Thursday, May 14, 2020

পথের পাঁচালির দুর্গা অসমাপ্ত জীবন, আকাঙ্ক্ষিত চিত্রন - কৌশানী মিত্র



পথের পাঁচালির দুর্গা
অসমাপ্ত জীবন, আকাঙ্ক্ষিত চিত্রন
কৌশানী মিত্র

‘একেবারে খাটিভাবে নিজের আনন্দের জন্যই লেখা সাহিত্য নহে । অনেকে কবিত্ব করিয়া বলেন যে, পাখি যেমন নিজের উল্লাসেই গান করে , লেখকের রচনার উচ্ছ্বাসও সেইরূপ আত্মগত ,পাঠকেরা যেন তাহা আড়ি পাতিয়া শুনিয়া থাকেন।

......কিন্তু লেখকের প্রধান লক্ষ্য পাঠকসমাজ’।

অংশটি রবীন্দ্রনাথের ‘সাহিত্যের সামগ্রী’ প্রবন্ধের সূচনা। তিনি  বাংলা সাহিত্য তত্ব সম্পর্কে ভাবনা চিন্তা করে সর্বপ্রথম তার আধুনিক ও পরিপূর্ণ রূপদান করেন। তাই তার কথাকে স্বীকার না করে এগোনোর কোনও জায়গা নেই । উপরের উদ্ধৃতি টি অনেকেরই হয়তো মনঃপুত নয় । ভাবনা আসতেই পারে নিজের আনন্দের জন্য ছাড়া সাহিত্য লিখব কেন ? প্যসন কথাটা তো এসব ক্রিয়েটিভ কাজ থেকেই উঠে এসেছে। হুম অবশ্যই একথাটা ঠিক কিন্তু এক প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিকের কাছে মার্কেট ভ্যলুর মুল্য অনেক বেশি। পাঠকের চাহিদা মতো মনের রসদ জোগান দেবে লেখক । এখানেও সেই অর্থনীতির চাহিদা জোগান তত্ত্ব চলে আসে। আসলে সমাজের মূল কাঠামোটাই বোধহয় দাঁড়িয়ে আছে লেনদেন এর ওপর।

তারমানে একটি উপন্যাসে যাকে আমরা চাই, যে চরিত্র কে ভালবাসি নিজের মধ্যে সহজে আত্মস্থ করতে পারি ... যোগ্যতমের উদ্বর্তন রীতি অনুযায়ী সে বেঁচে থাকবে। পাঠকের মুখে মুখে তার নাম ঘুরবে, ছাত্র রা তাকে নিয়ে কাটাছেড়া করে পরীক্ষার পেপার তৈরী করবে আর যে কিছুটা মলিন পাঠকের মনের ঠিক কাছাকাছি নয় সে হবে অপ্রধান চরিত্র। এখানে বলে রাখা ভাল লেখক তাঁর দরকার মতো  নির্মাণ করে এসব চরিত্র। পাঠকের মনের বিন্যাস বুঝেআমরা দেখি সারা উপন্যাসে অল্প কিছু জায়গায় এদের চলাফেরা। এই যেমন তারাশংকরের ‘গণদেবতা’ উপন্যাসে  দেবু মাস্টার আস্তে আস্তে প্রধান চরিত্র হয়ে ওঠে। সেই তুলনায় তার বউ বিলু বড়ই স্তিমিত। এর কারণ সহজ – বিলু র তেমন কোনও প্রয়োজনীয় সক্রিয়তা নেই আর তার থেকেও বড় কথা বিলুর বর দেবু কে প্রধান করে তোলার জন্য তার সবথেকে কাছে অবস্থিত বিলু চরিত্র কে মলিন অসহায় আর দেবু র ভক্ত হিসেবে দেখানোর দরকার হয়ে পড়েছিল। নয়তো দেবুচরিত্র তার গৌরব হারাতো। এখানে বিষয়টা গ্রহণযোগ্য, লেখকের শক্ত হাতের কাজ।

কিন্তু যখন কোনও উপন্যাসের গতি আর লেখকের হাতে থাকে না? তখন দেখা দেয় এমন কিছু চরিত্র যারা প্রধান চরিত্রের গৌরব খর্ব করে। আবার স্বয়ং লেখক তাঁর  অসাধারণ দুর্বলতার জন্য তাদের উপন্যাস থেকে সরিয়ে দিতে বা  মলিন করে দিতও পারেন না। লেখকের আবেগ সঞ্চারিত হয় পাঠকের মনে তারাও আকৃষ্ট হয়ে পড়ে চরিত্রটির প্রতি। অথচ একসময় লেখককে বাধ্য হয়েই প্রধান চরিত্র কে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয় ওইসব চরিত্রের কথা না ভেবেই। তখনই দেখা দেয় অসন্তুষ্টি, চরিত্রের অসম্পূর্ণ চিত্রন আর রবীন্দ্রনাথের ‘কাব্যের উপেক্ষিতা’।

তবে  ‘কাব্যের উপেক্ষিতা’য় যেভাবে তিনি কালিদাস সহ বেশ কিছু কবিকে দোষারোপ করেছেন আমি তেমনটা করব না। কারণ আমি আগেই বলেছি এখানে ব্যপক অর্থে কবি বা লেখকের কোনও দোষ থাকে না। আমি তাই লেখককে দোষ না দিয়েই একটি অপ্রধান চরিত্রের কথা বলব কেবল। জানি সেই মেয়েটি আপনার বাড়ির ফল গাছে রোজ হানা দেয় দুপুরের নিশ্চিন্ত ভাত ঘুমের সময়তাকে নিয়ে একটুও শান্তিতে নেই আপনি। বিভূতিভূষণ ও ছিলেন না যখন দেখছিলেন ছোট্ট অপুর দিদি দুর্গা শুধু অপুকে নয় লেখকের হাত ধরে সমগ্র উপন্যাস নিয়ন্ত্রন করতে শুরু করেছে।

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালীর অন্যতম নির্মাণ দুর্গা চরিত্রটি। অপু যেমন অনেকটাই লেখকের নিজের জীবন থেকে ছিটকে লাগা রঙ্গে রঙ্গীন দুর্গা ও তেমন তার এক প্রিয়তম বোনের স্মৃতিতে নির্মিত- এমনটাই মনে করা হয়। তবে শুরুতে উপন্যাসে  এই চরিত্র স্থান পায়নি। লেখা প্রায় শেষ হয়ে যাওয়ার পর বিভূতিভূষণ একদিন রাস্তায় এক বালিকাকে দেখতে পান – এক মাথা রুখু সুখু চুল, গায় নোংরা শাড়ি কোনওরকমে জড়ানো। সে এক ছুটে তাঁর  সামনে দিয়ে চলে যায় ।হয়তো  লেখকের মনে হয় তার প্রথম উপন্যাসে যে পটভূমি উনি তুলে ধরেছেন সেখানে এই রকম চরিত্র সমগ্র কিশোরী সমাজের প্রতিভূ। তারপর আবার নতুন করে সাজান কাহিনি  আনেন দুর্গা চরিত্রটিলেখক যেভাবে সমগ্র চরিত্রটি নির্মাণ করেন তাতে স্বাভাবিক আলোচনায় উঠে আসে দুর্গাদের পরিণতি হয় তা বিবাহ নয় বৈধব্য কালে একাদশী করে থোর-বড়ি- খাঁড়া জীবন টাকে অতিবাহিত করে দেওয়া।

এক বিধবা কাহিনির শুরুতে বিদ্যমান তিনি ইন্দির ঠাকুরন। সেই বৃহত বৃক্ষের  চারাগাছ হিসাবে লেখক আনলেন দুর্গা কে যে কিনা হরিহরের মেয়ে অপুর দিদি। সমালোচক রা বলছেন অপুর চরিত্র যেহেতু ছোট থেকেই সক্রিয় তাই তার বেড়ে ওঠার শক্ত খুঁটি হিসেবে দুর্গা উপস্থিত। কিন্তু আমার মনে হয় সেই কারনেই যদি দুর্গার প্রয়োজন হত তবে তার প্রতি লেখকের এত আবেগ সেখান থেকে হাত বেয়ে সেই আবেগ  পাঠকের মধ্যেও প্রবাহিত হত কি?

দুর্গা সারাদিন বাগানে বাগানে ঘোরে ... জঙ্গলের ফল পেড়ে খায় । মাঝে মাঝেই হারিয়ে যায় অজানা পথে। কিন্তু তার গণ্ডী সেই নিশ্চিন্দিপুর গ্রামের  ভিতর তার বাইরে যাওয়ার সুযোগ ঘটেনি কখনো। তাই রেলগাড়ি ও দেখা হয়নি তার। সীমাবদ্ধ অঞ্চল থেকে পৃথিবী কে আবিস্কার করার ইচ্ছা থকলেও পারেনি সে। কিন্তু ভাইকে সে শিক্ষা দিয়েছে স্বল্প সময় তা গড়ে দিয়েছে শিশু অপুর মানস কিংবা ভবিষ্যতের কবি লেখক অপূর্ব রায়কে। সমালোচক রা দুর্গার মলিন বেশ দেখেন তার ছেড়া শাড়ি র ব্যখা করে সহজেই তাকে ‘প্রকৃতি কন্যা’ আখ্যা দেন। পরীক্ষার খাতায় যে যত সুন্দর ভাবে দুর্গার মলিনতা ফুটিয়ে তুলতে পারবে সেই ততো ভাল ছাত্র। আর মধ্যে কিছু ‘নারীদের প্রতি অবমাননার ইতিহাস’ ও তার ফলে দুর্গার পড়াশোনা না করার কোট দিলেই হল। এখানেও কি নারী ‘বাদ’ কাজ করছেনা। দুর্গা চরিত্রের গুরুত্ব অপুকে কেবল স্কুলে পাঠানো আর তাকে নিয়ে বনভোজন করা? না তা কখনও নয়। দুর্গা ছোট্ট অপুর প্রথম ও প্রধান শিক্ষক যে আসলে বিমূর্ত। যে আসলে প্রকৃতি। আর এই অপু ছেলে মেয়ে নির্বিশেষ এ আমরা সবাই। যারা জন্মের পর রেলিং এ এসে বসা কাকের ডাক শুনে আধো আধো আওয়াজে বলতে পারি ‘কা কা’ ... তা একসময় পরিণতি পায় মা ডাকে। আর এই বিমূর্ত প্রকৃতি প্রেম একসময় মূর্ত হয়। শিশুর জীবনে আসে পাঠশালা ... অপুর জীবনে যেমন এসেছিল বাবার প্রথাগত শিক্ষা। সেখানে দুর্গার যাওয়া বারণ। আসলে দুর্গার যাওয়ার খুব কি দরকার ? প্রথাগত শিক্ষার দৌড় কতদূর ? যেখানে পৃথিবী – প্রকৃতি র পাঠ নিয়েছে সে। তার যেমন  পরিধির কোনও শেষ নেই । সেরকম দুর্গার চলাচলের কোনও শেষ নেই। সে সর্বত্রঅপুর শিক্ষা সম্পূর্ণ হয় – যার একটা বড় অংশই তার দিদি র শিক্ষা কারণ ---

প্রবাহিত শিক্ষা
প্রথমে দুর্গা তারপর হরিহর অথবা পাশাপাশি দুই প্রকার শিক্ষা
সম্পূর্ণ অপু চরিত্রের নির্মাণ
 
 ...এখানে লেখক দুর্গার  শরীরী আকার দিয়েছেন তাই বলব সশরীরে হয়তো নয় কিন্তু অপুর মানসে দুর্গা আছে ... অপুদের মানসে দুর্গা থাকবেই। উপন্যাসের সর্বত্র তাকে স্মরণ করেছেন লেখক।

অথচ সমালোচনায় সেই এক একঘেয়ে নারীর অবস্থা বর্ণন সহজে বলা যায় লেখক যতটা না উপেক্ষিত করেছেন দুর্গাকে হয়তো বা করেননি। সমালোচক রা নারী বলে তাকে আরও দূরে সরিয়ে রেখেছে। দুর্গাকে মরতেই হতো কারণ সে একটা আইডিয়া মাত্র। আমাদের শিশুকালে একদিন দুর্গাদের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়। দরকার পড়ে প্রতিষ্ঠানের লেখাপড়া। প্রথম টি ভিত্তি নির্মাণ করে দ্বিতীয়টি জীবনের পথে এগিয়ে নিয়ে যায়। প্রথম টিকে অস্বীকার করার উপায় নেই একেবারেই।

দুর্গা বিয়ে কি বোঝে না। ভালবাসা তার সঙ্গে এত ওতপ্রোত ভাবে জড়িত যে আলাদা করে তার প্রকাশ ঘটে না। কিন্তু প্রকৃতি তো কেবল গাছ পাখি দেখায় না বয়সের সাথে সাথে শিশু থেকে কিশোরের মনের আনাচে-কানাচে চিনে নিতে শেখায়  সমাজের কিছু সত্যি যেমন  দারিদ্র , বিবাহ , ভালবাসা – লেখকের কি দরকার ছিল দুর্গাকে দিয়ে চুরির মতো অপবিত্র কাজ করানোর? এতে তো অপুর চরিত্রের কোনও উন্নতি ঘটে না ? স্বাভাবিক মনোবৃত্তি? না না ফল চুরি আর বন্ধুর গয়না, সিদুর কৌটো চুরি এক জিনিস তো নয়। এখানেও অপুর নির্মাণ আর অপুর সাপেক্ষে আমাদের নির্মাণ। এক চরম সত্যকে চিনিয়ে দেওয়া। তাই উপন্যাসের শেষে দিদির চুরি করা সোনার সিদুরের কৌটো একমাত্র অপুরই চোখে পড়ে। জীবনের পথে আর একধাপ এগিয়ে দেয় অপুকে- তার সময়,  তার পরিস্থিতি

একসময় মৃত্যু হয় দুর্গারএরপর অপুর নিজের শিখে নেওয়ার পালা। কেবল রেল গাড়ির কথাটুকু বলে তার চরৈবেতির ইচ্ছাটাকে আরও একটু উস্কে দেয় দুর্গাআমরা যারা আজ কলেজ বা অফিসে যাওয়ার ফাঁকে বেড়াতে যাওয়ার টিকিট কাটার জন্য হাফিয়ে উঠি তাদের ভিতরের দুর্গা তার মনের এই নির্মল ফাঁকটুকু তৈরি করে দিয়েছে। কারো প্রতি দুর্গার নজর একটু বেশি কারো প্রতি একটু কম। কিন্তু সবার শিশুকাল কেটেছে কোনও না কোনও দুর্গার হাত ধরে।

প্রথমেই বলেছি লেখকের হাতে উপন্যাসের সবটুকু নয়। তাও এখানে লেখক নির্দয়। উপেক্ষিত চরিত্র নয় দুর্গা। কিন্তু উপেক্ষিত সমালোচক দের কাছে। তাদের সীমাবদ্ধ মনের কাছে। হয়তো আমার কাছেও  কারণ  দুর্গাকে কোনও কোটেশন দ্বারা ব্যাখা করা সম্ভব নয় । দুর্গা সমস্ত প্রথাগত শিক্ষার বাইরে। আমাদের অবচেতন - মন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। যার কাছেও পরীক্ষা দিতে হয় আমাদের  ,আসে পাস ফেলের প্রশ্ন । কিন্তু সব সময় এই দুর্গাই  আগলে রাখে অপুকে থুড়ি অপুদের তার সেই ঐশ্বরিক হাত, সেই অপরিসীম ভালবাসা আর এক পরিতৃপ্ত হৃদয় দিয়ে

No comments:

Post a Comment