Friday, June 10, 2022

জোহরা বেগম কাজী

 ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম মুসলমান বাঙালি চিকিৎসক

জোহরা বেগম কাজী

সৌরভকুমার ভূঞ্যা

 

বিংশ শতাব্দীর প্রায় শুরুর দিক ভারতবর্ষ তখন ইংরেজদের অধীন দেশের শিক্ষার হার তেমন উন্নত নয় ইতিমধ্যে নারী শিক্ষার সূচনা হলেও তার হার ছিল খুব খারাপ পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় অবহেলিত, বঞ্চিত নারীদের জীবন ছিল অন্ধবিশ্বাস আর কুসংস্কারে ভরা নিজস্ব স্বাধীনতা বলতে কিছু ছিল না তাদের সেই প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও কিছু কিছু মহিলা শিক্ষার আলোকে আলোকিত হয়ে কেবল ব্যতক্রমী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেননি, অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজে আলোকবর্তিকার মতো কাজ করেছেন তেমনই এক মহিলা হলেন জোহরা বেগম কাজী চিকিৎসাশাস্ত্রে আমরা যে সকল অসামান্য নারীর কথা জানি তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম ভারতীয় উপমহাদেশের তিনিই প্রথম মুসলমান বাঙালী মহিলা চিকিৎসক শুধুমাত্র চিকিৎসক হওয়া নয়, চিকিৎসাক্ষেত্রে বিশেষ করে মহিলাদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে তিনি অসামান্য অবদান রেখে গেছেন স্ত্রীরোগ এবং ধাত্রীবিদ্যায় তিনি ছিলেন কিংবদন্তী চিকিৎসক পরবর্তীকালে যিনি পরিচিত হয়েছিলেন ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল অব ঢাকা নামে

    জোহরা বেগম কাজীর জন্ম ১৯১২ খ্রিস্টাব্দের ১৫ অক্টোবর, মধ্যপ্রদেশের রাজনানগাঁওয়ে বর্তমানে এটি ছত্তিশগড়ের অন্তর্গত তাদের আদি নিবাস ছিল বাংলাদেশের মাদারিপুর জেলার কালাকিনি থানার গোপালপুর গ্রামে তাঁর বাবা ছিলেন কাজী আব্দুস সত্তার ও মা মোসাম্মদ আঞ্জুমানা নেসা আব্দুস সত্তার ছিলেন একজন চিকিৎসক ও রাজনীতিবিদ আব্দুস সত্তারের বাবা জমিরউদ্দিন ছেলেকে মৌলানা বানানোর অভিপ্রায়ে ভর্তি করে দেন ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসায় কিন্তু এখানকার পরিবেশ, পাঠদান পদ্ধতি একদম ভালোলাগেনি আব্দুস সত্তারের তাই এখান থেকে তিনি ঢাকা চলে যান এবং বাবার অমতে ভর্তি হন সদরঘাটের পগোজ স্কুলে ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে মিটফোর্ড মেডিক্যাল কলেজ থেকে তিনি এলএমএফ (Licentiate of Medical Faculty) ডিগ্রি অর্জন করেন এরপর তিনি কলকাতায় চলে আসেন ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে এখানকার কলেজ অব ফিজিসিয়ান অ্যান্ড সার্জেন থেকে সার্জনস্ অব ইন্ডিয়া ডিগ্রি অর্জন করেন যা বর্তমানের এমবিবিএস ডিগ্রির সমতুল্য একজন দক্ষ ও দরদি চিকিৎসক হিসেবে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে

    জোহরা বেগম কাজীর মা আঞ্জুমান নেসাও সাধারণ মহিলা ছিলেন না তিনি ছিলেন শেরেবাংলা একে ফজলুল হকের মাসতুতো বোন পড়াশোনার প্রতি তার বেশ আগ্রহ ছিল রায়পুর থেকে তিনি বিএ পাশ করেন তিনি একজন সমাজসেবীও ছিলেন রায়পুর পৌরসভার কমিশনার হয়েছিলেন তিনি প্রথম মহিলা হিসেবে তিনি এই পৌরসভার কমিশনার পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন

    বাবা-মায়ের ছয় ছয় সন্তানের মধ্যে জোহরা বেগম কাজী ছিলেন চতুর্থ তাঁর দাদার নাম কাজী আসরাফ মাহমুদ তিনি মাইক্রোবায়োলজিতে ডক্টরেট ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ে উদ্ভিদবিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলেন তিনি পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন প্রতিষ্ঠিত হিন্দি কবি জোহরার দুই দিদি অকালে মারা যান তাঁর ছোটোভাইয়ের নাম কাজী মোহাসাব মাহমুদ আর তাঁর ছোটোবোনের নাম শিরীন কাজী তিনিও চিকিৎসক হয়েছিলেন দিদি প্রথম হলে, তিনি ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের দ্বিতীয় মুসলমান বাঙালি চিকিৎসক

    বাবা-মায়ের দিক থেকে বাড়িতে এক সুন্দর শিক্ষার পরিবেশ পেয়েছিলেন জোহরা বেগম কাজী তাঁর বাবা উদারমনস্ক ছিলেন ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারেও তাঁর ছিল সমান নজর সেটাই জোহরা বেগম কাজীর জীবনে ছিল আশীর্বাদ স্বরূপ রায়পুরের বার্জিস মেমোরিয়াল মিশনারী স্কুলে জোহরার শিক্ষাজীবন শুরু তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী সমস্ত ক্লাসেই তিনি প্রথম হয়ে পরের ক্লাসে উঠেছেন এখানে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় সমগ্র বাইবেল মুখস্ত করে তিনি সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি আলিগড় মুসলিম মহিলা কলেজিয়েট স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাশ করেন ১৯৩১-এ আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি অ্যান্ড কলেজ থেকে আইএ পাশ করে ভর্তি হন হার্ডিঞ্জ মহিলা মেডিক্যাল কলেজে এটি তখন পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ছিল এখান থেকে তিনি ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জন করেন শুধু ডাক্তারি পাশ করা নয়, প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান লাভ করেন তিনি তাঁর এই কৃতিত্বের জন্য ব্রিটিশ ভারতের তৎকালীন ভাইসরয় টমাস ফ্রিম্যান কর্তৃক তিনি ভাইসরয় পদক লাভ করেন

    ডাক্তারি পাশ করে তিনি ইয়োথামান ওমেনস পাবলিক হাসপাতালে চিকিৎসকের কাজ শুরু করেন এখানে তিনি দশ মাস কাজ করেছিলেন এরপর তিনি বিলাসপুর সরকারি হাসপাতালে যোগ দেন পরবর্তীকালে তিনি মহাত্মা গান্ধি প্রতিষ্ঠিত সেবাগ্রামে অবৈতনিক চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেছেন প্রসঙ্গত বলার তিনি মহাত্মা গান্ধির অত্যন্ত স্নেহধন্য ছিলেন তার বাবার সঙ্গে বহু বিখ্যাত ভারতীয়র ঘনিষ্ঠতা ছিল তাঁদের মধ্যে মহাত্মা গান্ধি একজন খুব ছোটোবেলা থেকেই তিনি গান্ধিজির সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পেয়েছিলেন গান্ধিজির ছেলে রামদাস ছিলেন তাঁর দাদার বন্ধু গান্ধিজির স্ত্রী কস্তুরবা গান্ধিও তাঁকে মেয়ের মতো স্নেহ করতেন মুসলমান বলে কখনও তাদের আলাদা চোখে দেখতেন না নিজের সন্তানদের সঙ্গে একসঙ্গে বসিয়ে তাদের খাওয়াতেন ডাক্তারি ডিগ্রি লাভ করার পর গান্ধিজি তাঁকে আশীর্বাদ করে বলেছিলেন অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করে, নিজের আদর্শের প্রতি দৃঢ় সংকল্প থেকে কাজ করে যেতে বলাবাহুল্য সারাজীবন ধরে তিনি গান্ধিজির এই উপদেশ মাথায় রেখেছিলেন তাঁর বোন শিরীন কাজীও সেবাগ্রামে অবৈতনিক চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেছেন তিনিও গান্ধিজির স্নেহধন্যা ছিলেন শিরীনের বিয়ের সময় তাঁর বাবার অনুপস্থিতির কারণে গান্ধিজি কন্যাদান করেছিলেন

    ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে তাঁর বিয়ে হয় খ্যাতনামা রাজনীতিবিদ রাজুউদ্দিন ভুঁইয়ার সঙ্গে তিনি ছিলন নরসিংদী জেলার রায়পুর উপজেলার হাতিরদিয়ার জমিদারপুত্র পরবর্তীকালে তিনি সাংসদও হয়েছিলেন বিয়ের সময় জোহরা কাজীর বয়স ছিল ৩২ বছর তৎকালীন সময়ে কোনো মুসলমান মহিলার এত বেশি বয়সে বিয়ে হওয়াও এক ব্যতিক্রমী ঘটনা ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে রাজুউদ্দীন মারা যান তাদের কোনো সন্তানাদি ছিল না তবে সারাজীবনে জোহরা বেগম কাজী অনেক ছেলেমেয়েকে নিজের সন্তানের মতো করে মানুষ করেছেন স্বামীর মৃত্যুর পর তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে তিনি নরসিংদীতে হাতিরদিয়া স্কুল ও কলেজ স্থাপন করেন

    ১৯৪৭-এ দেশভাগের আগে পর্যন্ত তিনি ভারতবর্ষের বিভিন্ন হাসপাতালে ১৩ বছর কাজ করেছেন দেশভাগের পর তিনি তাঁর দাদা কাজী অশরফ মাহমুদ ও বোন শিরীন কাজীর সঙ্গে ঢাকায় চলে আসেন ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে আবাসিক চিকিৎসক হিসেবে যোগ দেন এখানে কাজে যোগ দেওয়ার পর জোহরা কাজীর জীবনে এক নতুন অধ্যায়ের শুরু হয় তিনি দেখেন এখানে ধাত্রীবিদ্যা ও স্ত্রীরোগের আলাদা কোনো বিভাগ নেই একজন মহিলা হওয়ায় তিনি বুঝতেন মহিলাদের চিকিৎসার সমস্যার কথা তখনকার মেয়েরা পুরুষ ডাক্তারের কাছে রোগ দেখাতে সঙ্কোচ বোধ করতেন তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যেত রোগ হলেও তারা চেপে যেতেন ফলে শরীরের জটিলতা যেমন বাড়ত তেমন অকালমৃত্যুর ঘটনাও ঘটত আকছার জোহরা কাজী বুঝতে পারলেন ধাত্রীবিদ্যা ও স্ত্রীরোগের আলাদা বিভাগ না হলে মেয়েদের উপযুক্ত চিকিৎসা পরিসেবা দেওয়া সম্ভব নয় তাঁরই প্রচেষ্টায় এখানে চালু হয় ধাত্রীবিদ্যা ও স্ত্রীরোগ বিভাগ পরবর্তী সময়ে মিটফোর্ড হাসপাতালেও চালু হয়

    কিন্তু শুধু এই বিভাগ চালু করলেই সমস্যা সমাধান হওয়া সম্ভব নয় কেননা শুধুমাত্র সঙ্কোচ নয়, নানাবিধ কুসংস্কারে আচ্ছন্ন মহিলারা হাসাপাতালে এসে চিকিসা গ্রহন করতে চাইত না জোহরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে মহিলাদের বোঝাতেন অসুস্থ মহিলাদের বুঝিয়ে বাসপাতালে ভর্তি করতেন নিজে নিয়মিত তাদের পরিষেবা দেওয়ার পাশাপাশি হাসপাতালের অন্যান্য ডাক্তার এবং নার্সেরা ঠিকমতো পরিষেবা দিচ্ছেন কিনা সে বিষয়ে তীক্ষ্ণ নজর রাখতেন এমনকি কখনও কখনও তিনি গভীর রাতেও হাসপাতালে গিয়ে হাজির হতেন অসুস্থদের খোঁজ নেওয়ার জন্য, তাদের ঠিকঠাক চিকিৎসা হচ্ছে কিনা সেটা দেখবার জন্য এইভাবে তিনি খুব অল্প সময়ে মানুষের অত্যন্ত প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন

    যাই হোক, ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে সরকারি বৃত্তি নিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি বিলেত যান লন্ডনের রয়েল কলেজ অব অবসটেরিসিয়ানস অ্যান্ড গাইনোকোলজিস্ট থেকে তিনি এফসিপিএস ডিগ্রি সম্পূর্ণ করেন এবং স্কলারশিপ পান এখানে তিনি তাঁর পড়াশোনা চালিয়ে যান এবং ডিআরসিওজি, এফআরসিওজি ও এমআরসিওজি ডিগ্রিও লাভ করেন প্রসঙ্গত বলার তাঁর বোন শিরীন কাজী ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে লন্ডন থেকে ডিআরসিওজি ডিগ্রি লাভ করেছিলেন এদিক থেকে শিরীন কাজী দিদিকে টেক্কা দিয়েছিলেন বলা যায় শিরীন কাজী হলেন প্রথম বাঙালী মুসলমান মহিলা যিনি লন্ডন থেকে ডাক্তারি ডিগ্রি পাওয়ার করার কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন।

    লন্ডন থেকে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করে জোহরা বেগম কাজী ঢাকায় ফিরে আসেন এবং ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের ধাত্রীবিদ্যা ও স্ত্রীরোগ বিভাগের প্রধান হিসাবে যোগদান করেন ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেন। এরপর তিনি হলি ফ্যামিলি রেডক্রস হাসপাতাল ও কমবাইন্ড মিলিটারি হাসপাতালে সিনিয়র কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ করেছেন

    জোহরা বেগম কাজী ছিলেন অত্যন্ত শৃঙ্খলাপরায়ণ ও সময়ানুবর্তী এতবড়ো একজন চিকিৎসক হয়েও খুব সাধারণ, নিরহঙ্কার জীবন কাটাতেন তিনি নিজে খুব পরিশ্রমী ছিলেন রুগীদের প্রতি যেমন তিনি যত্নশীল ছিলেন তেমনি ছাত্রছাত্রীদের ব্যাপারেও নিজের ভাবনা ও আদর্শ ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে চালিত করার চেষ্টা করতেন তিনি তাদের উপদেশ দিতেন প্রচুর পড়াশোনা করতে, নিজেদের দায়িত্ব ঠিকঠাকভাবে পালন করতে নিয়ম ভঙ্গ করলে যেমন তাদের প্রতি কঠোর হতেন আবার কেউ সাহায্য চাইলে নিজেকে উজাড় করে দিতেন ছাত্রছাত্রীদের বলতেন, “Don’t run after money, money will run after you and be sincere to your noble profession.” বহু ছেলেমেয়েকে তিনি নিজের খরচে পড়াশোনা করিয়েছেন পাশাপাশি দুঃস্থ, অসহায় মানুষদের জন্য তিনি সবসময় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন এককথায় গরিব ও পিছিয়ে পড়া মানুষদের সেবায় তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন আর এইভাবে কাজ করতে করতে একসময় তিনি ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল অব ঢাকা’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন

    সারাজীবনের কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি বেশকিছু সম্মান ও খেতাব পান যেমন তমঘা-ই-পাকিস্তান (১৯৬৪), বেগম রোকেয়া পদক (২০০৪), মরণোত্তর একুশে পদক (২০০৮), বিক্রম এ স্বর্ণপদক প্রভৃতি ২০০৭ খ্রিস্টাব্দের ৭ নভেম্বর তিনি পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে অমৃতলোকে যাত্রা করেন তিনি কিন্তু আপন কীর্তিতে তিনি চির ভাস্বর হয়ে থাকবেন আমাদের মনে

     

 

 

 

 

 

No comments:

Post a Comment