Wednesday, July 27, 2022

ইরাবতী কার্বে

ইরাবতী কার্বে

অ্যানথ্রপলজি বা নৃবিদা হল মানুষ নিয়ে পড়াশোনা করা এটি বিজ্ঞানের সেই শাখা যা মানুষের উৎপত্তি, বিকাশ, তাদের আচরণ, সংস্কৃতি, তাদের নানাবিধ প্রথা, বিশ্বাস প্রভৃতি নিয়ে আলোচনা করে ভারতবর্ষে নৃবিদ্যা পড়াশোনা খুব পুরোনো যদিও ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভারতে নৃবিদ্যার সূচনা বলে অনেকে মনে করেন কিন্তু এর পেছনে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ নেই ভারতবর্ষে নৃবিদ্যার সূচনা ধরা হয় উনবিংশ শতাব্দীতে বিভিন্ন পণ্ডিত ব্যক্তি এই নিয়ে গবেষণা করেন শিক্ষাক্ষেত্রে নৃবিদ্যা বিভাগ প্রথম চালু হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে, ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে মনে করা হয় প্রথম ভারতীয় নৃততত্ববিদ ও নৃবিজ্ঞানী হলেন শরৎচন্দ্র রায়। তাঁকে ভারতীয় নৃতত্ত্বের জনক হিসেবে অভিহিত করা হয়। এরপর দিল্লি, লক্ষ্নৌ, গুয়াহাটি প্রভৃতি জায়গায় নৃবিদ্যা বিভাগ চালু হয় পাশাপাশি বহু বিশ্ব বিদ্যালয় তাদের পাঠ্যক্রমে নৃবিজ্ঞানকে একটি বিষয় হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করে এভাবে একটু একটু করে বিংশ শতাব্দীতে ভারতবর্ষে নৃবিদ্যা বিস্তারলাভ করে এই নিয়ে যারা কাজ করেছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন ডিন.এন. মজুমদার, এল.কে. অনন্তকৃষ্ণ আইয়ার, আর.পি. চন্দা, জিন.এস. ঘুরে, এন.কে. বেসি প্রমুখ প্রথমদিকে এই বিষয়টি নিয়ে মূলত পুরুষরাই পড়াশোনা ও গবেষণা করতেন মহিলারা সেভাবে এই বিষয়ে আকৃষ্ট ছিলেন না প্রথমত সে সময় মহিলাদের পড়াশোনার ব্যাপার তেমন উৎসাহ দেওয়া হত না পাশাপাশি এই বিষয়ের জন্য প্রচুর ফিল্ড স্টাডি করতে হত যা মহিলাদের পক্ষে সেই সময় ছিল বেশ কষ্টসাধ্য ও সমস্যাজনক ফলে মহিলারা এই বিষয়ে আসতেন না তবে ব্যতিক্রমী ছিলেন ইরাবতী কার্বে গতানুগতিক ভাবধারার বাইরে গিয়ে তিনি এই বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করেছেন ইরাবতী কার্বে হলেন ভারতের প্রথম মহিলা নৃতত্ত্ববিদ পুনে বিশ্ব বিদ্যালয়ে তিনি নৃবিদ্যা দপ্তর স্থাপন করেছিলেন

    ১৯০৫ খ্রস্টাব্দের ১৫ ডিসেম্বর বার্মার মিয়াংগানে ইরাবতীর জন্ম বর্মার পবিত্র নদী ইরাবতীর নামে বাবা-মা তার নাম রাখেন ইরাবতী তাঁদের পরিবার ছিল সম্ভ্রান্তশালী চিতপাবন ব্রাহ্মণ পরিবার তাঁর বাবা গণেশ হরি কর্মকার ছিলেন পেশায় ইঞ্জিনিয়ার বার্মার বার্মা কটন কোম্পানিতে তিনি কাজ করতেন তাঁদের পরিবার ছিল শিক্ষিত গতানুগতিক ভাবধারায় না হেঁটে তার বাবা-মা তাঁকে পড়াশোনার ব্যাপারে উৎসাহিত করতেন

    বার্মায় জন্ম হলেও ইরাবতীর পড়াশোনা এবং বেড়ে ওঠা পুনেতে সাত বছর বয়সে তাঁকে পুনার হুজুরপাগায় একটি আবাসিক স্কুলে ভর্তি করা হয় ১৯২২-তে স্কুলের পড়া শেষ করে তিনি ফার্গুসেন কলেজে দর্শনে অনার্স নিয়ে ভর্তি হন ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি স্নাতক পাশ করেন এরপর দক্ষিণা ফেলোশিপ পেয়ে বোম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের জি.এস. ঘুরের অধীনে সমাজতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করেন তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল দ্য চিতপাবন ব্রাহ্মণস–অ্যান এথনিক স্টাডি ১৯২৮-এ তিনি এম-এ পাশ করেন

এম-এ পড়ার সময় তাঁর বিয়ে হয় ড. দিনকর ধন্দু কার্ভের সঙ্গে ড. দিনকর ব্রাহ্মণ হলেও এই বিয়েটা ইরাবতীর বাবার মনোমতো হয়নি তিনি চেয়েছিলেন রাজপরিবারের কারও সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে ড. দিনকর ছিলেন ডেকান কলেজের রসায়নের অধ্যাপক পরে তিনি ফার্গুসেন কলেজের অধ্যক্ষ হয়েছিলেন তাঁদের দুই মেয়ে ও এক ছেলে বড়ো মেয়ে জই নিম্বকর একজন ঔপন্যাসিক ও গল্পকার ছোটো মেয়ে গৌরী দেশপাণ্ডে খ্যাতনামা মারাঠি কবি ও গল্পকার ছেলে আনন্দ কার্বে পুনেতে আরতি নামে একটি এনজিও চালান তাঁর নাতনি উর্মিলা দেশপাণ্ডেও একজন লেখিকা

প্রসঙ্গত বলার, ড. দিনকর ধন্দু কার্বে ছিলেন ধন্দু কেশব কার্বের সন্তান ধন্দু কেশব কার্বে ছিলেন একজন শিক্ষাবিদ ও সমাজ সংস্কারক মহর্ষি কার্বে নামে তিনি বেশি পরিচিত দেশের মহিলাদের শিক্ষা ও প্রগতি নিয়ে তিনি আন্দোলন করেছিলেন বিধবা বিবাহের সমর্থক ছিলেন তিনি শুধু তাই নয় গোদুবাই নামে এক বিধবাকে বিয়ে করেছিলেন গোদুবাই ছিলেন পণ্ডিত রমাবাইয়ের স্কুল সারদা সদন-এর প্রথম ছাত্রী মহিলাদের শিক্ষা বিস্তারে তাঁর ভূমিকা ছিল বিশাল সমাজ সংস্কারমূলক কাজের জনয ভারত সরকার তাঁকে ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে ভারতরত্ন সম্মানে সম্মানিত করেন একশ বছর বয়সে তিনি এই সম্মান পেয়েছিলেন

    বাবার মতো সমাজ সংস্কারক না হলেও ড. দিনকর ধন্দু কার্বে স্ত্রীর উচ্চশিক্ষার ব্যাপারে তাঁকে উৎসহিতই শুধু করেননি, সবরকম সাহায্য নিয়ে তাঁর পাশে ছিলেন দিনকর পাশে না থাকলে ইরাবতীর শিক্ষার পথচলা কখনওই মসৃণ হত না

    ড. দিনকর কার্বে জৈব রসায়ন নিয়ে জার্মানিতে পিএইচডি করেছিলেন তিনি চেয়েছিলেন ইরাবতীকে জার্মানি থেকে পিএইচডি করাতে এই ব্যাপারে বাবার সঙ্গে কথা বলেন তিনি আশ্চর্যের বিষয় যিনি নারী শিক্ষার ব্যাপার নিয়ে সংস্কার আন্দোলন করেছিলেন তিনি ছেলের এই সিদ্ধান্তে রাজি হন না বিদেশে পড়তে যাওয়া খরচাবহুল তাছাড়া ইরাবতীর যা ডিগ্রি তাতে তিনি বিশ্ব বিদ্যালয়ে কাজ পেয়ে যাবেন এই যুক্তি দেখিয়ে তিনি বিরোধিতা করেন কিন্তু দিনকর ইরাবতীকে জার্মানিতে পড়ানোর ব্যাপারে বদ্ধপরিকর ছিলেন নিজের উদ্যোগে ইরাবতীকে জার্মানিতে পড়ানোরর খরচ জোগাড় করেন তাঁকে টাকা ধার দিয়েছিলেন জীবরাজ মেহেতা যিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের একজন সদস্য ছিলেন

ইতিমধ্যে ধন্দু কেশব কার্বে পুনে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন ইরাবতীর জার্মানি যাওয়ার তারিখ স্থির হওয়ার পর ড. দিনকর বাবাকে চিঠি লিখে তা জানান এবং বাবার আশীর্বাদ চান কিন্তু ইরাবতীর শ্বশুরমশাই চিঠি দিয়ে জানান যেহেতু এই সিদ্ধান্তে তাঁর মত নেই তাই তিনি কোনো আশীর্বাদ করবেন না

ইরাবতীর জীবনে এ-ছিল এক তিক্ত অধ্যায় শ্বশুর মহাশয়ের এমন আচরণ তিনি মানতে পারেন না ধন্দু কেশব কার্বে নারীশিক্ষার জন্য অনেক আন্দোলন করেছিলেন অনেক মেয়েকে বিদেশে পড়ানোর ব্যবস্থা করেছেন তার জন্য আর্থিক সংস্থানের উদ্যোগ নিয়েছেন সেই তিনি নিজের বউমার বিদেশে পড়ার ক্ষেত্রে এমন আচরণ করবেন এটা কিছুতেই মানতে পারেননি তবে স্বামী পাশে থাকায় বিদেশে পড়তে যাওয়ার ব্যাপারে কোনো সমস্যা হয় না

১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে ইরাবতী একাই জার্মানি আসেন এখানে কাইজার উইলহেলম ইনস্টিটিউট অব অ্যানথ্রোপোলজিতে ভর্তি হন ইউজিন ফিসারের আন্ডারে তিনি গবেষণা করেন তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল হিউম্যান হেরিডিটি অ্যান্ড ইউজোনিকস ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে তাঁর পিএইচডি ডিগ্রি সম্পন্ন করেন বার্লিন বিশ্ব বিদ্যালয় তাঁকে ডি.ফিল ডিগ্রি প্রদান করে

ডক্টরেট করার পর দেশে ফিরে আসেন ইরাবতী ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে তিনি বোম্বের শ্রমতী নাথিভাই দামোদর থ্যাকারসে (এসএনডিটি) মহিলা বিশ্ব বিদ্যালয়ের প্রশাসক হিসেবে যোগ দেন শুধুমাত্র ভারত নয় দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার এটি প্রথম মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়। মেয়েদের উচ্চশিক্ষার পথ সুগম করতে মহর্ষি ধন্দু কাশ্যপ ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে এই বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন ইরাবতী এখানে তিনি ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত কাজ করেন

১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে পুনের ডেকান কলেজে রিডার হিসেবে নিযুক্ত হন তিনি কর্মজীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি এখানে কাজ করেছেন ডেকান কলেজের সোসিওলজি ও অ্যানথ্রোপলজি বিভাগের প্রধান হিসেবে বেশ কিছু বছর কাজ করেছেন তিনি পুনে বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি অন্যথ্রপলজি বিভাগ চালু করেছিলেন ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে নয়াদিল্লিতে আয়োজিত জাতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতিত্ব করেছিলেন তিনি

১৯৫১-৫২তে তিনি ইংল্যান্ডের লন্ডন বিশ্ব বিদ্যালয়ের স্কুল অব অরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ থেকে আমন্ত্রণ পান তিনি এখানে থাকার সময় তিনি তাঁর প্রথম বই কিনশিপ অর্গানাইজেশন ইন ইন্ডিয়ার খসড়া রচনা করেন আমেরিকার রকারকেলার ফাউন্ডেশনের ইউম্যানিটিজ ডিভিসন থেকেও আমন্ত্রণ পান তিনি ১৯৫৯-৬০এ তিনি বার্কলের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং প্রফেসর ছিলেন

ইরাবতীর নিজস্ব ভাবনাচিন্তার মাধ্যমে নিজের গবেষণার কাজ করেছেন ভারতের ইতিহাস, সংস্কৃতি, সাহিত্য এবং দর্শন প্রভৃতির মাধ্যমে তিনি তাঁর কিনশিপ-এর কাজ করেছেন তিনি মূলত ফিজিক্যাল অ্যানথ্রপলজি নিয়ে কাজ করেছেন পাশাপাশি কালচারাল অ্যানথ্রপলজিতেও তার অবদান ছিল। তাঁর অধীনে পঁচিশজন ছাত্রছাত্রী ডক্টরেট করেছেন। একশোর বেশি গবেষণাপত্র প্রকাশ হয়েছে তাঁর

ইরাবতী একজন ভালো লেখিকা ছিলেন মারাঠি এবং ইংরাজি ভাষায় তিনি অনেক বই লিখেছেন তাঁর গবেষণা এবং লেখায় বারে বারে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন জাতপাত, পারিবারিক সম্পর্ক, ধর্ম, পুরাণ প্রভৃতি নিয়ে তাঁর লেখা কিছু উল্লেখযোগ্য বই হল, কিনশিপ অর্গানাইজেশন ইন ইন্ডিয়া, দ্য ভিলস অব ওয়েস্ট খান্দেশ, মহারাষ্ট্র : ল্যান্ড অ্যান্ড পিপল, যুগান্ত : দ্য এন্ড অব অ্যান এপোক, হিন্দু সমাজ, পরিপূর্তি, সংস্কৃতি, গঙ্গাজল প্রভৃতি যুগান্ত : দ্য এন্ড অব এন এপোক বইটির জন্য ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি মারাঠি সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পেয়েছিলেন মহারাষ্ট্রের প্রথম লেখিকা হিসেবে এই সম্মান পান তিনি  এই গ্রন্থে মহাভারতের কুন্তী, গান্ধারী, ভীষ্ম প্রমুখ প্রধান প্রধান চরিত্রগুলিকে ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে তুলে ধরে, সেই আলোয় তাদের উপস্থাপিত করেছেন তিনি বইটি প্রথমে মারাঠি ভাষায় লেখেন পরে ইংরাজি ভাষায় অনুবাদ করেন

ইরাবতী নারী স্বাধীনতার পক্ষপাতী ছিলেন ঘোমটা দিয়ে মেয়েরা ঘরে বসে থাকবে এমন ভাবনার মানুষ তিনি ছিলেন না গতানুগতিক ভাবধারা থেকে তিনি ছিলেন অনেক এগিয়ে পুনের রাস্তায় বাইক চালিয়ে যাতায়াত করতেন তনি কোনো মহিলা বাইক চালিয়ে যাতায়াত করবে, পাঁচের দশকে ব্যাপারটা অনেকটা অকল্পনীয় ছিল আমাদের দেশে একটা সময় মহিলারা স্বামীদের নাম ধরে ডাকা দূরে থাক, তাদের নামও মুখে উচ্চারণ করত না (বাংলায় প্রথম আত্মজীবনী লেখিকা রাসসুন্দরী দেবীর আমার জীবন পড়লে আমরা দেখতে পাই, তিনি স্বামীর সামনে দূরে থাক তিনি স্বামীর ব্যবহার করা ঘোড়ার সামনে এলেও মাথায় লম্বা ঘোমটা দিয়ে থাকতেন।) কিন্তু সেই সময় ইরাবতী স্বামীকে নাম ধরে ডাকতেন স্বামীকে তিনি দিনু বলে ডাকতেন আর দিনকর তাঁকে ইরু বলে ইরাবতী যে সময় বড়ো হয়ে উঠেছেন, সেই সময় নারীরা পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নিজেদের সমানাধিকারের দাবি নিয়ে লড়াই শুরু করেছে ইরাবতী বলেছিলেন অধিকারের জন্য যদি লড়াই করতেই তাহলে সমান অধিকারের জন্য কেন করবে? লড়াই হোক আরও বেশি কিছুর জন্য তিনি বলেছিলেন, “Ladies, while fighting with men for rights, why fight for only equal right. Always fight for more right.”

১৯৭০ এর ১১ আগস্ট তিনি মারা যান

পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় পুরুষতান্ত্রিকতার শেকল ভেঙে বেরিয়ে এসেছিলেন তিনি শিক্ষা ও গবেষণার জগতে নিজের জন্য আলাদা একটা স্থান করে নিতে পেরেছিলেন অ্যানথ্রোপলজির মতো একটা বিষয়, যেখানে মহিলাদের তেমন উৎসাহ ছিল না, সেই বিষয়ে নিজ ভাবনা চিন্তা কেবল গবেষণাই করেননি, পাশাপাশি আগামী প্রজন্মের মহিলাদের কাছে নিজেকে পথিকৃৎ হিসাবে তুলে ধরেছিলেন

Friday, June 10, 2022

বর্ষা : জীবন ও সাহিত্যে

 বর্ষা : জীবন ও সাহিত্যে

সৌরভকুমার ভূঞ্যা

 

সভ্যতার খড়্গ হাতে মানব দানব

শ্যামল সবুজ বুকে রক্তের ছোপ।

নিষ্ঠুর উদাসীনতায় নীরব অশ্রুপাত,

কে আর খেয়াল রাখে যন্ত্রণা আপশোশ!

তাই তো মেঘের বুকে জাগে অভিমান,

গ্রীষ্মের চোখে ঝরে অনল অভিশাপ।

হাহাকার জেগে ওঠে প্রকৃতির বুকে

প্রেমিক মেঘের কাছে আকুল হৃদয়,

না হয় বাসলে ভালো অনন্ত আকাশ

শুধু, অভিমানটুকু দাও অশ্রু উপহার।

 

গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে যখন বিধ্বস্ত জীবন, ওষ্ঠাগত প্রাণ, তখন একটু বৃষ্টির প্রত্যাশায় আকাশের বুকে মেঘের খোঁজে ব্যাকুল হয়ে ওঠে মন। কখনও কখনও কালবৈশাখীর হাত ধরে মেঘ আসে। বিস্তীর্ণ কালো সামিয়ানায় ঢেকে ফেলে গোটা আকাশ। প্রকৃতির গুমোট অভিমান ভাঙাতে আকাশের বুক থেকে বৃষ্টি হয়ে নেমে আসে মেঘ। সবুজের সমারোহে হেসে ওঠে প্রকৃতি। রিক্ত হৃদয়ে স্থান করে নেয় স্নিগ্ধ শীতলতা। কিন্তু সে শীতলতা ক্ষণিকেরকালবৈশাখীর ক্ষণিক বৃষ্টি প্রকৃতিকে সাময়িক শান্তি দেয় কিন্তু তার আকাঙ্ক্ষাকে পূর্ণতা দিতে পারে না। কালবৈশাখী মেঘের কতটুকুই বা শক্তি যে প্রকৃতির বিস্তৃত হৃদয়কে শান্তি ও স্নিগ্ধতায় পরিপূর্ণ করতে পারে! আর আজকাল, দূষণ নামক দানবের কবলে পড়ে কালবৈশাখীও অনেকটাই তার গরিমা হারিয়েছে। আকাশ ঢেকে ফেলা ঘন কালো মেঘ, দানবীয় ঝড় এখন আর তেমন দেখা যায় না। তাই প্রতীক্ষার প্রহর গোনা, কখন আকাশের বুক দখল করে নেবে মেঘবালিকার দল, প্রকৃতির বুকে ঝরঝরিয়ে নেমে আাসবে বৃষ্টি, যে বৃষ্টিধারার স্রোত-মূর্ছনায় জেগে উঠবে সৃষ্টির আগমনী সুর, জীবনের বেঁচে থাকার আনন্দগান আর হৃদয়ের প্রেম-বিরহের আদ্ভুত আবেগ। আর এসবকিছুই মিলিয়ে বর্ষা আমাদের কাছে হাজির হয় এক প্রেমময়ী নারী রূপে, যে নারীর কাছে আমরা খুঁজে ফিরি ভালোবাসার আশ্রয়।

    বর্ষা মানেই এক মন ভালো করা ঋতু। মেঘের গর্জন, বিদ্যুতের ঝলকানি, আকাশ ঢেকে ফেলা ঘন কালো মেঘ, তার বুক চিরে নেমে আসা রূপোলি বৃষ্টিধারা আর প্রকৃতির বুকে সবুজের প্লাবন—সত্যিই বর্ষার রূপের কোনো তুলনাই হয় নামেঘ-বৃষ্টির বর্ণনার অসাধারণ ছবি ফুটে উঠেছে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নববর্ষা’ কবিতায়---গুরু গুরু মেঘ, গুমরি গুমরি/গরজে গগনে গগনে, গরজে গগনে।/ধেয়ে চলে আসে বাদলের ধারা,/নবীন ধান্য দুলে দুলে সারা,/কুলায়ে কাঁপিছে কাতর কপোত,/দাদুরি ডাকিছে সঘনে/গুরু গুরু মেঘ, গুমরি গুমরি/গরজে গগনে গগনেবর্ষা সৃষ্টির ঋতুমাত্র নয়, স্নিগ্ধ সৌন্দর্যের ঋতু, বর্ষা প্রেমের ঋতু, ভালোবাসার ঋতু, নিজের মধ্যে নিজেকে খোঁজার ঋতু। ঋতুর রাজা বসন্ত কিন্তু প্রেম-বিরহের আবেগময়তায় বর্ষা আমাদের মনে অনেক বেশি করে স্থান করে নেয়। শুধু তাই নয়, বর্ষা আমাদের স্মৃতিমেদুর করে, ফিরিয়ে নিয়ে যায় শৈশব-কৈশোরের সেইসব ভালোলাগার দিনগুলিতে যখন আকাশে মেঘ দেখলে উদ্বেলিত শিশুমন ছড়া কেটে বলে উঠত—আয় বৃষ্টি ঝেঁপে/ধান দেব মেপে।আবার অবিরাম বৃষ্টিতে যখন মন খারাপ হয়ে যেত তখন ছড়া কেটে বলত---“লেবু পাতা,/করমচা যা বৃষ্টি চলে যা ভারী বর্ষায় বাড়ির উঠোন যখন হয়ে উঠত ছোট্ট নদী তখন কাগজের নৌকা তৈরি করে সেখানে ভাসানোর যে অদ্ভুত আনন্দময় অনুভূতি, সে স্মৃতি হৃদয়ে গাঁথা হয়ে থাকে আমৃত্যু। বর্ষায় ভিজতে ভিজতে খেলার মাঠে ফুটবল নিয়ে দাপাদাপি কিংবা জল-ভরা মাঠে উচ্ছল দাপাদাপি—এতো আাজও গ্রামের বুকের পরিচিত দৃশ্য। আর কৈশোরের দিনগুলিতে, মনের মধ্যে যখন সবে একটু একটু করে উঁকি মারতে শুরু করেছে প্রেম-মুকুল আর ভালোলাগাবোধের রহস্যময় অনুভূতি, ঠিক সেসময় কোনো এক বর্ষণমুখর পড়ন্ত বিকেলে ভালোবাসার কিশোরীর বৃষ্টি-স্নাত সৌন্দর্য্য লুকিয়ে আবলোকন করার যে আনন্দ-সুখ, তার মতো স্বর্গীয় অনুভূতি জীবনে খুব কমই আসে। এভাবেই বর্ষা আমাদের জীবনের পাতায় পাতায় বিছিয়ে রাখে মাধুর্য্যমাখা স্মৃতি, যা আমাদের জীবনের আঁকাবাঁকা বন্ধুর পথচলায় মাঝে মাঝে দিয়ে যায় এক অদ্ভুত সুখের ছোঁওয়া।

    বর্ষা আমাদের জীবনের সঙ্গে ওতোপ্রোতো ভাবে জড়িয়ে। বর্ষার সঙ্গে সৃষ্টির নিবিড় সম্পর্ক। আকাশের বুকে মেঘের আনাগোনা ঘটলে কৃষকের মন আনন্দে নেচে ওঠে লাঙল-বলদের দিন আজ আর প্রায় নেই। অঝোর বৃষ্টিধারার নীচে তালপাতার টুপি কিংবা পেখিয়া মাথায় দিয়ে বলদ দিয়ে লাঙল করার সেই অসাধারণ গ্রাম্য ছবি আজ কেবল বিবর্ণই নয় প্রায় নিশ্চিহ্ন বল যেতে পারে। বলদের জায়গায় স্থান করে নিয়েছে যন্ত্র। তবে বাকি দৃশ্যগুলোর খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। কৃষাণ-কৃষাণীর মাঠে বীজ বোনা, চারা রোপন, মাঠের আলে বসে কর্দমাক্ত কৃষকের দুপুরের আহার সারা, তারপর পড়ন্ত বিকেলে ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফেরা প্রভৃতি দৃশ্যগুলোকে এখনও গ্রাস করে নিতে পারেনি আধুনিক সভ্যতার যন্ত্র-দানব। যাই হোক, বর্ষার স্পর্শে কচি ধানের চারা অতি অল্পদিনে তাদের শরীরের হলুদ অলস পাতা খসিয়ে সেজে ওঠে সবুজের পোশাকে। মাঠ-ভরা থই থই জলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আকাশের পানে মেলে ধরে তাদের সবুজ প্রাণোচ্ছল উপস্থিতি। সমুদ্র-সদৃশ বিস্তীর্ণ রূপোলী জলের আস্তরণ ঢেকে যায় সবুজের সমারোহে। যে সবুজের মধ্যে নিহিত থাকে বেঁচে থাকার রসদ। বর্ষা সৃষ্টির ঋতু। কৃষকের ঘরে লক্ষ্মীর আগমনের পথ প্রস্তুত করে সে। এতো গেল এক দিক। প্রকৃতি-প্রেমের অফুরাণ তৃপ্তির রসদ যুগিয়ে যায় বর্ষা-স্নাত প্রকৃতি—সবুজ মাঠ, নব সাজে সজ্জিত তরুলতা কিংবা জলে টইটুম্বুর নদী-স্রোত। বর্ষা কখনো আবার দুঃসহ যন্ত্রণা নিয়ে আসে মানুষের জীবনে। বর্ষার রুদ্র মূর্তি দেখে শিউরে উঠে হৃদয়। তবুও বর্ষাকে দূরছাই করে না কেউ। তা করলে যে নিজেদেরই ক্ষতি। বর্ষা ছাড়া আমাদের বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। প্রকৃতির খামখেয়ালীপনায় বর্ষা যখন মাঝে মাঝে পথ ভুলে যায়, গরিব কৃষকের মনে তখন বেজে ওঠে সেই বিখ্যাত গানের সুর—আল্লা মেঘ দে পানি দে।’

    আমাদের নদীমার্তৃক দেশের একটি বৃহৎ অংশের মানুষের জীবন-জীবিকা নির্বাহিত হয় নদীকে কেন্দ্র করে। এই সম্প্রদায়ের নাম হল ধীবর বা জেলে সম্প্রদায়। বর্ষায় উত্তাল নদী-সমুদ্রের বুকে জীবনকে বাজি রেখে তারা জীবনের রসদ খোঁজে। প্রতি পদে পদে থাকে মৃত্যুর হাতছানি। তবুও বর্ষা তাদের কাছে অভিশাপ নয়, আশীর্বাদ। জাল আর জলের সঙ্গে যাদের জীবনের সুর বাঁধা, তাদের কাছে বর্ষা কেবল ঋতু নয়, তাদের কাছে মাতৃসমা। যার স্নেহাশিষ মাথায় নিয়ে তারা আকুল দরিয়ায় পাড়ি দেয়, প্রকৃতির সঙ্গে জীবনের মেলবন্ধন ঘটায়। জেলেদের জীবনে বর্ষার ভূমিকা আর গুরুত্বের কথা বিভিন্ন সাহিত্যিকদের লেখায় সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। এই প্রসঙ্গে তিনটি বিখ্যাত উপন্যাসের নাম করা যেতে যায়—মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’, অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ এবং সমরেশ বসুর ‘গঙ্গা’।

    ‘তিতাস একিট নদীর নাম’ উপন্যাসের প্রায় শেষদিকে আমরা দেখতে পাই, তিতাসের বুকে চর বাড়তে বাড়তে তিতাস হয়ে গেছে শীর্ণকায়া। তখন আসহায় মালোরা গভীর প্রত্যাশায় দিন গুনতে থাকে কখন আসবে বর্ষা, যার বারি সিঞ্চনে তিতাস ফিরে পাবে তার যৌবন, তার বুকে পাওয়া যাবে বাঁচার রসদ। ‘পদ্মা নদীর মাঝিতে মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায় বর্ষার সুন্দর বর্ণনা করেছেন বেশ কয়েকবারহোসেন মি়ঞ্যাকে নিয়ে কুবেরের নিজের বাড়ি ফেরার সময়কার মেঘলা আকাশের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে এইভাবে—আকাশ নিবিড় মেঘে ঢাকিয়া গিয়াছে। দুর্ভেদ্য অন্ধকারে জেলেপাড়ার পথ পায়ের তলেও হইয়া আছে অদৃশ্য। অত্যন্ত সন্তর্পনে পা ফেলিয়া আগাইতে হয়। দীর্ঘ্যকালের পরিচয় না থাকিলে বাড়ির আনাচ-কানাচ দিয়া আঁকাবাঁকা পথ তারা খুঁজিয়া পাইত না। কুবেরের বাড়ির কাছাকাছি আসিয়া আকাশের জমানো মেঘ হঠাৎ গলিয়া যাওয়ায় চোখের পলকে তাহারা ভিজিয়া উঠিল।’ তারপর কুবের বাড়ি ফেরার পর যখন বৃষ্টি নামে তখন কীভাবে তা বিপর্যস্ত করে গরিব কুবেরের কুটির সে বর্ণনা লেখক দিয়েছেন এইভাবে—রাত্রি বাড়তে থাকে, বৃষ্টি ধরিবার কোনো লক্ষ্মণ দেখা যায় না, পিসী ঢেঁকি ঘরে গিয়া বাঁক বন্ধ করিয়া শুইয়া পড়ে।............. বাহিরে চলতে থাকে অবিরাম বর্ষণ। কিছুক্ষণ বৃষ্টি হইবার পর ঘরের ফুটা কোন দিয়া ভিতরে জল পড়িতে আরম্ভ করিয়াছিল।’ সমরেশ বসুর বিখ্যাত উপন্যাস গঙ্গা’তেও মেঘ-বৃষ্টির সুন্দর বর্ণনা আছে একাধিকবার—দুদিন ধরে মহিষকালো আকাশে কেবল বিদ্যুতের ঘটা গেল। বৃষ্টি হল ফিসফিস করে। তারপর মহিষগুলো দাপাদাপি করল। বৃষ্টি এল মুষলধারে। মেঘ নামল গড়িয়ে গড়িয়ে, জড়িয়ে ধরতে আসছে যেন গোটা গঙ্গার বুকখানি। বাজ পড়ল হুঙ্কার দিয়ে। পূবসাগরে রুদ্র ঝড় শুরু হল হঠাৎ।’ এভাবেই সাহিত্যিকরা তাদের শব্দ-কল্পনার মেলবন্ধনে বারেবারে মেঘ-বৃষ্টির সুন্দর ছবি এঁকেছেন।

    বর্ষা আমাদের সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। আমাদের কাব্যসাহিত্য কিংবা গানে দেখা যায় বর্ষার উজ্জ্বল উপিস্থিত। কবি-সাহিত্যিকদের কলমে বার বার উঠে আসে বর্ষা-বন্দনা। বর্ষা এলে উচাটন মন চায় ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে, মেঘের ডানায় চেপে দূরে কোথাও হারিয়ে যেতেকবির ভাষায়—

        মন মোর মেঘের সঙ্গী,

        উড়ে চলে দিগ্ দিগন্তের পানে

        নিঃসীম শূন্যে শ্রাবণবর্ষণসঙ্গীতে

        রিমিঝিম রিমিঝিম রিমিঝিম

কিন্তু শ্রাবণের প্রকৃতি সবসময় সুখকর হয় না। নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে কখনো কখনো লুকিয়ে থাকে অজানা বিপদের গন্ধ। তাই বর্ষা এলে বাইরে বেরিয়ে পড়াটা সবসময় ঠিক হয় না। বৃষ্টি এলে বাড়ির বড়োদের দেখা যায় ছোটোদের নিষেধ করতে যাতে তারা বাড়ির বাইরে না যায়। কবিও সেই কথা বলেন—

        ‘নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে       তিল ঠাঁই আর নাহি রে

        ওগো আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে।

বাদলের ধারা ঝরে ঝরো-ঝরো,  

আউষের ক্ষেত জলে ভরো-ভরো,

কালিমাখা মেঘে ও পারে আঁধার ঘনিয়েছে দেখ্‌ চাহি রে॥’

বর্ষায় মন উচাটন হয়। অদ্ভুত এক আবেগ নাড়া দিয়ে যায় মন। প্রেমিক-প্রেমিকার মন উদাসী হয়। কেবলি ইচ্ছে করে বর্ষার সুর-ছন্দে প্রেম-ধারায় স্নাত হতে। অন্য কোনো কাজে মন লাগে না। অদ্ভুত এক আলসেমি গ্রাস করে মন। প্রেমিক হৃদয়ের সেই অনুভূতির সুন্দরভাবে প্রকাশ হয়েছে কবির লেখনীতে—

        ‘আজিঝরো ঝরো মুখর বাদল দিনে

        জানিনে, জানিনে কিছুতে কেন যে মন লাগে না।’

সত্যি, বর্ষা এলে প্রেমিক মনে কাজ করার ইচ্ছেটাই যেন হারিয়ে যায়। বার বার তার মনের মধ্যে ভেসে ওঠে প্রেয়সীর মুখ। মনের গোপন স্থানে অত্যন্ত সযত্নে লালিত না-বলা কথাটি যেন হৃদয়ের রুদ্ধ দুয়ার খুলে বেরিয়ে আসতে চায়। আসলে হৃদয়ের কথা বলার জন্য বর্ষার থেকে আর ভালো কী হতে পারে। কবিগুরুর ভাষায়—

        ‘এমন দিনে তারে বলা যায়,

        এমন ঘন ঘোর বরিষায়।

        এমন দিনে মন খোলা যায়—

        এমন মেঘস্বরে বাদল-ঝরোঝরে

        তপনহীন ঘন তমসায়।’

কিন্তু যাকে মনের কথা বলবে, সেই মনের মানুষটি যদি নীরব থাকে তাহলে প্রেমিক মন অস্থির হয়ে পড়ে। আকাশে মেঘ যেমন বৃষ্টির বার্তা নিয়ে আসে, তেমনি প্রেমিক মনেও নিয়ে আসে প্রেমের সুর। একলা ঘরে বসে সে প্রতীক্ষা করে কখন আসবে সেই মহেন্দ্রক্ষণ। তার মনের কোণে গুঞ্জরিয়া ওঠে সেই সুর—

        এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকে না তো মন

        কাছে যাবো কবে পাবো বলো তোমার আমন্ত্রণ?’

বর্ষা যেন প্রেমের প্রতীক কিংবা প্রেমের অনুঘটক। বর্ষার আগমনে তাই হৃদয় চঞ্চল হয়, মনের মধ্যে আকুতি জন্মায় একে অন্যকে কাছে পাওয়ার। কোনোকিছুই তার মনকে সুস্থির করতে পারে না। প্রেমের জন্য, প্রেয়সীর জন্য সে যেন অনেকটা পাগল হয়ে ওঠে। প্রেমিক-হৃদয়ের সেই আকুলতা আমরা দেখতে পাই বিখ্যাত সেই গানে—

        আষাঢ় শ্রাবণ, মানে নাতো মন,

        ঝর ঝর ঝর ঝর ঝরিছে

        তোমাকে আমার মনে পড়েছে।’

শুধুমাত্র প্রিয়তম কিংবা প্রিয়তমার মুখ মনে পড়ার মধ্যে সবসময় হৃদয় শান্ত হয় না। প্রেম-কাতর দুটি হৃদয় পরস্পরের কাছাকাছি হতে চায়। যুগ যুগ ধরে আমরা দেখে আসছি কবি-সাহিত্যিকরা বর্ষার সঙ্গে অভিসারের সুন্দর ছবি এঁকেছেন। চর্যাপদ থেকে শুরু করে বর্তমান সাহিত্য—কোথাও এর ব্যতিক্রম নেই। চন্ডীদাসের কয়েকটি লাইনে এই আভিসারের ছবি সুন্দরভাবে ব্যক্ত হয়েছে—

        এ ঘোর রজনী মেঘের ঘটা

        কেমনে আইলা বাটে

        আঙ্গিনার মাঝে বধূয়া ভিজিছে

        দেখিয়া পরাণ ফাটে।’

বর্ষা যেমন হৃদয়কে আলোড়িত করে একে-অন্যের মুখোমুখি হওয়ার, তেমনি অনেক সময় আমরা দেখতে পাই বর্ষার তীব্র বারিধারা দুটি হৃদয়ের মিলনের মাঝে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। তখন অভিসারী মন বৃষ্টি দেখে একটু শিউরে ওঠে। মনে মনে সে বলতে থাকে—

        ‘ওগো বর্ষা তুমি ঝোরো নাকো এমন জোরে

        কাছে সে আসতে নাহি পারে

        এলে না হয় ঝোরো তুমি প্রবল জোরে।’

বর্ষার সঙ্গে প্রেম-বিরহের এই নিবিড় সংযোগের ছবি অতি পুরাতন। সাহিত্যের পাতায় চোখ রাখলে আমরা দেখতে পাবো সেই চর্যাপদের যুগ থেকে কবি-সাহিত্যিকরা বর্ষা-বন্দনা করে আসছেন চর্যাপদের কবি বিদ্যাপতির কবিতায় ফুটে ওঠে বিরহী সুর—

        ‘সখি হামারি দুঃখের নাহি ওর

        এ-ভরা বাদর মহা ভাদর

        শূন্য মন্দির মোর।’

বর্ষা আর প্রেমের কথা এলে অবশ্যই করে বলতে রাধার প্রেমের কথা। বর্ষা সঙ্গে রাধার বিরহের সম্পর্ক। আকাশের বৃষ্টি রাধিকার চোখের জল হয়ে ঝরে পড়ে। বর্ষা তার মনের মধ্যেকার প্রেম, কামণা, বাসনাকে আরও গভীরভাবে জাগিয়ে দেয়। বিদ্যাপতির কবিতায় সেই ছবি ফুটে উঠেছে---

    তিমির দিগভরি ঘোর যামিনী

    অথির বিজুরিক পাতিয়া

    মত্ত দাদুরি, ডাকিছে ডাহুকী

    ফাটি যাওত ছাতিয়া।

বর্ষা এলে রাধা কৃষ্ণকে কাছে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। কৃষ্ণকে কাছে না পাওয়ার বেদনা তার বিরহ-যন্ত্রণাকে বাড়িয়ে দেয়। সেই বিরহ-যন্ত্রণার ছবি সুন্রভাবে ফুটে উঠেছে বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে---

    আষাঢ় শ্রাবণ মাসে মেঘ বরিষে যেহ্ন

    ঝর-এ নয়নের পানী

    আল বড়ায়ি।

    সংপুটে প্রণাম করি

    বুইলো সব সখিজন

    কহো নান্দো কাহ্নাঞিকে আনী।

মেঘ-বৃষ্টি নিয়েমহাকবি কালিদাসের অসামান্য সৃষ্টি মেঘদূত।’ নিজের কাজে আবহেলা করার জন্য কুবের যক্ষকে অভিশাপ দেয়। যে অভিশাপের কারণে যক্ষকে কাটাতে হয় রামগিরিতে। এক বৎসর কাল সে দেখতে পায় না তার প্রিয়তমাকে। প্রিয়া অদর্শনে যক্ষের হৃদয় ব্যাকুল হয়ে ওঠে। বিশেষ করে যখন আষাঢ় মাস আসে, আকাশের বুকে মেঘের ভেলা দেখা যায়, তখন তার বিরহী হৃদয় যেন আরও বেশি করে চঞ্চল হয়ে ওঠে। বিরহের শোক তার মধ্যে প্রবল হয়। কালিদাসের লেখায় এক জায়গায় রয়েছে—

        ‘পাশে প্রিয়তমা,-মেঘ দরশনে

        আকুল-ব্যাকুল তবুও হৃদয়,

        প্রিয়া যার দূরে তার পোড়া মনে

        কি অনল জ্বলে, বলিতে কি হয়?’ (অনুবাদ-অক্ষয়চন্দ্র পালিত)

প্রিয়া অদর্শনে বিপর্যস্ত যক্ষ মেঘকে দেখে স্থির করেন তার হাত দিয়ে সে তার প্রেয়সীর কাছে বার্তা পাঠাবেযক্ষের সেই ভাবনা কালিদাস ব্যক্ত করেছেন এইভাবে—

        আসিল বরষা’’ ভাবিয়া অন্তরে

        বাঁচাইতে নিজ দয়িতা-জীবন,

        স্বকুশল-বার্তা জলধর-করে

        পাঠাইতে যক্ষ করিল মনন!

        অভিনব গিরি-মল্লিকা তুলিয়া

        দিল অর্ঘ্য মেঘে পরম আদরে,

        প্রীত মনে প্রীতি-বচন কহিয়া

        তাহায় স্বাগত-সম্ভাষণ করে।।’(অনুবাদ-অক্ষয়চন্দ্র পালিত)

এরপর রয়েছে সেই বিখ্যাত শ্লোক, যেখানে কালিদাস দেখিয়েছেন যক্ষ কীভাবে মেঘের হাত দিয়ে তার প্রেয়সীর কাছে বার্তা পাঠাচ্ছে—

        ‘তাপিত জনের তুমি হে শরণ;

        কুবেরের কোপে এ বিরহ হায়!

        আমার বারতা করিয়া বহন

        প্রিয়া-পাশে তুমি যাও অলকায়।

        সেই অলকার চারু-উপবনে

        চিরসুখে বাস করেন শঙ্কর,

        তাঁর শিরস্থিত শশির কিরণে

        সুধা-ধবলিত প্রাসকাদিনকর।(অনুবাদ-অক্ষয়চন্দ্র পালিত)

বর্ষা শুধু হৃদয় বা মনে নয়, শরীরেও আলোড়ন তোলে। প্রেমিক-প্রেমিকা কিংবা নর-নারী একে-অপরকে পেতে চায় নিবিড় বাহু-বন্ধনে, শরীরী-সুখের স্বর্গীয় আলিঙ্গনে। ভালোবাসার সঙ্গে শরীরেরও একটা নিবিড় সম্পর্ক আছে। শরীরের চাহিদা এড়িয়ে রাখা যায় না, বিশেষ করে বর্ষায়। নারী-পুরুষের সেই নিবিড় সম্পর্কের কথা কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত সুন্দরভাবে ব্যক্ত করেছেন তাঁর ‘বর্ষাকাল’ কবিতায়—

        গভীর গর্জন করে সদা জলধর

        উথলিল নদ-নদী ধরনীর উপর

        রমনী রমণ লয়ে

        সুখে কেলি করে

        দানবাদি দেব যক্ষ সুখিত অন্দরে।’

বাংলা সাহিত্যের আলোচনায় আমরা দেখতে পাবো বিখ্যাত সকল কবি-সাহিত্যিক বর্ষার বন্দনা করেছেন। যেমন পল্লীকবি জসীমউদ্দিন তার ‘পল্লীবর্ষা’ কবিতায় লিখেছেন—

        ‘বাদলের জলে নাহিয়া সে মেয়ে হেসে কুটি কুটি হয়

        সে হাসি তাহার অধর নিঙারি লুটাইছে বনময়

        ...... ... .... .... ....

        আজিকে বাহিরে শুধু ক্রন্দন ছলছল জল ধারে

        বেনুবনে বায়ু নাড়ে এলোকেশ, মন যেন কারে চায়।’

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় ফুটে উঠে বিরহের সুর—

        বাদল রাতের পাখী

        উড়ে চল যেথা আজো ঝরে জল, নাহিক ফুলের ফাঁকি।’

এভাবে অমিয় চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব বসু, রোমান্টিক কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় থেকে শুরু করে বর্তমান প্রজন্মের কবিরাও বর্ষাকে নিয়ে সুন্দর সুন্দর কাব্য সৃষ্টি করেছেন।

    বর্ষার সঙ্গে গানের এক নিবিড় সম্পর্ক। ইতিমধ্যে দু-একটি গানের কথা বলা হয়েছে। আর দু-একটি গানের উল্ল্যখ না করলে নয়। প্রেমের আকুলতা, বিরহ আর মিলনের অসম্ভব সুন্দর ছবি বারে বারে উঠে এসেছে বর্ষা নিয়ে রচিত গানে। প্রিয়তমের জন্য দীর্ঘ্যদিনের প্রতীক্ষায় থাকা প্রেয়সীর চোখের জল নামে বর্ষার মতো। কিন্তু প্রিয়তম আসে না। আকাশের বুকে যখন মেঘের আনাগোনা, প্রকৃতির বুকে যখন বর্ষার আগমণী সংকেত, তখন প্রেমিকার হৃদয় অস্থির হয়ে ওঠে। সে চায় না বৃষ্টির জলে হারিয়ে যাক তার চোখের জলের দাগ। তাহলে প্রেমিক এলে বুঝতে পারবে না, কতখানি গভীর আকুলতা নিয়ে সে তার পথ চেয়ে কাটিয়েছে। তার প্রেমিক আসবে কিনা সে জানে না। কিন্তু তার বিশ্বাস, বর্ষা যেমন তার মনে আকুলতা জাগিয়েছে, তার প্রাণের মানুষও নিশ্চয়ই একইভাবে উদ্বেলিত হবে। তার মনের গহনে নিশ্চয়ই নাড়া দেবে তার স্মৃতি। নিশ্চয়ই সে ফিরে আসবে তার কাছে। আর যদি সে ফিরে আসে তখন যেন সে দেখতে পায় প্রিয়তমের অদর্শনে তার হৃদয় কীভাবে বর্ষণ-সিক্ত হয়েছে। অন্তরের বৃষ্টি-ছবি বাঁচিয়ে রাখতে বাইরের বৃষ্টির কাছে তাই সে গভীর আকুতি জানায়—

        ওগো বৃষ্টি আমার চোখের পাতা ছুঁয়ো না

        আমার এত সাধের কান্নার দাগ ধুয়ো না

        সে যেন এসেই দেখে

        পথ চেয়ে তার কেমন করে কেঁদেছি।’

বর্ষা প্রেমিক মনকে স্মৃতিমেদুর করে। মনের মধ্যে ভেসে ওঠে বর্ষার পরশমাখা অতীতের মধুর ছবি। বর্ষার সময় যদি প্রাণের মানুষ কাছে থাকে তখন সেই বৃষ্টির মধ্যে থাকে রোমাঞ্চকর ভালোলাগার অনুভূতি। কিন্তু যখন প্রাণের মানুষ জীবন থেকে হারিয়ে যায় তখন চেনা বর্ষাও যেন কেমন বদলে যায়। যে বৃষ্টিধারায় একসময় থাকতো প্রেমের মধুর পরশ, প্রিয়া বিহনে মনে হয় প্রকৃতির নিয়মে নয়, বিরহের যন্ত্রণা আর হৃদয়ের কান্নাই যেন বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে। বর্ষার সেই নস্টালজিক অনুভূতি সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে এই গানে—

        ‘এমনি বরষা ছিল সেদিন

        শিয়রে প্রদীপ ছিল মলিন

        তব হাতে ছিল অলস বীন

        মনে কি পড়ে প্রিয়?

        ...... ... ...

        হায় তুমি নাই বলে মোর সাথে

        তাই কি বিরহ বরষাতে

        এত বারিধারা আজ রাতে

        অঝোরে ঝরে প্রিয়?’

সংক্ষেপে বলার, আমাদের জীবন ও সাহিত্যের সঙ্গে অঙ্গাগীভাবে জড়িয়ে আছে বর্ষা। বর্ষা ছাড়া যেমন জীবন সম্ভব নয়, তেমনি বর্ষা ছাড়া সাহিত্যও অনেকটা ফিকে হয়ে যায়। তবে এখন বর্ষা তার আগের গরিমা অনেকটাই বোধহয় হারিয়ে ফেলেছেযন্ত্র-দানবের মাতামাতি, মানুষের লালসা আর অসচেতনতায় প্রকৃতি হারিয়ে ফেলেছ তার স্বাভাবিক ছন্দ, ঋতু হারিয়েছে রূপ, বৃষ্টি হয়ে গেছে খামখেয়ালি। বাড়ির উঠোনকে গ্রাস করেছে নিষ্ঠুর লোভ আর স্বার্থপরতা। বৃষ্টিধারা এসে আর সেখানে নদী হয়ে উঠতে পারে না। কাগজের নৌকোও আজ খুব দুর্লভ হয়ে গেছে। হাতের কুশলী ভাঁজে কীভাবে একটা কাগজের পাতা নৌকো হয়ে ওঠে, আজকের অনেক শিশু সে কৌশল জানে না। তাছাড়া কাগজ দিয়ে নৌকো বানানোর সময় তাদের কোথায়! প্রতিযোগিতার ইঁদুর দৌড়ে শিশুরা হারিয়ে ফেলছে শৈশব। পাশাপাশি বিনোদনের বহুবিধ যান্ত্রিক মাধ্যমের সহজলভ্যতা ও চটকদারিতা তাদেরকে বর্ষার মধ্যে আনন্দ খোঁজায় প্ররোচিত করে না। এতো গেল শিশুদের কথা। আজকের প্রেমিক-প্রেমিকাদের কাছে প্রেমের আকাঙ্ক্ষা জিনিসটা আগের সেই মাধুর্যতা নিয়ে আসতে পারে না। যোগাযোগের বহুবিধ যান্ত্রিক সহজ মাধ্যম এখন আর তাদের প্রতীক্ষাকে আবেগ-মথিত করতে পারে না। পাশাপাশি আরও নানাবিধ কারণ রয়েছে, যার ফলে বর্ষা প্রেমিক-প্রেমিকার মনকে আগের মতো উদ্বেলিত করতে পারে না। বর্তমানের অতি যান্ত্রিকতার যুগে তাদের মনে আবেগটাও যেন অনেকটাই হিসেবি হয়ে গেছে। তাই বর্ষা নিয়ে তাদের মধ্যে সেই আবেগ দেখা যায় না হয়তো। তবে এটাও ঠিক বর্ষাকে পুরোপুরি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। বর্ষা হয়তো প্রেম-বিরহ-যন্ত্রণায় তার আগের গরিমা হারিয়েছে, কিন্তু একেবারে নিষ্চিহ্ন হয়ে যায়নি তার রূপ। তাইতো, আজও বর্ষাকে নিয়ে গান-কবিতা সৃষ্টি হয়ে চলেছে। এখনও বর্ষার সময় একাকী হৃদয় বর্ষার গানে আপন মনে গুনগুনিয়ে ওঠে।

    সব শেষে বলি, যন্ত্র হয়তো বর্ষায় গরিমায় ভাগ বসিয়েছে, কিন্তু তাকে পুরোপুরি হারিয়ে দিতে পারেনি। আগামী সময়েও তা পারবে না। প্রকৃতি যতই খামখেয়ালি হোক, বর্ষা আসবে পৃথিবীতে। তার আশীর্বাদে পৃথিবীর বুকে যেমন বয়ে চলবে সৃষ্টির প্রাচীন ধারা, তেমনি করে আমাদের জীবন-সাহিত্য-গানে সে মিশে থাকবে তার অফুরন্ত সৃষ্টির ভাণ্ডার নিয়ে।