গল্পকার--সৌরভকুমার ভূঞ্যা
আলোচক---শুভ্রাশ্রী মাইতি
আলোচক---শুভ্রাশ্রী মাইতি
শরীর আর মনের বন্ধ জানালাটা খুলে
দিলে
কখনও একরাশ সোনা রোদে ভেসে যায় ঘর।
কখনও বা শ্রাবণ ঘনায় ছায়ামাখা মেঘে।
আলো ছায়া তখন গলাগলি করে লুকোচুরি খেলে আমার ঘরে...
কখনও একরাশ সোনা রোদে ভেসে যায় ঘর।
কখনও বা শ্রাবণ ঘনায় ছায়ামাখা মেঘে।
আলো ছায়া তখন গলাগলি করে লুকোচুরি খেলে আমার ঘরে...
মানুষের
অন্দরমহল অর্থাৎ মন বড়ই বিচিত্র। জন্ম মৃত্যুর মাঝে বয়ে চলেছে অনন্ত জীবন প্রবাহ।
সুখ-দুঃখ, ভালবাসা-অভিমান, মিলন-দহন ছোট বড় নানান ঢেউয়ের মালায় গাঁথা হয়ে যায় সেই
জীবন প্রবাহে গা-ভাসানো সম্পর্কের নিত্য-নতুন সমীকরণ। সেই সব চেনা-অচেনা সমীকরণের
উদ্ভাসিত আলোয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে গহন মনের আলো-ছায়ার আশ্চর্য অস্তিত্ব অনুভূতি। সেই
সব আলো-ছায়ার টুকরো টুকরো কোলাজকে একত্রিত করে গল্পের ক্যানভাসে জীবনের যে রঙিন
জলছবি দক্ষ হাতে ফুটিয়ে তুলেছেন গল্পকার সৌরভকুমার ভূঞ্যা তা যে শুধু চিত্তাকর্ষক
তাই-ই নয়,ভাবে-ভাবনায়, বোধে-চিন্তনে তা পাঠক হৃদয়ে প্রস্তুত করে এক বিস্তৃত
ধ্যানভূমি।
সুন্দর
প্রচ্ছদ আর বারোটি ছোট,বড় গল্প দিয়ে সাজানো ১২৭ পাতার এই বই--‘আলো ছায়ার অন্দরমহল'
গল্পকার সৌরভকে পাঠকহৃদয়ে উপস্হাপিত করে এক নিবিড় জীবনবাদী শিল্পী হিসাবে যিনি
শুধু তাঁর পাঠককে বাইরের অতিথি করে বসার ঘরে বসিয়ে রাখেন না,সহজ-সরল গল্প বলার
মুন্সিয়ানায় তাঁকে চরিত্রগুলির আত্মার আত্মীয় করে তাঁকে নিয়ে পরম সমাদরে ঘুরে
বেড়ান মানব মনের আলো -আঁধারির গোপন অলিগলিতে।
এমনি ভাবেই
‘ছায়ানীড়' গল্পে উঠে এসেছে এক নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের অভাব-অনটনের অসুখী
ক্যানভাসে হার্টের কঠিন অসুখে মৃত্যুপথযাত্রী বাবা আর চাকুরিপ্রার্থী বেকার ছেলের
সম্পর্কের টানাপোড়েনের এক আশ্চর্য সমীকরণ। অসুস্হ বাবার চিকিৎসার দায় থেকে মুক্তি
পেতে আর সর্বোপরি বাবার কোম্পানিতে একটি চাকুরি লাভের লোভী স্বপ্নটাকে বাস্তবায়িত
করতে বন্ধুর পরামর্শে ছেলের বাবাকে ঘুমের ঔষধ খাইয়ে মৃত্যুর শীতল আশ্রয়ে পাঠিয়ে
দেওয়ার গোপন ইচ্ছে পাঠককে চমকে দেয়,সজোরে তার মুখ ফিরিয়ে তার সামনে এনে দেয়
বর্তমান সমাজের অর্থনীতির ঘুণধরা চালচিত্রটিকে যেখানে সব সম্পর্কের গভীরতাকে
নিয়ন্ত্রণ করে অর্থ।অবশ্য গল্পকারের লেখনী এখানেই থেমে থাকে না---বাবার নিঃস্বার্থ
আত্মত্যাগী মনোভাবে মনের অন্ধকারকে দূরে সরিয়ে ছেলে অবশেষে সন্ধান পায় মানবিক
সম্পর্কের সেই কাঙ্খিত ছায়ানীড়ের--- ‘সেই ছায়ার শীতলতাকে সমস্ত অন্তর দিয়ে শুষে
নিতে থাকে তার অশান্ত হৃদয়।' এই উত্তরণই তো আলোর পথে যাত্রা।
এরকম
আলোকযাত্রা পথ আঁকা হয়েছে ‘আত্মপরিচয়' গল্পটিতেও যেখানে গল্পের শেষে সমস্ত বিদ্বেষ
মুছে পিতা-পুত্রের মধুর মিলনের অপরূপ দৃশ্য ছুঁয়ে যায় মনের নরম মাটিকে। এর বিপরীত
দৃশ্য দেখা যায় ‘আলোছায়ার অন্দরমহল' গল্পটিতে যেখানে পিতা-কন্যার সম্পর্কের মাঝে পাঁচিল
হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রখর আত্মসম্মানবোধ যা ফুটে ওঠে অর্পিতার বজ্রকন্ঠে---‘ আমি নিজের
মতো করে বাঁচতে শিখে গেছি।'
কৈশোর প্রেমের
মিষ্টি রোমান্টিকতা যে জীবনের নানা টানাপোড়েনেও নষ্ট হয় না,বরং স্মৃতির সোনালী
ভান্ডারে জমা থাকে গোপন গুপ্তধনের মতো যার অজানা নস্টালজিক মধুময়তা শেষ বয়সেও
জোগায় বাঁচার রসদ--তার সাক্ষ্য বহন করে ‘প্রাক্তনী' গল্পটি---‘সময়ের পিছু ফেরা পথে
পা বাড়ায় অনুপম।দেখে একঝাঁক প্রাক্তনীর মাঝে বসে আছে এক কিশোর।সামনে মঞ্চে এক
কিশোরী।মুখে মৃদু হাসি।তার চোখে চোখ রেখে অপলক ভাবে চেয়ে থাকে অনুপম।'
‘দৌড়' গল্পটিতে
লেখক দেখিয়েছেন বিশ্বাস মানব জীবনের কতবড় মহার্ঘ্য সম্পদ।সবথেকে অপদার্থ মানুষটির
প্রতিও যদি বিশ্বাস রাখা যায়,তবে সে সেই বিশ্বাসের মর্যাদা দিতে অসম্ভবকেও
সম্ভবসাধন করতে পারে।স্কুলের সব থেকে দুষ্টু আর অপদার্থ ছাত্র অমিতের স্যারের
বিশ্বাসের মর্যাদারক্ষায় নিজেকে অতিক্রম করার ব্যাকুলতা ছুঁয়ে যায় পাঠকহৃদয়।
পুরুষতান্ত্রিক
অনৈতিকতার প্রতিবাদে গর্জে ওঠা ভালবাসার নারীর উত্তরণের কাহিনী শোনায় ‘মান-অপমান'
গল্পটি যেখানে লম্পট বিশাখকে অবাক করে আত্রেয়ী বলে ওঠে---‘যদি কোনদিন তুমি চাকরি
ছেড়ে দিতে পার,তবেই আমাকে ফোন করতে পার।'
অপরদিকে '
আত্মসমর্পণ' গল্পটিতে সমাজসচেতন জীবনবাদী লেখকের মরমী কলমে ফুটে ওঠে সমাজের এক
ভয়াল,বীভৎস ছবি যেখানে বাবার যৌন কামনার হাত থেকে বাঁচাতে দরিদ্র, অসহায় মায়ের
নিজের নাবালিকা মেয়ের যে কোন একটা বিয়ে দিতে মরিয়া হয়ে ওঠার আকুতি ফুটে ওঠে
গল্পকারের দরদী কলমে--‘পড়াশুনা না করলে কিংবা কম বয়সে বিয়ে করলেও মেয়েটা বেঁচে
যাবে।কিন্তু এই ঘরে থাকলে ওর মরণ নিশ্চিত।' এ আকুতি শুধু শ্যামলীর নয়, ভ্রষ্ট
সমাজের আরও অসংখ্য মায়ের আকুতি হয়ে ওঠে চোখের পলকে।
‘ঈশ্বরের উঠোন
ছুঁয়ে' গল্পটিতে ফুটে উঠেছে এক ব্যস্ততম রাজনৈতিক নেতার অন্তর্জগতের
ক্লান্তি,অবসাদ, বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং মাটির কাছাকাছি সাধারণ কিছু
মাটির মানুষের ভালবাসা,আন্তরিকতার অনন্য অনুভূতি।তাই অলকেন্দু বুঝতে পারেন---এতদিন
সে বহু মানুষ দেখেছে।কিন্তু আজ তার প্রকৃত ঈশ্বর দর্শন হয়েছে।'
‘ঈশ্বর ও
আয়না' গল্প ছুঁয়ে যায় মনস্তত্ত্বের এক আশ্চর্য বোধের স্তর যা গড়ে ওঠে লেখক -পাঠক
সম্পর্কের বন্ধনে। অনুভূতি আর আবেগের রেখায় আঁকা এই সম্পর্ক যেন ঈশ্বরের নিজস্ব
আয়না।
‘শাপমোচনের
গল্প' যেন বোধের উৎকর্ষতার সেই চূড়ান্ত বিন্দুটিকে স্পর্শ করে যেখানে লেখক পিতার
সৃষ্টিসত্তাকে অবজ্ঞা,অবহেলার অভিশাপ ছেলের জীবনে সন্তানহীনতার অক্ষমতা রূপে প্রকট
হয়ে ওঠে।
এইভাবে একটার
পর একটা গল্পে গল্পকারের কলমে সম্পর্কের পারস্পারিক টানাপোড়েনের মাধ্যমে এক এক করে
উন্মোচিত হতে থাকে মানবমনের জটিল,গহীন স্তরগুলি যা পাঠককে দাঁড় করিয়ে দেয় আয়নার
সামনে পরিপূর্ণ নগ্নতায়।মানুষ তে ভগবান নয়।তার ভেতর আছে আলো-ছায়ার খেলা,আছে
শুভ-অশুভের নিরন্তর দ্বন্দ্ধ।সেই দ্বন্ধের আলো আঁধারি ছবি দিয়ে সাজানো গল্পগুলির
মূল সুরটি কিন্তু মানবতার তারে বাঁধা--যে তারের কম্পনে কম্পনে হৃদয় থেকে হৃদয়ে
ছড়িয়ে পড়ে মানুষকে ভালবাসার এক অনন্য অনুভূতি।ঘন ছায়ার কালো চাদর সরিয়ে নতুন দিনের
আশার আলোয় উত্তরণের গল্প শোনান জীবনবাদী গল্পকার সৌরভ। এখানেই সার্থক আলো ছায়ার
অন্দরমহলের গোপন কাহিনী।
"আলোছায়ার অন্দরমহল"
প্রকাশক---কবিতিকা।
প্রকাশক---কবিতিকা।
No comments:
Post a Comment