সঞ্জীবন
সৌরভকুমার
ভূঞ্যা
আলগোছে
খবরের কাগজের পাতা ওল্টাচ্ছিলেন অনিন্দ্য। খুঁটিয়ে
পড়ার সময় নেই। কেবল শিরোনামগুলিতে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলেন। সব
শিরোনাম চোখে আসছিল এমন নয়। সহসা একটা
খবরে এসে চোখ আটকে যায় তার। খবরটি খুব
ছোটো কিন্তু সেটা অনিন্দ্যকে যেন চুম্বকের মতো আকর্ষণ করতে থাকে।
‘নিঃসঙ্গ কবি’ শিরোনামে জেলার পাতায় খবরটি
বেরিয়েছে। কবি কিংবা কবিতায় কোনো উৎসাহ নেই অনিন্দ্যর।
নিজে বিজ্ঞানের ছাত্র। গল্প-কবিতা-উপন্যাস পড়া তার কাছে সময়ের
অপচয় বলে মনে হয়। সাহিত্যিকদের প্রতিও তার বিশেষ কোনো শ্রদ্ধা
নেই। তার বিশ্বাস কবি-সাহিত্যিকরা আর যাই
হোক, সভ্যতার অগ্রগতি ঘটাতে পারে না। ক্রমোন্নতির
যে ধারায় এগিয়ে চলেছে সভ্যতা তা বিজ্ঞানের অবদান।
তবে এ-তার একান্ত ব্যক্তিগত মতামত। এ-নিয়ে
কারও সঙ্গে কোনো বিতর্কে যায় না। কিন্তু
ছোট্ট খবরটা তাকে অদ্ভুতভাবে নাড়িয়ে দেয়। কিছুতেই তিনি
খবরটাকে এড়িয়ে যেতে পারেন না।
খুব ছোট্ট করে বেরিয়েছে খবরটা।
বিশিষ্ট কবি সুমত দত্ত খুব অসুস্থ। এমনিতে বয়স
হয়েছে তার। সত্তরের কাছাকাছি বয়স।
অবস্থা ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। তার
চিকিৎসার জন্য আর্থিক সাহায্য দরকার। কিন্তু যে
মানুষটি তার কবিতায় আলো জ্বেলেছেন, আজ তিনি নিঃসঙ্গ অন্ধকারে জীবন কাটাচ্ছেন।
কেউ নেই তার পাশে।
খবরটা পড়তে পড়তে এক অদ্ভুত আনন্দ জেগে ওঠে
অনিন্দ্যর মনে। মনের মধ্যেকার আরেকটা অনিন্দ্য নীরবে হেসে ওঠে।
অদ্ভুত এক জয়ের গৌরবে বুকের মধ্যে জেগে ওঠে অদ্ভুত সুখ।
একটা সুপ্ত ক্ষত, যেটা অনেকদিন চাপা পড়েছিল সহসা যেন তার জ্বালাটা অনুভব করেন তিনি।
তবে স্পষ্ট বুঝতে পারেন এ-ক্ষতের জ্বালাটা আগের মতো যন্ত্রণাদায়ক নয়।
বরং যেন জ্বালা-জুড়োনোর এক অদ্ভুত ভালোলাগা অনুভব করেন তিনি।
ভাবনার মধ্যে ডুবে যান অনিন্দ্য।
মুহূর্তক্ষণের মধ্যে তিনি তার কর্তব্য স্থির করে ফেলেন।
সিদ্ধান্ত নেন, আগামীকালই তিনি যাবেন কবি সুমিত দত্তের বাড়ি।
তার মুখের ওপর যোগ্য জবাব দিয়ে আসবেন। অপমানের
গভীর ক্ষতটা আজও শুকোয়নি। সেই
অপমানের বদলা নেওয়ার সুবর্ণ সুযোগ। এটা তিনি
কোনোভাবেই হাতছাড়া করতে চান না।
২.
সাহিত্য
জগতে সুমিত দত্ত একটি অতি পরিচিত নাম। তিনি একজন
খ্যাতনামা কবি। কিন্তু অনিন্দ্য এই কবির সঙ্গে দূরে থাক, তার
নামের সঙ্গেও পরিচিত ছিলেন না। বছর পাঁচেক
আগে একবারই তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল।
সাহিত্য-প্রেম না থাকলেও অনিন্দ্য জীবনে কোনো সাহিত্যিকের সংস্পর্শে আসেননি এমন
নয়। একটি নামী বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হওয়ায়
মহকুমার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে ডাক পান।
সে-সব অনুষ্ঠানে কোথাও কোথাও কবি-সাহিত্যিকরাও অতিথি হিসেবে আসেন।
তাদের সঙ্গে প্রথাগত পরিচয়ও হয়। কিন্তু
মঞ্চ থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় তাদের কথা ভুলে যান।
সেরকমই একটি অনুষ্ঠানে তার পরিচয় হয়েছিল কবি সুমিত দত্তের সঙ্গে।
কিন্তু অন্যান্যবারের মতো এবার ব্যাপারটা ঘটল না।
সুমিত দত্তকে ভোলা দূরের কথা, তিনি যেন মনের মধ্যে জাঁকিয়ে বসে গেলেন।
সময়ের ব্যবধানে একটা সময় হয়তো তার কথা মন থেকে হারিয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু খবরটা পড়ার পর বুঝতে পারেন কী গভীরভাবেই না তিনি রয়ে গেছেন মনের ভেতর।
বছর পাঁচেক আগের ঘটনা।
বিদ্যাসাগর সংস্কৃতি সংঘের রজতজয়ন্তী অনুষ্ঠান।
বিদ্যাসাগর সংস্কৃতি সংঘ এলাকার একটি অত্যন্ত নামী সংস্থা।
তিনদিনব্যাপী অনুষ্ঠানের একদিন ছিল সেমিনার। সেমিনারের
বিষয়বস্তু ছিল—সমাজের অগ্রগতিতে সাহিত্য ও বিজ্ঞানের অবদান।
সাহিত্য নিয়ে বলার জন্য এসেছিলেন সুমিত দত্ত আর বিজ্ঞান বিষয়ের বক্তা ছিলেন
অনিন্দ্য রায়। দুজনের বক্তব্য যে ভিন্ন হবে সেটা
স্বাভাবিক এবং দুজনের মতামতে যে বিতর্কও থাকবে সেটাও জানতেন অনিন্দ্য।
এনিয়ে কোনো বিতর্কে যাওয়ার পক্ষপাতী তিনি ছিলেন না এবং সেরকম কোনো ইচ্ছেও তার
ছিল না। কিন্তু শেষপর্যন্ত নিজের সিদ্ধান্তে তিনি অটল
থাকতে পারেন না।
সমস্যাটা কিন্তু বক্তব্য নিয়ে শুরু হয়নি।
যথাসময়ে সভায় পৌঁছে যান অনিন্দ্য।
উদ্যোক্তারাও যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করে।
এনিয়ে অভিযোগ করার মতো কিছু ছিল না। কিন্তু
একটা ব্যাপার তিনি লক্ষ করেন, কবি সুমিত দত্তকে নিয়ে উদ্যোক্তারা যেন একটু
বেশিমাত্রায় সচেতন। তাকে নিয়ে তাদের উচ্ছ্বাস, আবেগ মাত্রাতিরিক্ত
বেশি। একথা ঠিক সুমিত দত্ত তার থেকে বয়সে অনেক বড়ো।
কিন্তু বয়স নয়, তিনি বুঝতে পারেন যেহেতু সুমিত দত্ত একজন কবি তাই তিনি বাড়তি
গুরুত্ব পাচ্ছেন। ব্যাপারটা তার আত্মসম্মানে আঘাত করে।
মনে মনে একটু ক্ষুব্ধ আর বিরক্ত হন তিনি। নিজের
বক্তব্যে তা তিনি পরোক্ষে একপ্রকার প্রকাশও করে ফেলেন।
সাহিত্য নিয়ে কিছু বলবেন না স্থির করলেও শেষপর্যন্ত কিছু কথা না বলে থাকতে পারেন
না।
মঞ্চের ব্যাপারটা মঞ্চেই শেষ হয় না।
সেমিনার শেষে আপ্যায়ন করার জন্য উদ্যোক্তারা তাদের সংস্থার অফিসে নিয়ে গিয়ে বসায়।
সেখানে পরস্পর মুখোমুখি হন। স্বাভাবিক
কথাবার্তা বলতে বলতে দুজনের আলোচনার মধ্যে এসে পড়ে সেমিনারের বিষয়।
ঝগড়া কিংবা বাক-বিতণ্ডা নয়, দুজন পণ্ডিত মানুষ নিজ নিজ বিষয় নিয়ে যুক্তি আর পাল্টা
যুক্তিতে একটা বিতর্কের পরিবেশ সৃষ্টি করে ফেলেন।
কথাবার্তার সময় সুমিত দত্ত বেশ শান্ত আর সংযতভাবেই কথা বলেছিলেন।
কিন্তু অনিন্দ্য মাঝে মাঝেই তার মেজাজের নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছিলেন।
আসলে সুমিত দত্তের প্রতি উদ্যোক্তাদের বাড়তি গুরুত্ব প্রদানের ব্যাপারটা তিনি
কিছুতেই মন থেকে তাড়িয়ে দিতে পারছিলেন না। কথায় কথায়
একসময় বেশ বিরক্তির সুরে তিনি বলে দেন, এসব কবিতা লিখে বা পড়ে সমাজ বা সভ্যতার
কোনো অগ্রগতি হয় না। সাধারণ মানুষের কোনো কাজে লাগে না
কবিতা। তাছাড়া হাজার হাজার মানুষ কবিতা লেখেন।
কতজনের কবিতা বেঁচে থাকে? কতজন কবিই বা কবিতা লিখে মানুষের মনে স্থান করে নিতে
পারে? এইসব আরও কিছু কঠিন কঠিন কথা বলে দেন অনিন্দ্য।
প্রত্যুত্তরে বেশি কিছু বলেননি সুমিত দত্ত। শুধু
বলেছিলেন, কবিতা আসলে একটা আলো। যে আলো
কবিকে বাঁচতে সাহায্য করে। শুধু কবি নয়, যারা কবিতা ভালোবাসে তারাও সেই আলো পায়
কবিতা থেকে। আর আমি কবিতা লিখি নিজের ভালোলাগা থেকে।
কবিতা আমার কাছে এক আশ্চর্য সঞ্জিবনী সুধা যা আমাকে জীবনের সমস্ত যন্ত্রণা থেকে
মুক্তির পথ দেখায়। আমি বেঁচে আছি আমার কবিতার জন্য। কে
আমার কবিতা পড়ল, আমার কবিতা সমাজের কী উপকারে আসবে এসব নিয়ে আমি ভাবি না।
একটি কবিতা লিখতে পারলে আমি অদ্ভুত এক আলো খুঁজে পাই।
নিজে সেই আলোয় বেঁচে থাকার চেষ্টা করি। সেই আলো
যদি সমাজের আর কাউকে কিছুটা পথ দেখায় ভালো, না দেখালেও আমার দুঃখ নেই।
কবিতা আমার কাছে বাঁচার অক্সিজেন। অক্সিজেন
ছাড়া যেমন মানুষ বাঁচতে পারে না, কবিতা না লিখতে পারলে আমারও সেরকম অবস্থা হয়।
তাই আমি কবিতা লিখি। আমৃত্যু আমি সেই চেষ্টাই করে যাব।
সুমিত দত্তের কথাগুলোর মধ্যে কোনো যুক্তি
খুঁজে পাননি অনিন্দ্য। এগুলো আবেগের বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর
কিছু মনে হয়নি তার। কিছুটা রুক্ষ সুরে বলে দিয়েছিলেন, বাঁচার অক্সিজেন
বলে যদি সত্যি কিছু হয় সেটা হল অর্থ।
কবিতা ছেড়ে প্রসঙ্গটা শেষে অর্থে এসে দাঁড়ায়।
সুমিত দত্ত জোরের সঙ্গে বলতে থাকেন অর্থটা জীবনের বড়ো কিছু নয় আর অনিন্দ্য বলতে
থাকেন ঠিক এর উল্টো কথা। যাই হোক, সমাধানহীন বিতর্কে একরাশ
ক্ষোভ আর বিরক্তি নিয়ে ফিরে এসেছিলেন অনিন্দ্য।
তারপর আর কোনোদিন সুমিত দত্তের সঙ্গে দেখা হয়নি। আজ
হঠাৎ করে তার সামনে সুযোগ এসেছে সেই বিতর্কের সমাধানের।
সুমিত দত্তকে তিনি বলবেন সেদিন তিনি কতটা ভুল ছিলেন।
তাকে বলবেন, বাঁচার জন্য কবিতা নয়, অর্থই প্রয়োজন।
৩.
সুমিত
দত্তের ব্যাপারটা নিয়ে বেশ একটা জোর আলোচনা শুরু হয়ে গেছে।
তবে ঠিক সুমিত দত্ত নয়, আলোচনাটা মূলত অনিন্দ্যকে নিয়ে।
তার উদারতা আর মহত্বের কথা নিয়ে সাহিত্য মহলের পাশাপাশি অনিন্দ্যর পরিচিত মহলেও
জোর আলোচনা চলছে। একজন মানুষ যে কোনোদিন কবিত লেখেনি, কেবলমাত্র
কবিতার প্রতি ভালোবাসায় এত কিছু করতে পারে! ব্যাপারটা সকলকে নাড়িয়ে দেয়।
তাদের কাছে একটা সম্ভ্রমের জায়গা করে নিয়েছেন অনিন্দ্য।
সোশ্যাল মিডিয়ায় অনিন্দ্যকে নিয়ে অসংখ্য পোস্ট, হাজারও কমেন্ট।
এমনকি যে কাগজ সুমিত দত্তর অসুস্থতা নিয়ে ছোট্ট একটা খবর করেছিল, সেই কাগজই
অনিন্দ্যকে নিয়ে বেশ বড়ো একটা স্টোরি করেছে। আর
হবে নাই বা কেন? যে অসুস্থ মানুষটার কথা এতদিন কেউ ভাবেনি, তার জন্য কী না করছেন
অনিন্দ্য!
দিন সাতেক হল নার্সিহোমে ভর্তি সুমিত দত্ত।
অনিন্দ্যই সব ব্যবস্থা করেছেন। সুমিত
দত্তের চিকিৎসার দায়ভার নিজের কাঁধে নিয়েছেন।
ডাক্তারদের বলেছেন, যত টাকা লাগুক চিন্তা না করতে।
সুমিত দত্তকে যেন সারিয়ে তোলেন তারা। শুধু
নার্সিংহোমে ভর্তি করাই নয়, প্রতিদিন
একবার করে এসে খোঁজ নিচ্ছেন তার। চিকিৎসকদের
সঙ্গে কাথাবার্তা বলছেন। অনিন্দ্য মনে-প্রাণে আন্তরিকভাবে
চাইছেন সুমিত দত্তকে সুস্থ করে তুলতে। এ-যেন তার
নিজেরই বাঁচা-মরার প্রশ্ন।
অনিন্দ্যর অতি ঘনিষ্ঠ কিছু মানুষ তার এই কাজ
দেখে বেশ অবাক হয়ে গেছে। যে লোকটা সাহিত্য নামক বিষয়িটতে
একেবারে উদাসীন, তার হঠাৎ কী এমন হল যে সুমিত দত্তকে সুস্থ করার জন্য এমন উঠে পড়ে
লেগেছে! তারাও বেশ বিভ্রান্ত। তবে
সত্যিটা কেবল অনিন্দ্যই জানেন। সাহিত্য
নিয়ে তার আগের মতামত বা বিশ্বাসের কোনোরূপ বদল হয়নি।
সুমিত দত্তের ওপরও তার কোনো শ্রদ্ধা নেই। তবুও তিনি
তাকে সুস্থ করে তুলতে মরীয়া। কেননা তাকে
সুস্থ করে তিনি প্রমাণ করে দেবেন বাঁচার জন্য অর্থ চাই।
তাকে বুঝিয়ে দেবেন সেদিন সুমিত দত্ত ভুল ছিলেন। আর
তাকে ভুল প্রমাণ করা মানে নিজের জিত।
নার্সিংহোমে অসুস্থতার সঙ্গে লড়াই করছে সুমিত দত্ত আর অনিন্দ্য লড়ছেন নিজের সঙ্গে।
জিততে হবে তাকে। মরীয়া তিনি।
সুমিত দত্তের কেবিনে ঢোকেন অনিন্দ্য।
দেখে বালিশে ঠেস দিয়ে আধশোয়া হয়ে সুমিত দত্ত।
চোখ-মুখ দেখে বুঝতে পারেন আজ তার আবস্থা বেশ ভালো।
তাকে দেখে মৃদু হাসেন সুমিত। অনিন্দ্য
লক্ষ করেন সেই হাসির মধ্যে অদ্ভুত এক আলো।
পাঁচ বছর আগে কিছু সময়ের জন্য অনিন্দ্যকে
দেখেছিলেন সুমিত দত্ত। তারপর অনেকগুলো বছর কেটে গেছে।
বয়সের ভারে স্মৃতিও অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাই
অনিন্দ্যকে চেনা তার পক্ষে সম্ভব নয়। অনিন্দ্যও
কোনোমতেই চাননি সুমিত দত্ত তাকে চিনতে পারুক।
নিজেকে সুমিতের একজন পাগল ফ্যান বলে পরিচয় দিয়েছেন। আর
এমন ফ্যান পেলে কার না আনন্দ হয়?
‘কেমন আছেন?’
‘খুব ভালো আছি।’
সুমিতের চোখে-মুখে উজ্জ্বলতা। যা দেখে
বুঝতে অসুবিধা হয় না তিনি বেশ সুস্থ।
‘আজ যন্ত্রণাটা কেমন আছে?’
‘আজ কোনো যন্ত্রণা নেই।
মনে হচ্ছে আমি একেবারে সুস্থ হয়ে গেছি।’
অনিন্দ্য খুশি হয়।
বলেন, সুস্থ তো আপনাকে হতেই হবে। আপনার
কবিতার কত পাঠক রয়েছে। তারা আপনার সুস্থতার জন্য প্রার্থনা
করছে। আপনি সুস্থ হবেন, আবারও কবিতা লিখবেন।
আপনার অসংখ্য গুণমুগ্ধ পাঠক কত গভীরভাবেই না প্রত্যাশায় রয়েছে আপনার কবিতার জন্য।
শেষের কথাগুলো যে তীব্র বিদ্রূপাত্মক তা বুঝতে পারেন না সুমিত দত্ত।
অনিন্দ্যর মুখে কবিতার কথা শুনে তার চোখদুটো জ্বলজ্বল করে ওঠে।
কিছুটা সময় একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকে অনিন্দ্যর দিকে।
অনিন্দ্যর একটু অস্বস্তি করতে থাকে। বলে, ‘কী হল, এমন করে চেয়ে আছেন কেন?’
‘আপনার ভালোলাগে আমার কবিতা?’
একটু ঘাবড়ে যান অনিন্দ্য। কী
জবাব দেবেন ভেবে পায় না। ভালোলাগে তো বলতেই হবে।
কিন্তু তারপর কী বলবেন? সুমিত দত্ত হয়তো তার কবিতার কথা জানতে
চাইবে। এমনকি তার ভালোলাগা কিছু কবিতার কথাও জানতে
চাইতে পারেন। কিন্তু যার কোনো কবিতা তিনি পড়েনি, তার কবিতা
নিয়ে কী মন্তব্য করবেন? এদিকে চুপ করেও থাকা যায় না।
কিছু একটা জবাব দিতেই হয়।
‘আপনার কবিতার মধ্যে এমন কিছু আছে যা পড়লে এক
আশ্চর্য শক্তি পাই। বলতে পারেন বাঁচার অক্সিজেন।’
শেষ কথাটা বলে নিজেই কেমন চমকে যায় অনিন্দ্য।
আপনা থেকেই কথাটা বেরিয়ে আসে মুখ থেকে।
কথাটা শুনে সুমিত দত্ত একদৃষ্টিতে তার দিকে
তাকিয়ে থাকেন। অনিন্দ্য তার চোখের ভাষা বুঝতে পারেন না।
একটু অস্বস্তি করতে থাকে তার। ভাবে, ধরা
পড়ে যায়নি তো? কিন্তু না, সেরকম কিছু ঘটে না।
সুমিত দত্ত একবুক তৃপ্তি নিয়ে বলেন, ‘যে কোনো ভালো কবিতাই বাঁচার অক্সিজেন
জোগায়।’
‘আপনি একদম ঠিক কথাই বলেছেন।’
আরও কিছু
বলতে যাচ্ছিলেন সুমিত কিন্তু বলা হয় না। ডাক্তারবাবু আসেন।
সুমিতকে পরীক্ষা করেন। বেশ কিছু নির্দেশ দেন। ডাক্তার
বেরিয়ে যেতে অনিন্দ্যও তার পেছনে পেছনে কেবিনের বাইরে আসেন।
‘কেমন দেখছেন
ডাক্তারবাবু?’
ডাক্তার রায় একটু সময় নিয়ে বিষণ্ণ কন্ঠে বলেন,
‘ভালো না।’
অনিন্দ্যর তার কথা বিশ্বাস হয় না।
ডাক্তার রায় বলে চলেন, ‘দেখুন ওনার চিকিৎসা আরও আগে হওয়া দরকার ছিল।
তাহলে হয়তো কিছু করা যেত। এখন
পরিস্থিতি খুব জটিল। সেরে ওঠার কোনো সম্ভাবনা নেই।’
অনিন্দ্য চমকে ওঠে।
ডাঃ রায়ের কথা বিশ্বস হয় না তার। প্রতিবাদের
সুরে বলে, ‘কিন্তু আজ ওনাকে দেখে তো বেশ সুস্থ মনে
হচ্ছে। চোখ-মুখ বেশ চনমনে।
আমাকে বললেনও ভালো আছেন বলে। কোনো
যন্ত্রণাও নেই। আরও অনেক কথা বলছিলেন।’
‘প্রদীপের শিখা নেবার
আগে উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে ওঠে। ওনার
অবস্থা অনেকটা সেরকমই বলতে পারেন।’
‘কী হয়েছে ওনার?’
‘হি হ্যাজ বিন সাফারিং
ফ্রম ক্যানসার অ্যান্ড লাস্ট স্টেজ। আমাদের আর
কিছু করার নেই।’
বুকটা ধড়াস করে ওঠে অনিন্দ্যর।
এতটাই ধাক্কা খায় যে তার মুখ দিয়ে কোনো কথা সরে না।
নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি। ডাঃ রায় আর
কিছু না বলে এগিয়ে যান।
মনটা খুব খারাপ হয়ে যায় অনিন্দ্যর।
সুমিত দত্ত সেরে না উঠলে তিনি হেরে যাবেন, এই ভাবনা আর তার মাথায় নেই।
কোনোরূপ ভালোবাসা কিংবা শ্রদ্ধা ছাড়াও লোকটির সঙ্গে কয়েকটা দিন কাছাকাছি
কাটিয়েছেন। বুঝতে পারেননি নিজের অজান্তেই লোকটির প্রতি টান
জন্মে গেছে। এই মুহূর্তে সেই লোকটির আয়ু আর বেশি নেই জেনে
বুকটা কেমন বেদনায় মোচড় দিয়ে ওঠে।
ধীর পায়ে আবারও সুমিতের কেবিনে ঢোকেন
অনিন্দ্য। অবাক হয়ে দেখেন আগের মতোই বালিশে পিঠ ঠেকিয়ে
আধশোয়া হয়ে বসেছেন তিনি। হাতে ধরা
একটা ছোট্ট রাইটিং প্যাড আর কলম। নিবিড় মনে
লিখে চলেছেন সুমিত। লেখার মধ্যে এতখানি ডুবে আছেন যে তার
ঘরে ঢোকা বুঝতেই পারেননি। কোনো
শব্দ না করে ধীর পায়ে সুমিতের মাথায় কাছে এগিয়ে যান অনিন্দ্য। অবাক
হয়ে দেখেন একমনে কবিতা লিখছেন সুমিত। এতটাই
নিমগ্ন যে মনে হয় কবিতা লিখছেন না, যেন তপস্যায় বসেছেন।
কোনোদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। লোকটিকে
দেখে মনে হয় না তিনি ভীষণ অসুস্থ। শরীরে
কোনো যন্ত্রণার চিহ্ন আছে। কেউ
বিশ্বাস করবে না মৃত্যু এই লোকটির একেবারে শিয়রে। আর মাত্র কিছুদিন তার আয়ু।
সুমিতের ধ্যানস্থ মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন অনিন্দ্য।
বড়ো শান্ত, পবিত্র সেই মুখ। একটা
উদ্ভাসিত আলো ছড়িয়ে রয়েছে মুখমণ্ডলে। যে আলোর
পাশে দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা এমনকি মৃত্যুর শীতল অন্ধকারও হার মেনে গেছে।
No comments:
Post a Comment