সবুজ পাড় বেছে নিয়ে নিচে নেম গেল। কিছুক্ষণ পড়ে শাড়িটা পরে আবার ঘরে ঢুকল মাথা আঁচড়াতে আঁচড়াতে। ওকে দেখে সুখরঞ্জন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে –শাড়ি পরলে, কোথায় যাবে?’
  -বুড়ো শিবতলায়।
  -সেখানে কেন?’
  -বা:, নিজের গ্রামে কোথায় কি হচ্ছে তারও খোঁজ রাখো না দেখছি। ওখানে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালিত হচ্ছে। আমি যাচ্ছি।
   নিজের কানকেও যেন বিশ্বাস করতে পারল না সুখরঞ্জন। চোখ বড়ো বড়ো করে তাই বলল –শিবতলায় যাবে তুমি রবীন্দ্রজয়ন্তী দেখতে?’
  -শুধু দেখতে নয়। প্রয়োজন হলে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ পর্যন্ত করবো।
  -কি বললে! ওই ছোটোলোকগুলোর সঙ্গে তুমি করবে অনুষ্ঠান?’ ভয়ঙ্কর ক্রোধে চিত্‍কার করে উঠল সুখরঞ্জন।
   ততোধিক রেগে উঠল মণিকাও। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল – ছোটলোক কাদের বলছ তুমি? দেখবে চলো, আমি ওখানে গিয়ে অনুষ্ঠান করবো বললে ওই ছোটলোকগুলোই পরম শ্রদ্ধায় ও আদরের সঙ্গে ওরা আমার আসন ছেড়ে দেবেঅকৃত্রিম ভালোবাসায় আমাকে ভরে দেবে। এমন সম্মান দেবে যা পাওয়ার উপযুক্তই হয়তো আমি নই। তোমার মতো শিক্ষিত ভদ্রলোকদের কাঁটার ঘা তারা আমায় দেবে না।
  -যত্তোসব আবেগ দেখতে পারো।
  -কী বললে, আবেগ?’
  -হ্যাঁ হ্যাঁ আবেগ, স্রেফ অন্ধ আবেগ। আবেগ ছাড়া তোমার ওই রবীন্দ্রপ্রেমে আর কী আছে? তুমিই বলো আর কী আছে?’
   আগের থেকে বেশ কিছুটা শান্ত হয়ে মণিকা বললো –সে তুমি বুঝবে কী? সংসারের ভোগসুখে লালায়িত যে মানুষ সে কী অমর্ত্যলোকের সম্পদের খোঁজ পায়? অনুভব দিয়েই এর সন্ধান মেলে। তোমার মধ্যে সে অনুভূতি কী আর আছে?’ বলেই উত্তর শোনার অপেক্ষা না করে দ্রুত পা ফেলতে ফেলতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
   সুখরঞ্জন নির্বিকার বসে রইল। মণিকার তীক্ষ্ণ কথার বাণে সে রীতিমতো আহত ও স্তম্ভিত হয়ে পড়েছে।
মঙ্গলপ্রসাদ মাইতি