Tuesday, September 22, 2020

অনুসমাজের গলিপথ - আকাশনীল মাইতি

 অনুসমাজের গলিপথ

আকাশনীল মাইতি

 

সাহিত্য সমাজের দর্পণ এই দর্পণে শুধুমাত্র বর্তমানের নয় ভবিষ্যতেরও ছায়া এসে পড়ে সামাজিক ঘটনা পরম্পরার সামান্য নড়নচড়ন যেমন সাহিত্যের শিল্পীদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায় না তেমনি সেই লেখনী শিল্পের সার্থকতা তখনই আসে যখন তা পাঠকের নজরে আসে আবার পাঠক সমাজ সম্পর্কে সচেতন হয় লেখকের সৃজনশীলতায় অর্থাৎ লেখক ও পাঠক পরস্পরের পরিপূরক

    সমাজ, মানুষ, মনের অলিগলির মধ্যে যখন ঘুরতে থাকেন সচেতন সাহিত্যশিল্পী তখন পাঠক মহলে সৃষ্টির প্রতি গ্রহণীয় চাহিদাও অনুভব করেন অজস্র পাঠক তাদের পছন্দ অপছন্দেরও হাজারো রকমফের আর তাই বোধহয় সাহিত্যও অগণিত রূপে বহমান কবিতা, ছড়া, নাটক, উপন্যাস, ছোটোগল্প সাম্প্রতিকম সংযোজন অণুগল্প

    একটা সময় ছিল যখন বাংলা গদ্য সাহিত্যে বড় বড় উপন্যাসেরই ছিল প্রবল জনপ্রিয়তা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায় সে সময়ের উল্লেখযোগ্য নাম সময়ের পরিবর্তনের হাত ধরে পাঠকের চাহিদারও পরিবর্তন এল রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে এল ছোটোগল্প বলা যায় বাংলা সাহিত্যের এক নতুন দিগন্তের আবির্ভাব স্বাভাবিকভাবেই দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠল ছোটোগল্প 'শেষ হয়েও হইল না শেষ' এই ক্লাসিক ভাবটাই মোহিত করে রাখল পাঠক সমাজকে এই ফর্মাটে রবীন্দ্রনাথ তো আছেনই, এছাড়া শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব বসু, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় আরও অনেকে নিজেদের প্রতিভার দীপ্তি ছড়িয়ে গেছেন

    কিন্তু সময় যত এগিয়েছে বেড়েছে মানুষের ব্যস্ততা বদলেছে আদবকায়দা, জীবনযাপনের অভ্যাস এবং মানসিকতা দরকার হয়ে পড়ল আরও নতুন কিছুর অতি অল্প সময়ে পুরোটাই পাঠ শেষ করতে হবে পাঠকের এই অভীপ্সাকে সামনে রেখে এল আরও ছোট ফর্মাট অনুগল্প নামে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্নেহধন্য বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় ওরফে বনফুল হলেন এই ক্ষুদ্র ফর্মাটের অগ্রদূত

    সাহিত্যবিদ ও ব্যকরণবিদগণ ইতিমধ্যে উপন্যাস ও ছোটোগল্পের স্বভাব চরিত্র অলংকরণ নিয়ে তাদের অবয়ব তৈরি করে ফেলেছেন কিন্তু অনুগল্পের চেহারা এখনও স্পষ্ট নয় কারণ এখনও সে শিশু সবে হাঁটতে শিখেছে তার চেহারা নিতান্তই যদি বর্ণণা করতেই হয় তাহলে বলতে হয় আগাগোড়া নিজেই সে এক কবিতা তার প্রতিটি শব্দ সহস্র শব্দের প্রতিনিধি হয়ে সামনে এসে দাঁড়ায় গড়ে ওঠা চেহারা টেনে নিয়ে যায় মাটির অনেক গভীরে যেখানে শেকড় প্রতিটি মুহূর্তে সংগ্রাম করে সংগ্রহ করে চলেছে প্রাণের রসদ, বেঁচে থাকার অমৃত

    অণুগল্প ছোটোগল্পের সংক্ষিপ্ত সংস্করণ বলা যেতে পারে শব্দসংখ্যা তিনশোর আশপাশ এই স্বল্প শব্দের মধ্যে একটা ঘটনাকে সাহিত্যরসে জারিত করে পাঠকের সামনে উপস্থাপিত করা সহজ ব্যপার নয়

    এই কঠিন কাজটাই অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার সঙ্গে সফল ভাবেই শেষ করেছেন এসময়ের এক প্রতিভাবান গল্পকার মানস সরকার উপহার দিয়েছেন তার প্রথম অনুগল্পগ্রন্থ 'সামাজিক' বিভিন্ন বাণিজ্যিক ও সবুজপত্রে ওনার লেখনীর সঙ্গে পূর্ব পরিচিত শিরোনাম ও প্রচ্ছদের ছবি কৌতূহল বাড়িয়ে দিল আরও তাই অনেক প্রত্যাশা নিয়ে শুরু করলাম পাঠ

    'সমাজিক'-র অন্দরমহল থেকে যে সকল ছবিগুলো উঠে এল দেখে নিই এক ঝলক

    সামাজিক ১: সাধারণ সমাজ জীবনে সাধ ও সাধ্যের মধ্যে থাকে বিস্তর ফারাক সাধ থাকলেও সাধ্যে কুলিয়ে ওঠে না সব সময় এই অসম্ভব প্রত্যাশাও সম্ভব হতে পারে! একমাত্র বলব না, অন্যতম উপায় মনের ভাবমূর্তির বদল ঘটানো যেমন স্মৃতিমেদুরতায় বিবাহবার্ষিকীতে ঋণভারে জর্জরিত অভাবী কেউ সাধারণ চা দোকানে সময় কাটিয়েও কেবল ভাবনাকে দিশা দেখিয়ে পাঁচতারা হোটেলের আমেজ উপভোগ করতে পারেন অনায়াসে ভালোবাসায় মোড়া এ সুখ কম কিছু নয় মনে রাখার মতো একটি ছবি মোপাসাঁকে মনে করিয়ে দেয় অবশ্য এ-ছবি অন্যগুলোর থেকে একেবারেই আলাদা

    সামাজিক ২: কেউ কেউ ভাবেন অঙ্কের হিসেবনিকেশ দিয়েই সরলীকরণ করে ফেলবেন জীবনের জটিল ধাঁধা! তা যে সম্ভব নয় সেটা জানে সবাই কিন্তু অনেকেই জানেনা তার হিসেবি চলাফেরাকেও অঙ্কের ফর্মূলাতে ফেলে মাপছে তারই নিকট কেউ! বলা যায় জীবনের পরিচিত স্বাভাবিক ছন্দ সর্বনাশা ছন্দহীনতার পথে এগিয়ে চলেছে নিশ্চিন্তে!

    সামাজিক ৩:  নিকট জনের মৃত্যুতে শোক-বিহ্বলতাও প্রশ্নেচিহ্ন এঁকে দিচ্ছে! অভিনয় আর ছলনা নির্লজ্জ সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে জন্ম-মৃত্যু সম্পর্ক সম্মান শুধুই কি লৌকিকতার দায়ে দায়বদ্ধ? সবকিছুর উর্ধ্বে আমরা কি যান্ত্রিক হয়ে উঠছি? মানসবাবু প্রশ্নগুলো তুলেছেন অত্যন্ত জোরালো ভাবে

    সামাজিক ৪:  শিক্ষা আনে চেতনা, চেতনা আনে বিপ্লব কিন্তু শিক্ষার মধ্যেও যে গলদ থেকে যাচ্ছে! তার কী হবে? সামাজিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে কোথায় গর্জে উঠছে আমজনতা? তথাকথিত শিক্ষিত হয়ে যারা ভুলটাকেই বয়ে নিয়ে চলে আর যাইহোক তাতে বিপ্লব আসে না এর দ্বারা সমাজের যা ক্ষতি হচ্ছে তা অপূরণীয়

    সামাজিক ৫: যেটুকু ছবি 'দর্পণ'এ উঠে আসছে দেখছে কে! পাঠক তখন জনতার ভিড়ে অবচেতনার স্রোতে মিশে এগিয়ে চলেছে চিরায়ত গড্ডালিকাপ্রবাহে! সুতরাং ভুল থেকে সচেতন হয়ে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনবে কে! বড়ই দুঃসময়

    সামাজিক ৬: দেশটা পরিচালনার দায়িত্বে যারা রয়েছেন ক্ষমতার লোলুপতায় অন্ধ হয়ে দেশ পরিচালকেরা কেবল বক্তৃতাম্যান আর ঝোলা ভরতেই অধিক ব্যস্ত সামাজিক সম্পদের উন্নয়ন ব্রাত্যই থেকে যাচ্ছে

    সামাজিক ৭: এত অন্ধকার! এত অন্ধকার ছেয়ে যাচ্ছে চারিদিকে যে প্রকৃতির রূপ-রস-শব্দ-গন্ধ-স্পর্শ সব ঢাকা পড়ে যাচ্ছে কৃত্রিমতার আড়ালে সভ্যতার সংকট

    মোট বারোটি গল্প বারোটি কঠোর বাস্তব নিংড়ানো কাহিনি নিছক মন ভোলানো গল্পকাহিনি এ-নয়, স্বকীয় গুণমানে প্রতিটিই যেন এক একটি অ্যাটম বোম্ব

 

    সেই আদিমযুগ থেকে ক্রমশই নাকি এগিয়ে চলেছি আমরা! হিমালয় জয় করে ছুটছি চাঁদ মঙ্গল ছাড়িয়ে আরও দূর গ্যালাক্সিতে! অথচ প্রদীপের নীচেই অন্ধকার রোজই সাম্রাজ্য বিস্তার করে চলেছে একটু একটু করে তার খেয়াল ক'জন রাখে!

    গল্পকার প্রাবন্ধিক মানসবাবুর তীক্ষ্ম পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে সমাজের সেইসব ঘূণধরা অসার অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘটনার বর্তমান সহাবস্থানের সুস্পষ্ট চিত্র ঘটনার নির্যাসটুকু বের করে স্বল্প শব্দে চমৎকার পরিবেশন করেছেন তিনি যথার্থ শিরোনাম আসলে তিনি সচেতন করতে চেয়েছেন আগামী প্রজন্মকে আগামী সমাজকে অন্তত বর্তমান জীর্ণদশা অতিক্রম করে ভবিষ্যতের পৃথিবী স্বগরিমায় আবার উদ্ভাসিত হয়ে উঠুক এটা শুধু লেখক নয় আমাদের সবার প্রার্থনা আসুন আমরা সবাই গল্পগুলি পাঠ করতে করতে নিজেদের সমৃদ্ধ করি ও এ বিশ্বকে আগামী প্রজন্মের 'বাসযোগ্য' করে গড়ে তোলার শপথ গ্রহণ করি

    বন্ধুবর মানসবাবু 'রূপান্তর' 'সামাজিক' গল্পদুটির কাহিনির মধ্যে নিভপ্রায় মানবিকতা ও মনুষ্যত্বের এক ঝলক আলোক স্ফুলিঙ্গ খুঁজে পেয়েছেন এত অন্ধকার, এত বিষাদময়তার মধ্যে এটুকুই যা সান্ত্বনা এটাই হোক আমাদের এগিয়ে চলার পাথেয়

 

গল্পগ্রন্থ: সামাজিক

লেখক: মানস সরকার

প্রকাশক: মৃত্তিকা

মূল্য: ৩০/-



 

2 comments:

  1. অসাধারণ পর্যবেক্ষণাত্মক ও বিশ্লেষণাত্মক একটি সমালোচনা। অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও সুন্দর ভঙ্গিতে প্রতিটি গল্পকে পাঠকের কাছে স্বীয় ব্যাখ্যায় ও বর্ণনায় উপস্থাপন করেছেন সমালোচক। ব্যাখ্যা ও সমালোচনাও স্বয়ং সাহিত্যের একটি অনস্বীকার্য অঙ্গ, সেকথাই আবার অনুভব করলাম পাঠান্তে।
    ধন্যবাদ লেখক ও ছোটগল্পকার মানস সরকার বাবু'কে। নিজের পারিপার্শ্বিক ও সমাজকেই যদি আমরা না তিনি, তবে যে আমরা স্ব-ভূমে পরবাসী। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও অবশ্যই দায়িত্বপূর্ণ একটি কর্ম তিনি পালন করেছেন এই সমাজের জন্য। অকুন্ঠ ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা রইল তাঁর উদ্দেশ্যে।

    ReplyDelete