Friday, June 10, 2022

সুরেখা শংকর যাদব

সুরেখা শংকর যাদব

 

নিজের সত্যিকার সম্ভাবনার দিকটি আগে খুঁজে বের করো এবং তারপর তোমার স্বপ্নের পেছনে ধাওয়া কর। জীবনে কী অর্জন করতে চাও সেটা যদি প্রাথমিকভাবে ঠিকঠাক নির্ধারণ করতে পারো তাহলে বুঝবে অর্ধেকটা যুদ্ধ জেতা হয়ে গেছে। এর পরের কাজ হল নিজের সর্বোত্তম প্রচেষ্টা, কঠোর পরিশ্রম আর আত্মনিয়োগের মাধ্যমে সেই লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়া। তোমার এগিয়ে যাওয়ার সংকল্পকে দৃঢ় হতে হবে যাতে করে তা তোমাকে পেছনে টানার শক্তিকে পরাজিত করতে পারেযদি তুমি তা করতে পারো তাহলে তুমি সফল হবেই। ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়। তোমার ইচ্ছাশক্তিকে শক্তিশালী হতে হবে।”

---সুরেখা শংকর যাদব

 

ইন্টারভিউ রুমের সামনে বসে আছেন বেশ কয়েকজন চাকুরীপ্রার্থী। সবাই তার দিকে তাকাচ্ছিলেন কিছুটা অদ্ভুত চোখে। যে দৃষ্টিতে মিশে আছে তাচ্ছিল্য, সঙ্গে হয়তো একটু মজা আর কৌতুক। শেষমেষ একজন আর চুপ থাকতেই পারলেন না। জিজ্ঞেস করে ফেললেন, ভেবে দেখুন আপনি ঠিক জায়গায় এসেছেন তো?’ সেই জিজ্ঞাসার মধ্যে যে কিছুটা বিদ্রূপ মিশেছিল বুঝতে অসুবিধা হয়নি তার। জবাবও দিয়েছিলেন তিনি। তবে কথায় নয় কাজে। উপস্থিত সবাইকে হারিয়ে ইন্টারভিউতে সফল হয়ে তিনি কাজটা অর্জন করেছিলেনশুধু তাই নয় সেই সঙ্গে সঙ্গে ভারতবর্ষের দীর্ঘ রেলযাত্রার ইতিহাসে এক নজির স্থাপন করেন। তিনি সুরেখা শংকর যাদব যিনি প্রথম ভারতীয় মহিলা হিসেবে রেলগাড়ি চালিয়েছেন।

 

মহারাষ্ট্রের মেয়ে সুরেখা। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দের ২ সেপ্টেম্বর সাতারার এক গরিব কৃষক পরিবারে সুরেখার জন্ম। রামচন্দ্র আর সোনাবাই ভোঁসলের পাঁচ সন্তানের মধ্যে সুরেখা সকলের বড়ো। ছোটোবেলা থেকে সুরেখা স্বপ্ন দেখতেন বড়ো হয়ে শিক্ষিকা হবেন, ভবিষ্যৎ নাগরিকদের গড়ে তোলার মহান কাজে নিজেকে নিয়োজিত করবেন। পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি খেলাধুলোতেও বেশ দক্ষ ছিলেন। সেন্ট পল কনভেন্ট হাইস্কুল থেকে পাশ করার পর তিনি ডিগ্রি কোর্সে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান না। তাতে দমে না গিয়ে তিনি করাদের সরকারি পলিটেকনিক কলেজ থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ডিপ্লোমা করেন। এই কোর্সে তিনি ছিলেন একমাত্র মহিলা। ডিপ্লোমা কোর্স করার পর তিনি ওই বিষয়ে ডিগ্রি করতে পারতেন। ঔরঙ্গাবাদে তিনি সুযোগও পেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি ভর্তি হননি। তার লক্ষ্য ছিল বিএসসি ও বিএড করা। তাই তিনি কলেজে সায়েন্স নিয়ে ভর্তি হন।

 

একটা কাজের খুব দরকার ছিল সুরেখার। এই সময় ভারতীয় রেলের একটি বিজ্ঞাপন তার চোখে পড়ে। সহকারী রেল চালকের পোস্টের জন্য দরখাস্ত আবেদন করা হয়েছে। তাতে বলা হয় যে কোনো ধরনের ডিপ্লোমা থাকলে কেউ আবেদন করতে পারে। প্রসঙ্গত বলার ছোটোবেলা থেকে ট্রেনের প্রতি অদ্ভুত এক ভালোবাসা ছিল সুরেখার। কিন্তু কখনওই ভাবেননি ট্রেন চালাবেন। তাঁর অন্তরের সুপ্ত সেই ভালোবাসা বোধহয় তাকে তাড়িত করেছিল এই কাজের জন্য আবেদন করতে। পাশাপাশি ছোটোবেলা থেকেই তিনি ছিলেন ঝাঁসীর রাণী লক্ষ্মীবাইয়ের ভক্ত। তার সাহস সুরেখাকে অনুপ্রাণিত করত। সেই সাহসই তাঁকে মানসিক শক্তি জুগিয়েছিল এমন একটা সাহসী পদক্ষেপ নিতে। যাই হোক ১৯৮৭-এ তিনি মুম্বাইয়ের রেলওয়ে রিক্রুটমেন্ট বোর্ডের থেকে চিঠি পান। ইন্টারভিউতে তিনি ছিলেন একমাত্র মহিলা। পুরুষ প্রার্থীরা ভেবেছিল বোধহয় ভুল করে তিনি এসে গেছেন। কেননা কোনো মহিলা ট্রেনের চালক হওয়ার জন্য আবেদন করতে পারেন এ ছিল তাদের কল্পনার অতীত। শুধু তাদের কেন, কারুরই পক্ষে এমন ভাবনাটা ছিল বেশ কষ্ট কল্পনা। যাই হোক, এরপর লিখিত পরীক্ষা দেন তিনি। তারপর দীর্ঘ সময়ের বিরতি। কোনো ফলাফল আসে না। তিনি একপ্রকার ভুলতেই বসেছিলন। কিন্তু একবছর পর তাকে ভাইভার জন্য ডেকে পাঠানো হয়। ১৯৮৯-এ তাঁর মেডিক্যাল পরীক্ষা হয় এবং তিনি এই পদের জন্য নির্বাচিত হন।

 

এরপর ছয় মাসের ট্রেনিং শেষ করে তিনি মালগাড়ির সহ-চালকের দায়িত্ব পান। প্রথম যে ট্রেনের দায়িত্ব পেয়েছিলেন তার নাম এল-৫০। কল্যাণ থেকে ওয়াদি বন্দর হয়ে আবার কল্যাণে ফিরে আসা। চালক হিসেবে এই ছিল তাঁর প্রথম ট্রেন যাত্রা। বিভিন্ন দায়িত্ব সামলানোর পর ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি মালগাড়ির পূর্ণ চালকের দায়িত্ব পান। এরপরে তিনি যাত্রীবাহী ট্রেন চালানোর দায়িত্ব পান। ২০১০ খ্রিস্টাব্দে তিনি ঘাট-লোকো ড্রাইভার হিসেবে নির্বাচিত হন। পশ্চিমঘাট পর্বতমালার এই রেলপথে ট্রেন চালানো বেশ চ্যালেঞ্জের। তাই বেশ কিছু অফিসার তাঁর নির্বাচনে আপত্তি করেনকিন্তু সুরেখা তার প্রতিবাদ করে বলেন, “I have undergone the same training that most other men have. I was appointed and selected because I possess the potential. I know I can do it” এবং তিনি তা করে দেখিয়েছিলেনও। ২০১০-এর ১৪ এপ্রিল তিনি ছত্রপতি শিবাজী টার্মিনাস থেকে কল্যাণ পর্যন্ত লেডিজ স্পেশাল ট্রেন চালান। তৎকালীন রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই লেডিজ স্পেশাল ট্রেন চালু করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য মমতা ব্যানার্জি হলেন প্রথম ভারতীয় মহিলা যিনি রেলমন্ত্রী হয়েছিলেন। ২০১১ খ্রিস্টাব্দে তিনি এক্সপ্রেস ট্রেনের চালক হন। ওই বছর আন্তর্জাতিক নারী দিবসের দিন তিনি ডেকান কুইন চালানশুধুমাত্র ভারতীয় নয়, প্রথম এশীয় মহিলা হিসেবে তিনি এই ট্রেন চালানোর কৃতিত্ব অর্জন করেন

 

শিক্ষিকা হতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু হয়ে গেলেন ট্রেন চালক। আর তার মাধ্যমে দেশের রেলের ইতিহাসে তিনি এক অনন্য নজিরই কেবল স্থাপন করলেন না আগামী দিনের নারীদেরও এই পেশায় আসার পথ তৈরি করে দিলেনতিনি দেখিয়ে দিয়েছেন কাজের প্রতি ভালোবাসা, নিষ্ঠা আর আত্মত্যাগ থাকলে যে কেউ যে কোনো কাজে সফল হতে পারেন। সুরেখা শংকর যাবদ কেবল একটি নাম মাত্র নন; সুরেখা আসলে এক আলো, এক উজ্জ্বল অনুপ্রেরণা

 

No comments:

Post a Comment