Friday, June 10, 2022

বর্ষা : জীবন ও সাহিত্যে

 বর্ষা : জীবন ও সাহিত্যে

সৌরভকুমার ভূঞ্যা

 

সভ্যতার খড়্গ হাতে মানব দানব

শ্যামল সবুজ বুকে রক্তের ছোপ।

নিষ্ঠুর উদাসীনতায় নীরব অশ্রুপাত,

কে আর খেয়াল রাখে যন্ত্রণা আপশোশ!

তাই তো মেঘের বুকে জাগে অভিমান,

গ্রীষ্মের চোখে ঝরে অনল অভিশাপ।

হাহাকার জেগে ওঠে প্রকৃতির বুকে

প্রেমিক মেঘের কাছে আকুল হৃদয়,

না হয় বাসলে ভালো অনন্ত আকাশ

শুধু, অভিমানটুকু দাও অশ্রু উপহার।

 

গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে যখন বিধ্বস্ত জীবন, ওষ্ঠাগত প্রাণ, তখন একটু বৃষ্টির প্রত্যাশায় আকাশের বুকে মেঘের খোঁজে ব্যাকুল হয়ে ওঠে মন। কখনও কখনও কালবৈশাখীর হাত ধরে মেঘ আসে। বিস্তীর্ণ কালো সামিয়ানায় ঢেকে ফেলে গোটা আকাশ। প্রকৃতির গুমোট অভিমান ভাঙাতে আকাশের বুক থেকে বৃষ্টি হয়ে নেমে আসে মেঘ। সবুজের সমারোহে হেসে ওঠে প্রকৃতি। রিক্ত হৃদয়ে স্থান করে নেয় স্নিগ্ধ শীতলতা। কিন্তু সে শীতলতা ক্ষণিকেরকালবৈশাখীর ক্ষণিক বৃষ্টি প্রকৃতিকে সাময়িক শান্তি দেয় কিন্তু তার আকাঙ্ক্ষাকে পূর্ণতা দিতে পারে না। কালবৈশাখী মেঘের কতটুকুই বা শক্তি যে প্রকৃতির বিস্তৃত হৃদয়কে শান্তি ও স্নিগ্ধতায় পরিপূর্ণ করতে পারে! আর আজকাল, দূষণ নামক দানবের কবলে পড়ে কালবৈশাখীও অনেকটাই তার গরিমা হারিয়েছে। আকাশ ঢেকে ফেলা ঘন কালো মেঘ, দানবীয় ঝড় এখন আর তেমন দেখা যায় না। তাই প্রতীক্ষার প্রহর গোনা, কখন আকাশের বুক দখল করে নেবে মেঘবালিকার দল, প্রকৃতির বুকে ঝরঝরিয়ে নেমে আাসবে বৃষ্টি, যে বৃষ্টিধারার স্রোত-মূর্ছনায় জেগে উঠবে সৃষ্টির আগমনী সুর, জীবনের বেঁচে থাকার আনন্দগান আর হৃদয়ের প্রেম-বিরহের আদ্ভুত আবেগ। আর এসবকিছুই মিলিয়ে বর্ষা আমাদের কাছে হাজির হয় এক প্রেমময়ী নারী রূপে, যে নারীর কাছে আমরা খুঁজে ফিরি ভালোবাসার আশ্রয়।

    বর্ষা মানেই এক মন ভালো করা ঋতু। মেঘের গর্জন, বিদ্যুতের ঝলকানি, আকাশ ঢেকে ফেলা ঘন কালো মেঘ, তার বুক চিরে নেমে আসা রূপোলি বৃষ্টিধারা আর প্রকৃতির বুকে সবুজের প্লাবন—সত্যিই বর্ষার রূপের কোনো তুলনাই হয় নামেঘ-বৃষ্টির বর্ণনার অসাধারণ ছবি ফুটে উঠেছে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নববর্ষা’ কবিতায়---গুরু গুরু মেঘ, গুমরি গুমরি/গরজে গগনে গগনে, গরজে গগনে।/ধেয়ে চলে আসে বাদলের ধারা,/নবীন ধান্য দুলে দুলে সারা,/কুলায়ে কাঁপিছে কাতর কপোত,/দাদুরি ডাকিছে সঘনে/গুরু গুরু মেঘ, গুমরি গুমরি/গরজে গগনে গগনেবর্ষা সৃষ্টির ঋতুমাত্র নয়, স্নিগ্ধ সৌন্দর্যের ঋতু, বর্ষা প্রেমের ঋতু, ভালোবাসার ঋতু, নিজের মধ্যে নিজেকে খোঁজার ঋতু। ঋতুর রাজা বসন্ত কিন্তু প্রেম-বিরহের আবেগময়তায় বর্ষা আমাদের মনে অনেক বেশি করে স্থান করে নেয়। শুধু তাই নয়, বর্ষা আমাদের স্মৃতিমেদুর করে, ফিরিয়ে নিয়ে যায় শৈশব-কৈশোরের সেইসব ভালোলাগার দিনগুলিতে যখন আকাশে মেঘ দেখলে উদ্বেলিত শিশুমন ছড়া কেটে বলে উঠত—আয় বৃষ্টি ঝেঁপে/ধান দেব মেপে।আবার অবিরাম বৃষ্টিতে যখন মন খারাপ হয়ে যেত তখন ছড়া কেটে বলত---“লেবু পাতা,/করমচা যা বৃষ্টি চলে যা ভারী বর্ষায় বাড়ির উঠোন যখন হয়ে উঠত ছোট্ট নদী তখন কাগজের নৌকা তৈরি করে সেখানে ভাসানোর যে অদ্ভুত আনন্দময় অনুভূতি, সে স্মৃতি হৃদয়ে গাঁথা হয়ে থাকে আমৃত্যু। বর্ষায় ভিজতে ভিজতে খেলার মাঠে ফুটবল নিয়ে দাপাদাপি কিংবা জল-ভরা মাঠে উচ্ছল দাপাদাপি—এতো আাজও গ্রামের বুকের পরিচিত দৃশ্য। আর কৈশোরের দিনগুলিতে, মনের মধ্যে যখন সবে একটু একটু করে উঁকি মারতে শুরু করেছে প্রেম-মুকুল আর ভালোলাগাবোধের রহস্যময় অনুভূতি, ঠিক সেসময় কোনো এক বর্ষণমুখর পড়ন্ত বিকেলে ভালোবাসার কিশোরীর বৃষ্টি-স্নাত সৌন্দর্য্য লুকিয়ে আবলোকন করার যে আনন্দ-সুখ, তার মতো স্বর্গীয় অনুভূতি জীবনে খুব কমই আসে। এভাবেই বর্ষা আমাদের জীবনের পাতায় পাতায় বিছিয়ে রাখে মাধুর্য্যমাখা স্মৃতি, যা আমাদের জীবনের আঁকাবাঁকা বন্ধুর পথচলায় মাঝে মাঝে দিয়ে যায় এক অদ্ভুত সুখের ছোঁওয়া।

    বর্ষা আমাদের জীবনের সঙ্গে ওতোপ্রোতো ভাবে জড়িয়ে। বর্ষার সঙ্গে সৃষ্টির নিবিড় সম্পর্ক। আকাশের বুকে মেঘের আনাগোনা ঘটলে কৃষকের মন আনন্দে নেচে ওঠে লাঙল-বলদের দিন আজ আর প্রায় নেই। অঝোর বৃষ্টিধারার নীচে তালপাতার টুপি কিংবা পেখিয়া মাথায় দিয়ে বলদ দিয়ে লাঙল করার সেই অসাধারণ গ্রাম্য ছবি আজ কেবল বিবর্ণই নয় প্রায় নিশ্চিহ্ন বল যেতে পারে। বলদের জায়গায় স্থান করে নিয়েছে যন্ত্র। তবে বাকি দৃশ্যগুলোর খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। কৃষাণ-কৃষাণীর মাঠে বীজ বোনা, চারা রোপন, মাঠের আলে বসে কর্দমাক্ত কৃষকের দুপুরের আহার সারা, তারপর পড়ন্ত বিকেলে ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফেরা প্রভৃতি দৃশ্যগুলোকে এখনও গ্রাস করে নিতে পারেনি আধুনিক সভ্যতার যন্ত্র-দানব। যাই হোক, বর্ষার স্পর্শে কচি ধানের চারা অতি অল্পদিনে তাদের শরীরের হলুদ অলস পাতা খসিয়ে সেজে ওঠে সবুজের পোশাকে। মাঠ-ভরা থই থই জলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আকাশের পানে মেলে ধরে তাদের সবুজ প্রাণোচ্ছল উপস্থিতি। সমুদ্র-সদৃশ বিস্তীর্ণ রূপোলী জলের আস্তরণ ঢেকে যায় সবুজের সমারোহে। যে সবুজের মধ্যে নিহিত থাকে বেঁচে থাকার রসদ। বর্ষা সৃষ্টির ঋতু। কৃষকের ঘরে লক্ষ্মীর আগমনের পথ প্রস্তুত করে সে। এতো গেল এক দিক। প্রকৃতি-প্রেমের অফুরাণ তৃপ্তির রসদ যুগিয়ে যায় বর্ষা-স্নাত প্রকৃতি—সবুজ মাঠ, নব সাজে সজ্জিত তরুলতা কিংবা জলে টইটুম্বুর নদী-স্রোত। বর্ষা কখনো আবার দুঃসহ যন্ত্রণা নিয়ে আসে মানুষের জীবনে। বর্ষার রুদ্র মূর্তি দেখে শিউরে উঠে হৃদয়। তবুও বর্ষাকে দূরছাই করে না কেউ। তা করলে যে নিজেদেরই ক্ষতি। বর্ষা ছাড়া আমাদের বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। প্রকৃতির খামখেয়ালীপনায় বর্ষা যখন মাঝে মাঝে পথ ভুলে যায়, গরিব কৃষকের মনে তখন বেজে ওঠে সেই বিখ্যাত গানের সুর—আল্লা মেঘ দে পানি দে।’

    আমাদের নদীমার্তৃক দেশের একটি বৃহৎ অংশের মানুষের জীবন-জীবিকা নির্বাহিত হয় নদীকে কেন্দ্র করে। এই সম্প্রদায়ের নাম হল ধীবর বা জেলে সম্প্রদায়। বর্ষায় উত্তাল নদী-সমুদ্রের বুকে জীবনকে বাজি রেখে তারা জীবনের রসদ খোঁজে। প্রতি পদে পদে থাকে মৃত্যুর হাতছানি। তবুও বর্ষা তাদের কাছে অভিশাপ নয়, আশীর্বাদ। জাল আর জলের সঙ্গে যাদের জীবনের সুর বাঁধা, তাদের কাছে বর্ষা কেবল ঋতু নয়, তাদের কাছে মাতৃসমা। যার স্নেহাশিষ মাথায় নিয়ে তারা আকুল দরিয়ায় পাড়ি দেয়, প্রকৃতির সঙ্গে জীবনের মেলবন্ধন ঘটায়। জেলেদের জীবনে বর্ষার ভূমিকা আর গুরুত্বের কথা বিভিন্ন সাহিত্যিকদের লেখায় সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। এই প্রসঙ্গে তিনটি বিখ্যাত উপন্যাসের নাম করা যেতে যায়—মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’, অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ এবং সমরেশ বসুর ‘গঙ্গা’।

    ‘তিতাস একিট নদীর নাম’ উপন্যাসের প্রায় শেষদিকে আমরা দেখতে পাই, তিতাসের বুকে চর বাড়তে বাড়তে তিতাস হয়ে গেছে শীর্ণকায়া। তখন আসহায় মালোরা গভীর প্রত্যাশায় দিন গুনতে থাকে কখন আসবে বর্ষা, যার বারি সিঞ্চনে তিতাস ফিরে পাবে তার যৌবন, তার বুকে পাওয়া যাবে বাঁচার রসদ। ‘পদ্মা নদীর মাঝিতে মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায় বর্ষার সুন্দর বর্ণনা করেছেন বেশ কয়েকবারহোসেন মি়ঞ্যাকে নিয়ে কুবেরের নিজের বাড়ি ফেরার সময়কার মেঘলা আকাশের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে এইভাবে—আকাশ নিবিড় মেঘে ঢাকিয়া গিয়াছে। দুর্ভেদ্য অন্ধকারে জেলেপাড়ার পথ পায়ের তলেও হইয়া আছে অদৃশ্য। অত্যন্ত সন্তর্পনে পা ফেলিয়া আগাইতে হয়। দীর্ঘ্যকালের পরিচয় না থাকিলে বাড়ির আনাচ-কানাচ দিয়া আঁকাবাঁকা পথ তারা খুঁজিয়া পাইত না। কুবেরের বাড়ির কাছাকাছি আসিয়া আকাশের জমানো মেঘ হঠাৎ গলিয়া যাওয়ায় চোখের পলকে তাহারা ভিজিয়া উঠিল।’ তারপর কুবের বাড়ি ফেরার পর যখন বৃষ্টি নামে তখন কীভাবে তা বিপর্যস্ত করে গরিব কুবেরের কুটির সে বর্ণনা লেখক দিয়েছেন এইভাবে—রাত্রি বাড়তে থাকে, বৃষ্টি ধরিবার কোনো লক্ষ্মণ দেখা যায় না, পিসী ঢেঁকি ঘরে গিয়া বাঁক বন্ধ করিয়া শুইয়া পড়ে।............. বাহিরে চলতে থাকে অবিরাম বর্ষণ। কিছুক্ষণ বৃষ্টি হইবার পর ঘরের ফুটা কোন দিয়া ভিতরে জল পড়িতে আরম্ভ করিয়াছিল।’ সমরেশ বসুর বিখ্যাত উপন্যাস গঙ্গা’তেও মেঘ-বৃষ্টির সুন্দর বর্ণনা আছে একাধিকবার—দুদিন ধরে মহিষকালো আকাশে কেবল বিদ্যুতের ঘটা গেল। বৃষ্টি হল ফিসফিস করে। তারপর মহিষগুলো দাপাদাপি করল। বৃষ্টি এল মুষলধারে। মেঘ নামল গড়িয়ে গড়িয়ে, জড়িয়ে ধরতে আসছে যেন গোটা গঙ্গার বুকখানি। বাজ পড়ল হুঙ্কার দিয়ে। পূবসাগরে রুদ্র ঝড় শুরু হল হঠাৎ।’ এভাবেই সাহিত্যিকরা তাদের শব্দ-কল্পনার মেলবন্ধনে বারেবারে মেঘ-বৃষ্টির সুন্দর ছবি এঁকেছেন।

    বর্ষা আমাদের সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। আমাদের কাব্যসাহিত্য কিংবা গানে দেখা যায় বর্ষার উজ্জ্বল উপিস্থিত। কবি-সাহিত্যিকদের কলমে বার বার উঠে আসে বর্ষা-বন্দনা। বর্ষা এলে উচাটন মন চায় ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে, মেঘের ডানায় চেপে দূরে কোথাও হারিয়ে যেতেকবির ভাষায়—

        মন মোর মেঘের সঙ্গী,

        উড়ে চলে দিগ্ দিগন্তের পানে

        নিঃসীম শূন্যে শ্রাবণবর্ষণসঙ্গীতে

        রিমিঝিম রিমিঝিম রিমিঝিম

কিন্তু শ্রাবণের প্রকৃতি সবসময় সুখকর হয় না। নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে কখনো কখনো লুকিয়ে থাকে অজানা বিপদের গন্ধ। তাই বর্ষা এলে বাইরে বেরিয়ে পড়াটা সবসময় ঠিক হয় না। বৃষ্টি এলে বাড়ির বড়োদের দেখা যায় ছোটোদের নিষেধ করতে যাতে তারা বাড়ির বাইরে না যায়। কবিও সেই কথা বলেন—

        ‘নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে       তিল ঠাঁই আর নাহি রে

        ওগো আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে।

বাদলের ধারা ঝরে ঝরো-ঝরো,  

আউষের ক্ষেত জলে ভরো-ভরো,

কালিমাখা মেঘে ও পারে আঁধার ঘনিয়েছে দেখ্‌ চাহি রে॥’

বর্ষায় মন উচাটন হয়। অদ্ভুত এক আবেগ নাড়া দিয়ে যায় মন। প্রেমিক-প্রেমিকার মন উদাসী হয়। কেবলি ইচ্ছে করে বর্ষার সুর-ছন্দে প্রেম-ধারায় স্নাত হতে। অন্য কোনো কাজে মন লাগে না। অদ্ভুত এক আলসেমি গ্রাস করে মন। প্রেমিক হৃদয়ের সেই অনুভূতির সুন্দরভাবে প্রকাশ হয়েছে কবির লেখনীতে—

        ‘আজিঝরো ঝরো মুখর বাদল দিনে

        জানিনে, জানিনে কিছুতে কেন যে মন লাগে না।’

সত্যি, বর্ষা এলে প্রেমিক মনে কাজ করার ইচ্ছেটাই যেন হারিয়ে যায়। বার বার তার মনের মধ্যে ভেসে ওঠে প্রেয়সীর মুখ। মনের গোপন স্থানে অত্যন্ত সযত্নে লালিত না-বলা কথাটি যেন হৃদয়ের রুদ্ধ দুয়ার খুলে বেরিয়ে আসতে চায়। আসলে হৃদয়ের কথা বলার জন্য বর্ষার থেকে আর ভালো কী হতে পারে। কবিগুরুর ভাষায়—

        ‘এমন দিনে তারে বলা যায়,

        এমন ঘন ঘোর বরিষায়।

        এমন দিনে মন খোলা যায়—

        এমন মেঘস্বরে বাদল-ঝরোঝরে

        তপনহীন ঘন তমসায়।’

কিন্তু যাকে মনের কথা বলবে, সেই মনের মানুষটি যদি নীরব থাকে তাহলে প্রেমিক মন অস্থির হয়ে পড়ে। আকাশে মেঘ যেমন বৃষ্টির বার্তা নিয়ে আসে, তেমনি প্রেমিক মনেও নিয়ে আসে প্রেমের সুর। একলা ঘরে বসে সে প্রতীক্ষা করে কখন আসবে সেই মহেন্দ্রক্ষণ। তার মনের কোণে গুঞ্জরিয়া ওঠে সেই সুর—

        এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকে না তো মন

        কাছে যাবো কবে পাবো বলো তোমার আমন্ত্রণ?’

বর্ষা যেন প্রেমের প্রতীক কিংবা প্রেমের অনুঘটক। বর্ষার আগমনে তাই হৃদয় চঞ্চল হয়, মনের মধ্যে আকুতি জন্মায় একে অন্যকে কাছে পাওয়ার। কোনোকিছুই তার মনকে সুস্থির করতে পারে না। প্রেমের জন্য, প্রেয়সীর জন্য সে যেন অনেকটা পাগল হয়ে ওঠে। প্রেমিক-হৃদয়ের সেই আকুলতা আমরা দেখতে পাই বিখ্যাত সেই গানে—

        আষাঢ় শ্রাবণ, মানে নাতো মন,

        ঝর ঝর ঝর ঝর ঝরিছে

        তোমাকে আমার মনে পড়েছে।’

শুধুমাত্র প্রিয়তম কিংবা প্রিয়তমার মুখ মনে পড়ার মধ্যে সবসময় হৃদয় শান্ত হয় না। প্রেম-কাতর দুটি হৃদয় পরস্পরের কাছাকাছি হতে চায়। যুগ যুগ ধরে আমরা দেখে আসছি কবি-সাহিত্যিকরা বর্ষার সঙ্গে অভিসারের সুন্দর ছবি এঁকেছেন। চর্যাপদ থেকে শুরু করে বর্তমান সাহিত্য—কোথাও এর ব্যতিক্রম নেই। চন্ডীদাসের কয়েকটি লাইনে এই আভিসারের ছবি সুন্দরভাবে ব্যক্ত হয়েছে—

        এ ঘোর রজনী মেঘের ঘটা

        কেমনে আইলা বাটে

        আঙ্গিনার মাঝে বধূয়া ভিজিছে

        দেখিয়া পরাণ ফাটে।’

বর্ষা যেমন হৃদয়কে আলোড়িত করে একে-অন্যের মুখোমুখি হওয়ার, তেমনি অনেক সময় আমরা দেখতে পাই বর্ষার তীব্র বারিধারা দুটি হৃদয়ের মিলনের মাঝে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। তখন অভিসারী মন বৃষ্টি দেখে একটু শিউরে ওঠে। মনে মনে সে বলতে থাকে—

        ‘ওগো বর্ষা তুমি ঝোরো নাকো এমন জোরে

        কাছে সে আসতে নাহি পারে

        এলে না হয় ঝোরো তুমি প্রবল জোরে।’

বর্ষার সঙ্গে প্রেম-বিরহের এই নিবিড় সংযোগের ছবি অতি পুরাতন। সাহিত্যের পাতায় চোখ রাখলে আমরা দেখতে পাবো সেই চর্যাপদের যুগ থেকে কবি-সাহিত্যিকরা বর্ষা-বন্দনা করে আসছেন চর্যাপদের কবি বিদ্যাপতির কবিতায় ফুটে ওঠে বিরহী সুর—

        ‘সখি হামারি দুঃখের নাহি ওর

        এ-ভরা বাদর মহা ভাদর

        শূন্য মন্দির মোর।’

বর্ষা আর প্রেমের কথা এলে অবশ্যই করে বলতে রাধার প্রেমের কথা। বর্ষা সঙ্গে রাধার বিরহের সম্পর্ক। আকাশের বৃষ্টি রাধিকার চোখের জল হয়ে ঝরে পড়ে। বর্ষা তার মনের মধ্যেকার প্রেম, কামণা, বাসনাকে আরও গভীরভাবে জাগিয়ে দেয়। বিদ্যাপতির কবিতায় সেই ছবি ফুটে উঠেছে---

    তিমির দিগভরি ঘোর যামিনী

    অথির বিজুরিক পাতিয়া

    মত্ত দাদুরি, ডাকিছে ডাহুকী

    ফাটি যাওত ছাতিয়া।

বর্ষা এলে রাধা কৃষ্ণকে কাছে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। কৃষ্ণকে কাছে না পাওয়ার বেদনা তার বিরহ-যন্ত্রণাকে বাড়িয়ে দেয়। সেই বিরহ-যন্ত্রণার ছবি সুন্রভাবে ফুটে উঠেছে বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে---

    আষাঢ় শ্রাবণ মাসে মেঘ বরিষে যেহ্ন

    ঝর-এ নয়নের পানী

    আল বড়ায়ি।

    সংপুটে প্রণাম করি

    বুইলো সব সখিজন

    কহো নান্দো কাহ্নাঞিকে আনী।

মেঘ-বৃষ্টি নিয়েমহাকবি কালিদাসের অসামান্য সৃষ্টি মেঘদূত।’ নিজের কাজে আবহেলা করার জন্য কুবের যক্ষকে অভিশাপ দেয়। যে অভিশাপের কারণে যক্ষকে কাটাতে হয় রামগিরিতে। এক বৎসর কাল সে দেখতে পায় না তার প্রিয়তমাকে। প্রিয়া অদর্শনে যক্ষের হৃদয় ব্যাকুল হয়ে ওঠে। বিশেষ করে যখন আষাঢ় মাস আসে, আকাশের বুকে মেঘের ভেলা দেখা যায়, তখন তার বিরহী হৃদয় যেন আরও বেশি করে চঞ্চল হয়ে ওঠে। বিরহের শোক তার মধ্যে প্রবল হয়। কালিদাসের লেখায় এক জায়গায় রয়েছে—

        ‘পাশে প্রিয়তমা,-মেঘ দরশনে

        আকুল-ব্যাকুল তবুও হৃদয়,

        প্রিয়া যার দূরে তার পোড়া মনে

        কি অনল জ্বলে, বলিতে কি হয়?’ (অনুবাদ-অক্ষয়চন্দ্র পালিত)

প্রিয়া অদর্শনে বিপর্যস্ত যক্ষ মেঘকে দেখে স্থির করেন তার হাত দিয়ে সে তার প্রেয়সীর কাছে বার্তা পাঠাবেযক্ষের সেই ভাবনা কালিদাস ব্যক্ত করেছেন এইভাবে—

        আসিল বরষা’’ ভাবিয়া অন্তরে

        বাঁচাইতে নিজ দয়িতা-জীবন,

        স্বকুশল-বার্তা জলধর-করে

        পাঠাইতে যক্ষ করিল মনন!

        অভিনব গিরি-মল্লিকা তুলিয়া

        দিল অর্ঘ্য মেঘে পরম আদরে,

        প্রীত মনে প্রীতি-বচন কহিয়া

        তাহায় স্বাগত-সম্ভাষণ করে।।’(অনুবাদ-অক্ষয়চন্দ্র পালিত)

এরপর রয়েছে সেই বিখ্যাত শ্লোক, যেখানে কালিদাস দেখিয়েছেন যক্ষ কীভাবে মেঘের হাত দিয়ে তার প্রেয়সীর কাছে বার্তা পাঠাচ্ছে—

        ‘তাপিত জনের তুমি হে শরণ;

        কুবেরের কোপে এ বিরহ হায়!

        আমার বারতা করিয়া বহন

        প্রিয়া-পাশে তুমি যাও অলকায়।

        সেই অলকার চারু-উপবনে

        চিরসুখে বাস করেন শঙ্কর,

        তাঁর শিরস্থিত শশির কিরণে

        সুধা-ধবলিত প্রাসকাদিনকর।(অনুবাদ-অক্ষয়চন্দ্র পালিত)

বর্ষা শুধু হৃদয় বা মনে নয়, শরীরেও আলোড়ন তোলে। প্রেমিক-প্রেমিকা কিংবা নর-নারী একে-অপরকে পেতে চায় নিবিড় বাহু-বন্ধনে, শরীরী-সুখের স্বর্গীয় আলিঙ্গনে। ভালোবাসার সঙ্গে শরীরেরও একটা নিবিড় সম্পর্ক আছে। শরীরের চাহিদা এড়িয়ে রাখা যায় না, বিশেষ করে বর্ষায়। নারী-পুরুষের সেই নিবিড় সম্পর্কের কথা কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত সুন্দরভাবে ব্যক্ত করেছেন তাঁর ‘বর্ষাকাল’ কবিতায়—

        গভীর গর্জন করে সদা জলধর

        উথলিল নদ-নদী ধরনীর উপর

        রমনী রমণ লয়ে

        সুখে কেলি করে

        দানবাদি দেব যক্ষ সুখিত অন্দরে।’

বাংলা সাহিত্যের আলোচনায় আমরা দেখতে পাবো বিখ্যাত সকল কবি-সাহিত্যিক বর্ষার বন্দনা করেছেন। যেমন পল্লীকবি জসীমউদ্দিন তার ‘পল্লীবর্ষা’ কবিতায় লিখেছেন—

        ‘বাদলের জলে নাহিয়া সে মেয়ে হেসে কুটি কুটি হয়

        সে হাসি তাহার অধর নিঙারি লুটাইছে বনময়

        ...... ... .... .... ....

        আজিকে বাহিরে শুধু ক্রন্দন ছলছল জল ধারে

        বেনুবনে বায়ু নাড়ে এলোকেশ, মন যেন কারে চায়।’

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় ফুটে উঠে বিরহের সুর—

        বাদল রাতের পাখী

        উড়ে চল যেথা আজো ঝরে জল, নাহিক ফুলের ফাঁকি।’

এভাবে অমিয় চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব বসু, রোমান্টিক কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় থেকে শুরু করে বর্তমান প্রজন্মের কবিরাও বর্ষাকে নিয়ে সুন্দর সুন্দর কাব্য সৃষ্টি করেছেন।

    বর্ষার সঙ্গে গানের এক নিবিড় সম্পর্ক। ইতিমধ্যে দু-একটি গানের কথা বলা হয়েছে। আর দু-একটি গানের উল্ল্যখ না করলে নয়। প্রেমের আকুলতা, বিরহ আর মিলনের অসম্ভব সুন্দর ছবি বারে বারে উঠে এসেছে বর্ষা নিয়ে রচিত গানে। প্রিয়তমের জন্য দীর্ঘ্যদিনের প্রতীক্ষায় থাকা প্রেয়সীর চোখের জল নামে বর্ষার মতো। কিন্তু প্রিয়তম আসে না। আকাশের বুকে যখন মেঘের আনাগোনা, প্রকৃতির বুকে যখন বর্ষার আগমণী সংকেত, তখন প্রেমিকার হৃদয় অস্থির হয়ে ওঠে। সে চায় না বৃষ্টির জলে হারিয়ে যাক তার চোখের জলের দাগ। তাহলে প্রেমিক এলে বুঝতে পারবে না, কতখানি গভীর আকুলতা নিয়ে সে তার পথ চেয়ে কাটিয়েছে। তার প্রেমিক আসবে কিনা সে জানে না। কিন্তু তার বিশ্বাস, বর্ষা যেমন তার মনে আকুলতা জাগিয়েছে, তার প্রাণের মানুষও নিশ্চয়ই একইভাবে উদ্বেলিত হবে। তার মনের গহনে নিশ্চয়ই নাড়া দেবে তার স্মৃতি। নিশ্চয়ই সে ফিরে আসবে তার কাছে। আর যদি সে ফিরে আসে তখন যেন সে দেখতে পায় প্রিয়তমের অদর্শনে তার হৃদয় কীভাবে বর্ষণ-সিক্ত হয়েছে। অন্তরের বৃষ্টি-ছবি বাঁচিয়ে রাখতে বাইরের বৃষ্টির কাছে তাই সে গভীর আকুতি জানায়—

        ওগো বৃষ্টি আমার চোখের পাতা ছুঁয়ো না

        আমার এত সাধের কান্নার দাগ ধুয়ো না

        সে যেন এসেই দেখে

        পথ চেয়ে তার কেমন করে কেঁদেছি।’

বর্ষা প্রেমিক মনকে স্মৃতিমেদুর করে। মনের মধ্যে ভেসে ওঠে বর্ষার পরশমাখা অতীতের মধুর ছবি। বর্ষার সময় যদি প্রাণের মানুষ কাছে থাকে তখন সেই বৃষ্টির মধ্যে থাকে রোমাঞ্চকর ভালোলাগার অনুভূতি। কিন্তু যখন প্রাণের মানুষ জীবন থেকে হারিয়ে যায় তখন চেনা বর্ষাও যেন কেমন বদলে যায়। যে বৃষ্টিধারায় একসময় থাকতো প্রেমের মধুর পরশ, প্রিয়া বিহনে মনে হয় প্রকৃতির নিয়মে নয়, বিরহের যন্ত্রণা আর হৃদয়ের কান্নাই যেন বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে। বর্ষার সেই নস্টালজিক অনুভূতি সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে এই গানে—

        ‘এমনি বরষা ছিল সেদিন

        শিয়রে প্রদীপ ছিল মলিন

        তব হাতে ছিল অলস বীন

        মনে কি পড়ে প্রিয়?

        ...... ... ...

        হায় তুমি নাই বলে মোর সাথে

        তাই কি বিরহ বরষাতে

        এত বারিধারা আজ রাতে

        অঝোরে ঝরে প্রিয়?’

সংক্ষেপে বলার, আমাদের জীবন ও সাহিত্যের সঙ্গে অঙ্গাগীভাবে জড়িয়ে আছে বর্ষা। বর্ষা ছাড়া যেমন জীবন সম্ভব নয়, তেমনি বর্ষা ছাড়া সাহিত্যও অনেকটা ফিকে হয়ে যায়। তবে এখন বর্ষা তার আগের গরিমা অনেকটাই বোধহয় হারিয়ে ফেলেছেযন্ত্র-দানবের মাতামাতি, মানুষের লালসা আর অসচেতনতায় প্রকৃতি হারিয়ে ফেলেছ তার স্বাভাবিক ছন্দ, ঋতু হারিয়েছে রূপ, বৃষ্টি হয়ে গেছে খামখেয়ালি। বাড়ির উঠোনকে গ্রাস করেছে নিষ্ঠুর লোভ আর স্বার্থপরতা। বৃষ্টিধারা এসে আর সেখানে নদী হয়ে উঠতে পারে না। কাগজের নৌকোও আজ খুব দুর্লভ হয়ে গেছে। হাতের কুশলী ভাঁজে কীভাবে একটা কাগজের পাতা নৌকো হয়ে ওঠে, আজকের অনেক শিশু সে কৌশল জানে না। তাছাড়া কাগজ দিয়ে নৌকো বানানোর সময় তাদের কোথায়! প্রতিযোগিতার ইঁদুর দৌড়ে শিশুরা হারিয়ে ফেলছে শৈশব। পাশাপাশি বিনোদনের বহুবিধ যান্ত্রিক মাধ্যমের সহজলভ্যতা ও চটকদারিতা তাদেরকে বর্ষার মধ্যে আনন্দ খোঁজায় প্ররোচিত করে না। এতো গেল শিশুদের কথা। আজকের প্রেমিক-প্রেমিকাদের কাছে প্রেমের আকাঙ্ক্ষা জিনিসটা আগের সেই মাধুর্যতা নিয়ে আসতে পারে না। যোগাযোগের বহুবিধ যান্ত্রিক সহজ মাধ্যম এখন আর তাদের প্রতীক্ষাকে আবেগ-মথিত করতে পারে না। পাশাপাশি আরও নানাবিধ কারণ রয়েছে, যার ফলে বর্ষা প্রেমিক-প্রেমিকার মনকে আগের মতো উদ্বেলিত করতে পারে না। বর্তমানের অতি যান্ত্রিকতার যুগে তাদের মনে আবেগটাও যেন অনেকটাই হিসেবি হয়ে গেছে। তাই বর্ষা নিয়ে তাদের মধ্যে সেই আবেগ দেখা যায় না হয়তো। তবে এটাও ঠিক বর্ষাকে পুরোপুরি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। বর্ষা হয়তো প্রেম-বিরহ-যন্ত্রণায় তার আগের গরিমা হারিয়েছে, কিন্তু একেবারে নিষ্চিহ্ন হয়ে যায়নি তার রূপ। তাইতো, আজও বর্ষাকে নিয়ে গান-কবিতা সৃষ্টি হয়ে চলেছে। এখনও বর্ষার সময় একাকী হৃদয় বর্ষার গানে আপন মনে গুনগুনিয়ে ওঠে।

    সব শেষে বলি, যন্ত্র হয়তো বর্ষায় গরিমায় ভাগ বসিয়েছে, কিন্তু তাকে পুরোপুরি হারিয়ে দিতে পারেনি। আগামী সময়েও তা পারবে না। প্রকৃতি যতই খামখেয়ালি হোক, বর্ষা আসবে পৃথিবীতে। তার আশীর্বাদে পৃথিবীর বুকে যেমন বয়ে চলবে সৃষ্টির প্রাচীন ধারা, তেমনি করে আমাদের জীবন-সাহিত্য-গানে সে মিশে থাকবে তার অফুরন্ত সৃষ্টির ভাণ্ডার নিয়ে।

জোহরা বেগম কাজী

 ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম মুসলমান বাঙালি চিকিৎসক

জোহরা বেগম কাজী

সৌরভকুমার ভূঞ্যা

 

বিংশ শতাব্দীর প্রায় শুরুর দিক ভারতবর্ষ তখন ইংরেজদের অধীন দেশের শিক্ষার হার তেমন উন্নত নয় ইতিমধ্যে নারী শিক্ষার সূচনা হলেও তার হার ছিল খুব খারাপ পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় অবহেলিত, বঞ্চিত নারীদের জীবন ছিল অন্ধবিশ্বাস আর কুসংস্কারে ভরা নিজস্ব স্বাধীনতা বলতে কিছু ছিল না তাদের সেই প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও কিছু কিছু মহিলা শিক্ষার আলোকে আলোকিত হয়ে কেবল ব্যতক্রমী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেননি, অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজে আলোকবর্তিকার মতো কাজ করেছেন তেমনই এক মহিলা হলেন জোহরা বেগম কাজী চিকিৎসাশাস্ত্রে আমরা যে সকল অসামান্য নারীর কথা জানি তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম ভারতীয় উপমহাদেশের তিনিই প্রথম মুসলমান বাঙালী মহিলা চিকিৎসক শুধুমাত্র চিকিৎসক হওয়া নয়, চিকিৎসাক্ষেত্রে বিশেষ করে মহিলাদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে তিনি অসামান্য অবদান রেখে গেছেন স্ত্রীরোগ এবং ধাত্রীবিদ্যায় তিনি ছিলেন কিংবদন্তী চিকিৎসক পরবর্তীকালে যিনি পরিচিত হয়েছিলেন ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল অব ঢাকা নামে

    জোহরা বেগম কাজীর জন্ম ১৯১২ খ্রিস্টাব্দের ১৫ অক্টোবর, মধ্যপ্রদেশের রাজনানগাঁওয়ে বর্তমানে এটি ছত্তিশগড়ের অন্তর্গত তাদের আদি নিবাস ছিল বাংলাদেশের মাদারিপুর জেলার কালাকিনি থানার গোপালপুর গ্রামে তাঁর বাবা ছিলেন কাজী আব্দুস সত্তার ও মা মোসাম্মদ আঞ্জুমানা নেসা আব্দুস সত্তার ছিলেন একজন চিকিৎসক ও রাজনীতিবিদ আব্দুস সত্তারের বাবা জমিরউদ্দিন ছেলেকে মৌলানা বানানোর অভিপ্রায়ে ভর্তি করে দেন ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসায় কিন্তু এখানকার পরিবেশ, পাঠদান পদ্ধতি একদম ভালোলাগেনি আব্দুস সত্তারের তাই এখান থেকে তিনি ঢাকা চলে যান এবং বাবার অমতে ভর্তি হন সদরঘাটের পগোজ স্কুলে ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে মিটফোর্ড মেডিক্যাল কলেজ থেকে তিনি এলএমএফ (Licentiate of Medical Faculty) ডিগ্রি অর্জন করেন এরপর তিনি কলকাতায় চলে আসেন ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে এখানকার কলেজ অব ফিজিসিয়ান অ্যান্ড সার্জেন থেকে সার্জনস্ অব ইন্ডিয়া ডিগ্রি অর্জন করেন যা বর্তমানের এমবিবিএস ডিগ্রির সমতুল্য একজন দক্ষ ও দরদি চিকিৎসক হিসেবে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে

    জোহরা বেগম কাজীর মা আঞ্জুমান নেসাও সাধারণ মহিলা ছিলেন না তিনি ছিলেন শেরেবাংলা একে ফজলুল হকের মাসতুতো বোন পড়াশোনার প্রতি তার বেশ আগ্রহ ছিল রায়পুর থেকে তিনি বিএ পাশ করেন তিনি একজন সমাজসেবীও ছিলেন রায়পুর পৌরসভার কমিশনার হয়েছিলেন তিনি প্রথম মহিলা হিসেবে তিনি এই পৌরসভার কমিশনার পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন

    বাবা-মায়ের ছয় ছয় সন্তানের মধ্যে জোহরা বেগম কাজী ছিলেন চতুর্থ তাঁর দাদার নাম কাজী আসরাফ মাহমুদ তিনি মাইক্রোবায়োলজিতে ডক্টরেট ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ে উদ্ভিদবিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলেন তিনি পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন প্রতিষ্ঠিত হিন্দি কবি জোহরার দুই দিদি অকালে মারা যান তাঁর ছোটোভাইয়ের নাম কাজী মোহাসাব মাহমুদ আর তাঁর ছোটোবোনের নাম শিরীন কাজী তিনিও চিকিৎসক হয়েছিলেন দিদি প্রথম হলে, তিনি ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের দ্বিতীয় মুসলমান বাঙালি চিকিৎসক

    বাবা-মায়ের দিক থেকে বাড়িতে এক সুন্দর শিক্ষার পরিবেশ পেয়েছিলেন জোহরা বেগম কাজী তাঁর বাবা উদারমনস্ক ছিলেন ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারেও তাঁর ছিল সমান নজর সেটাই জোহরা বেগম কাজীর জীবনে ছিল আশীর্বাদ স্বরূপ রায়পুরের বার্জিস মেমোরিয়াল মিশনারী স্কুলে জোহরার শিক্ষাজীবন শুরু তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী সমস্ত ক্লাসেই তিনি প্রথম হয়ে পরের ক্লাসে উঠেছেন এখানে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় সমগ্র বাইবেল মুখস্ত করে তিনি সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি আলিগড় মুসলিম মহিলা কলেজিয়েট স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাশ করেন ১৯৩১-এ আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি অ্যান্ড কলেজ থেকে আইএ পাশ করে ভর্তি হন হার্ডিঞ্জ মহিলা মেডিক্যাল কলেজে এটি তখন পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ছিল এখান থেকে তিনি ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জন করেন শুধু ডাক্তারি পাশ করা নয়, প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান লাভ করেন তিনি তাঁর এই কৃতিত্বের জন্য ব্রিটিশ ভারতের তৎকালীন ভাইসরয় টমাস ফ্রিম্যান কর্তৃক তিনি ভাইসরয় পদক লাভ করেন

    ডাক্তারি পাশ করে তিনি ইয়োথামান ওমেনস পাবলিক হাসপাতালে চিকিৎসকের কাজ শুরু করেন এখানে তিনি দশ মাস কাজ করেছিলেন এরপর তিনি বিলাসপুর সরকারি হাসপাতালে যোগ দেন পরবর্তীকালে তিনি মহাত্মা গান্ধি প্রতিষ্ঠিত সেবাগ্রামে অবৈতনিক চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেছেন প্রসঙ্গত বলার তিনি মহাত্মা গান্ধির অত্যন্ত স্নেহধন্য ছিলেন তার বাবার সঙ্গে বহু বিখ্যাত ভারতীয়র ঘনিষ্ঠতা ছিল তাঁদের মধ্যে মহাত্মা গান্ধি একজন খুব ছোটোবেলা থেকেই তিনি গান্ধিজির সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পেয়েছিলেন গান্ধিজির ছেলে রামদাস ছিলেন তাঁর দাদার বন্ধু গান্ধিজির স্ত্রী কস্তুরবা গান্ধিও তাঁকে মেয়ের মতো স্নেহ করতেন মুসলমান বলে কখনও তাদের আলাদা চোখে দেখতেন না নিজের সন্তানদের সঙ্গে একসঙ্গে বসিয়ে তাদের খাওয়াতেন ডাক্তারি ডিগ্রি লাভ করার পর গান্ধিজি তাঁকে আশীর্বাদ করে বলেছিলেন অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করে, নিজের আদর্শের প্রতি দৃঢ় সংকল্প থেকে কাজ করে যেতে বলাবাহুল্য সারাজীবন ধরে তিনি গান্ধিজির এই উপদেশ মাথায় রেখেছিলেন তাঁর বোন শিরীন কাজীও সেবাগ্রামে অবৈতনিক চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেছেন তিনিও গান্ধিজির স্নেহধন্যা ছিলেন শিরীনের বিয়ের সময় তাঁর বাবার অনুপস্থিতির কারণে গান্ধিজি কন্যাদান করেছিলেন

    ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে তাঁর বিয়ে হয় খ্যাতনামা রাজনীতিবিদ রাজুউদ্দিন ভুঁইয়ার সঙ্গে তিনি ছিলন নরসিংদী জেলার রায়পুর উপজেলার হাতিরদিয়ার জমিদারপুত্র পরবর্তীকালে তিনি সাংসদও হয়েছিলেন বিয়ের সময় জোহরা কাজীর বয়স ছিল ৩২ বছর তৎকালীন সময়ে কোনো মুসলমান মহিলার এত বেশি বয়সে বিয়ে হওয়াও এক ব্যতিক্রমী ঘটনা ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে রাজুউদ্দীন মারা যান তাদের কোনো সন্তানাদি ছিল না তবে সারাজীবনে জোহরা বেগম কাজী অনেক ছেলেমেয়েকে নিজের সন্তানের মতো করে মানুষ করেছেন স্বামীর মৃত্যুর পর তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে তিনি নরসিংদীতে হাতিরদিয়া স্কুল ও কলেজ স্থাপন করেন

    ১৯৪৭-এ দেশভাগের আগে পর্যন্ত তিনি ভারতবর্ষের বিভিন্ন হাসপাতালে ১৩ বছর কাজ করেছেন দেশভাগের পর তিনি তাঁর দাদা কাজী অশরফ মাহমুদ ও বোন শিরীন কাজীর সঙ্গে ঢাকায় চলে আসেন ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে আবাসিক চিকিৎসক হিসেবে যোগ দেন এখানে কাজে যোগ দেওয়ার পর জোহরা কাজীর জীবনে এক নতুন অধ্যায়ের শুরু হয় তিনি দেখেন এখানে ধাত্রীবিদ্যা ও স্ত্রীরোগের আলাদা কোনো বিভাগ নেই একজন মহিলা হওয়ায় তিনি বুঝতেন মহিলাদের চিকিৎসার সমস্যার কথা তখনকার মেয়েরা পুরুষ ডাক্তারের কাছে রোগ দেখাতে সঙ্কোচ বোধ করতেন তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যেত রোগ হলেও তারা চেপে যেতেন ফলে শরীরের জটিলতা যেমন বাড়ত তেমন অকালমৃত্যুর ঘটনাও ঘটত আকছার জোহরা কাজী বুঝতে পারলেন ধাত্রীবিদ্যা ও স্ত্রীরোগের আলাদা বিভাগ না হলে মেয়েদের উপযুক্ত চিকিৎসা পরিসেবা দেওয়া সম্ভব নয় তাঁরই প্রচেষ্টায় এখানে চালু হয় ধাত্রীবিদ্যা ও স্ত্রীরোগ বিভাগ পরবর্তী সময়ে মিটফোর্ড হাসপাতালেও চালু হয়

    কিন্তু শুধু এই বিভাগ চালু করলেই সমস্যা সমাধান হওয়া সম্ভব নয় কেননা শুধুমাত্র সঙ্কোচ নয়, নানাবিধ কুসংস্কারে আচ্ছন্ন মহিলারা হাসাপাতালে এসে চিকিসা গ্রহন করতে চাইত না জোহরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে মহিলাদের বোঝাতেন অসুস্থ মহিলাদের বুঝিয়ে বাসপাতালে ভর্তি করতেন নিজে নিয়মিত তাদের পরিষেবা দেওয়ার পাশাপাশি হাসপাতালের অন্যান্য ডাক্তার এবং নার্সেরা ঠিকমতো পরিষেবা দিচ্ছেন কিনা সে বিষয়ে তীক্ষ্ণ নজর রাখতেন এমনকি কখনও কখনও তিনি গভীর রাতেও হাসপাতালে গিয়ে হাজির হতেন অসুস্থদের খোঁজ নেওয়ার জন্য, তাদের ঠিকঠাক চিকিৎসা হচ্ছে কিনা সেটা দেখবার জন্য এইভাবে তিনি খুব অল্প সময়ে মানুষের অত্যন্ত প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন

    যাই হোক, ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে সরকারি বৃত্তি নিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি বিলেত যান লন্ডনের রয়েল কলেজ অব অবসটেরিসিয়ানস অ্যান্ড গাইনোকোলজিস্ট থেকে তিনি এফসিপিএস ডিগ্রি সম্পূর্ণ করেন এবং স্কলারশিপ পান এখানে তিনি তাঁর পড়াশোনা চালিয়ে যান এবং ডিআরসিওজি, এফআরসিওজি ও এমআরসিওজি ডিগ্রিও লাভ করেন প্রসঙ্গত বলার তাঁর বোন শিরীন কাজী ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে লন্ডন থেকে ডিআরসিওজি ডিগ্রি লাভ করেছিলেন এদিক থেকে শিরীন কাজী দিদিকে টেক্কা দিয়েছিলেন বলা যায় শিরীন কাজী হলেন প্রথম বাঙালী মুসলমান মহিলা যিনি লন্ডন থেকে ডাক্তারি ডিগ্রি পাওয়ার করার কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন।

    লন্ডন থেকে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করে জোহরা বেগম কাজী ঢাকায় ফিরে আসেন এবং ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের ধাত্রীবিদ্যা ও স্ত্রীরোগ বিভাগের প্রধান হিসাবে যোগদান করেন ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেন। এরপর তিনি হলি ফ্যামিলি রেডক্রস হাসপাতাল ও কমবাইন্ড মিলিটারি হাসপাতালে সিনিয়র কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ করেছেন

    জোহরা বেগম কাজী ছিলেন অত্যন্ত শৃঙ্খলাপরায়ণ ও সময়ানুবর্তী এতবড়ো একজন চিকিৎসক হয়েও খুব সাধারণ, নিরহঙ্কার জীবন কাটাতেন তিনি নিজে খুব পরিশ্রমী ছিলেন রুগীদের প্রতি যেমন তিনি যত্নশীল ছিলেন তেমনি ছাত্রছাত্রীদের ব্যাপারেও নিজের ভাবনা ও আদর্শ ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে চালিত করার চেষ্টা করতেন তিনি তাদের উপদেশ দিতেন প্রচুর পড়াশোনা করতে, নিজেদের দায়িত্ব ঠিকঠাকভাবে পালন করতে নিয়ম ভঙ্গ করলে যেমন তাদের প্রতি কঠোর হতেন আবার কেউ সাহায্য চাইলে নিজেকে উজাড় করে দিতেন ছাত্রছাত্রীদের বলতেন, “Don’t run after money, money will run after you and be sincere to your noble profession.” বহু ছেলেমেয়েকে তিনি নিজের খরচে পড়াশোনা করিয়েছেন পাশাপাশি দুঃস্থ, অসহায় মানুষদের জন্য তিনি সবসময় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন এককথায় গরিব ও পিছিয়ে পড়া মানুষদের সেবায় তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন আর এইভাবে কাজ করতে করতে একসময় তিনি ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল অব ঢাকা’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন

    সারাজীবনের কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি বেশকিছু সম্মান ও খেতাব পান যেমন তমঘা-ই-পাকিস্তান (১৯৬৪), বেগম রোকেয়া পদক (২০০৪), মরণোত্তর একুশে পদক (২০০৮), বিক্রম এ স্বর্ণপদক প্রভৃতি ২০০৭ খ্রিস্টাব্দের ৭ নভেম্বর তিনি পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে অমৃতলোকে যাত্রা করেন তিনি কিন্তু আপন কীর্তিতে তিনি চির ভাস্বর হয়ে থাকবেন আমাদের মনে