Tuesday, September 22, 2020

প্রাপ্তি - রুমেলা দাস

 প্রাপ্তি

রুমেলা দাস

 

নতুন জায়গা; নতুন শহর; নতুন অভিজ্ঞতা। যেন পুরোনো জামা কাপড়কে অনেকটা শীতের মিঠে রোদে মেলে দেওয়ার মত; শরীর, আত্মা সেই কবেকার অথচ সবটাকে সেঁকে নেওয়ার জন্য নতুনে খানিক এগিয়ে দেওয়া।

    একটা ঘটনা, সম্পূর্ণ আলাদা একটা মেজাজ নিয়ে অনেক ঘটনার সঙ্গে মিলে মিশে আমার অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎকে জাপটে জুপটে গেঁড়ে বসে আছে আজও। দিন যায়, সপ্তাহ যায়, মাস যায় অথচ বিশেষ ওই অংশটুকুর কোনো হেরফের নেই। রয়ে যায় একই রূপ, রস, গন্ধ নিয়ে। ভণিতায় না গিয়ে আসল কথায় ফিরে আসি; কী বলেন? বয়স আমার সত্তর ছুঁইছুঁই। তবু এখনও দিব্যি আমার তিন বছরের নাতিটার মত মনের কোণে আবোলতাবোল আঁকিঝুঁকি কাটি সেই দিনগুলোর।

    কথাগুলো বলতে গেলে আমার আপাততঃ লাইফ টাইম খাতার কয়েকটা আগের পাতা ওল্টাতে হবে। তাই সই-ই।

    আমি রমাপদ। পদবী জানা নেই; মানে আর পাঁচটা অনাথ শিশুদের ক্ষেত্রে যা হয় আমারও তাই। অর্থাৎ নাম পদবী অন্যের দেওয়া। অন্যের পছন্দমত। নামটা কচ্চিৎ ব্যবহার হলেও পদবী ব্যবহারের মায়া তাই আমার তেমন নেই। তবে বাবা-মা না থাকলেও খেতে পাওয়ার কপালটা একটু খোলতাই ছিল। কোনোমতে কোথা থেকে যেন চোখে পড়ে গেছিলাম শিউচরণ দাশের।

    নিপাট শান্তশিষ্ট ভালোমানুষ শিউচরণ থাকতেন দক্ষিণ কলকাতার কোনও এক বনেদি বাড়িতে। থাকতেন বলতে ওই ফাইফরমাস খাটতেন গোটা বসু পরিবারের। ভগবান ভক্তি তাঁর চরিত্রের একটা বিশেষ দিক তাই কাজের ফাঁকে ফাঁকে বসুবাড়ির ঠাকুরের থানেই তাঁর মন পরে থাকত বেশি। দিনান্তে কিংবা দুপুরের কোনও এক সময়ে যখন ব্যস্ত বাড়ির দালান খানিকটা নির্জন হত; কাজের লোকজন গা এলাত বিশ্রামে, শিউচরণ সেই একান্ত সময়টাতেই বাগানের শিউলি ফুল পেড়ে, কখনও গাঁদা ফুলে সূঁচ সুতো পরিয়ে ঠাকুরের সেবা করত চুপি চুপি। তবে তাঁর বুকে ধুকপুকানি চলত। ভয় হত, জাতিতে সে শুদ্র। কে জানে কর্তাবাবারা যদি আবার কোনও দোষ দেন। সত্যিকারের ব্রাহ্মণ ছাড়া এসব কাজ অপরাধের তো বটেই। তা শিউচরণের এই কান্ডকারখানা একদিন সত্যি সত্যি বাড়ির কর্তামশাইয়ের নজরে আসে। সরাসরি ডেকে পাঠান বড় কর্তা সুবিমল বসু। ভয়, দ্বিধা নিয়ে কাঁপা কাঁপা পায়ে তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়ায় শিউচরণ। ভাবে, 'কপালে কী আছে ঈশ্বর জানে; তিনকুলে কেউ নেই। গ্রামের ভিটে মাটি ছাড়ার পর শহরে বহুকষ্টে একটা কাজ যাওবা পাওয়া গেছিল, হয়ত নিজেরই বোকাম-র জন্যই হাতছাড়া হবে নাহলে কী আর তড়িৎঘরিৎ কর্তা এমনভাবে ডেকে পাঠান? নির্ঘাত কাজ থেকে বিদায় দেবেন!'

    কিন্তু মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক। শ্রীযুক্ত সুবিমল বসু শিউচরণকে ধমক দিলেন বটে, তবে সে ধমক ভালোবাসার। শিউচরণের এই লুকোনো কীর্তিই তাঁকে বসু বাড়ির অনেকটা কাছের করে দিয়েছে। সেদিন থেকেই কায়স্থ বাড়ির পুজোআচ্চার যাবতীয় দায়ভার গিয়ে পড়ল শিউচরণের কাঁধে। এ স্বয়ং ঈশ্বরের আশীর্বাদ ছাড়া আর কি? নাহলে এত বড় জীবনের প্রাপ্তি...! এমনটা মনে করেন শিউচরণ। কিন্তু আমার এতে ঘোর আপত্তি বিপত্তি সবকিছু। যা চোখে দেখা যায় না, যাকে অনুভব করারও কোনোরকম উপায় নেই। শাঁখ ঘন্টা বাজিয়ে তাকে পুজো করার মানেটা কী? আর সত্যি যদি কোথাও না কোথাও তিনি থাকতেন তাহলে আমি রমাপদ-র জীবনটা এমন তছনছ হত? বাপ-মা এভাবে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে রেখে যেতে পারতেন আমাকে? কোথায় আমার বাড়ি? আমার ধমনীতে কার রক্ত? কোনদিনই জানতে পারব না। এ যে কত বড় ব্যর্থতা।

    ঠাকুর বলে আদপে কিছু আছে কিনা জানি না; আসলে আমার ওসবে বিশ্বাসটাই তৈরি হয়নি কোনওদিন। কিন্তু জ্ঞান হওয়া ইস্তক বারবার শিউচরণ আমার পালিত বাবার কাছে শুনেছি, 'বিয়ে থা করলুম না। দেখলি ঠিক জগৎজননী মা আমাকে সন্তান দিয়ে দিল। কত বড় পুণ্যি বলে বোঝাতে পারব না। মা সবার দুঃখু বোঝে। এক জীবন কারুর পুরো ভাল পুরো মন্দে কাটে না। প্লাসে মাইনাসে কাটাকাটি হয়ে ফল 'শুন্য' নিয়ে যেমন ধরাধামে আসা, তেমনই 'শুন্য' নিয়েই ফিরে যাওয়া। এ হিসেব সবার জন্য। কারুর কম বেশি নয়।'

    আমার এসব কথাবার্তা শুনতে একদম ভালোলাগত না। বসুবাড়ির ঠাকুর দালানের পাশের ছোটখাটো স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে শিউচরণের সঙ্গে থাকতে থাকতে ছোট থেকেই আমার দম বন্ধ করে আসত। মনে হত, 'ধুর না জানি আরও বেশি কিছু প্রাপ্তি আমার জীবনেও ছিল।' চারপায়ের ঘরটা হয়ত আমাকে সেসব থেকে অনেকটা দূরে সরিয়ে রেখেছে, কেন জানি না ছোট মনেই আমার বড় হওয়ার অনেক বড় বড় বাসনা ছত্রাকের মত গজিয়ে উঠেছিল। আমি খাঁচায় বন্দি পাখির মত ছটফট করতাম, কখনও অস্থির পায়ে ছুটে বেরিয়ে যেতাম ঘর থেকে। কিন্তু এর সঙ্গে একটা ব্যাপার আমার এখন এই ভেবে আশ্চর্য লাগে যে সেসময় আমার এগুলো ভাবার কোনো কারণই ছিল না, কারণ বড় হওয়ার বিশেষ করে আরামি রোজনামচার সংজ্ঞাটা ঠিক যে কি তাতো আমি জানতামই না। তবে?

    বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, 'যে প্রাণী মানুষের রক্তের স্বাদ পায়, সেই তো নরখাদক হয়। রক্তের স্বাদ যতক্ষণ না পায় ততক্ষণ প্রাণীর হাজার খিদে পেলেও সে মানুষ মারতে শেখে না।' তাহলে এই 'আমি'র মাঝে অন্য 'আমি'টা কে? যে আমাকে ছুটিয়ে বের করত ঘর থেকে, বাবার মত ভালোবাসার মানুষটার বুকে আশ্রয় নিয়েও ঘুম ছুট চোখে নেশা ধরাত কোনো নেশালু রঙিন রাতের। একটু একটু করে জেগে ওঠা এই 'আমি' ঠিক কী চায়?

    বসুবাড়িতে ছিল অনেকটা পুরোনো কলকাতার জমিদারবাড়ির মত আদব কায়দা। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখতাম সে বাড়ির বেশ কয়েক প্রজন্ম আগের বৈভবের দিকে। ছুঁয়ে দেখতাম নাচঘরের ইঁট। দালানের দামি দেওয়াল পাথরের মিলিয়ে যাওয়া ঐশ্বর্য। আর আমার ভেতরে চিকচিকিয়ে উঠত ডানা বুজে বসে থাকা সেই 'অন্য আমি'-র ঝলমলে অসংখ্য বুদ্বুদ।

    বড় হতে হতে দেখেছিলাম সে বাড়ির বড়কর্তা পরলোকগমন করার কিছু আগে থেকেই বাড়িটা যেন একটু একটু করে মিইয়ে যাচ্ছে। বুঝতে পারছিলাম যে যার প্রাপ্য বুঝে নিজস্ব সামিয়ানা গড়ার নেশায় ছিটকে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কেউবা দেশের বাইরেও। তাও মাঝেমধ্যে ছিটকে যাওয়া বংশধরেরাও আসত বাড়ির সঙ্গে শেষ নাড়ির টানে। আমি ওঁদের লক্ষ করতাম মন দিয়ে। বেশিরভাগই যখন দামি গাড়ি, দামি পোশাক হাঁকিয়ে বছরান্তে সামনের নুড়ি বিছানো রাস্তা মাড়িয়ে চাকায় কড়কড় শব্দ তুলে বাড়িতে ঢুকত। আমারও বুকের ভেতর ছলাৎ করে উঠত। দালান পাশের ছোট্ট ঘর থেকে উঁকি দিয়ে ভাবতাম, 'আমাকেও ওমন গাড়ি হাঁকাতে হবে। অমন দামি আদপ কায়দা রপ্ত করতে হবে।'

    কী করে জানি না সেই অন্য 'আমি'টা আমাকে অস্থির করে তুলছিল এভাবেই বছরের পর বছর ধরে।

    আমি সামান্য মানুষ। তাকে উপেক্ষা করার সাধ্য আমার নেই। তাই 'অন্য আমি'কে আমিও একটু একটু করে নিজের ভেতর নিঃশব্দে শেকড় গাড়তে দেখেছিলাম। স্কুল পাশ করার পর বেজায় চেষ্টা চরিত্র করে, প্রয়োজনে নানা লোকের তৈলমর্দন করে কলেজ পাশ, এমনকি এমবিএ পর্যন্ত পড়ে ফেলেছিলাম। বড় হওয়ার পথে কোনও দ্বিধাই আমাকে আটকাতে পারেনি। না পেরেছিল কোনও ভালমানুষির সংশয়। কোনও কিছুর তোয়াক্কা না করেই কলকাতার বাইরেই থেকে গেছিলাম প্রায় দশ-দশটা বছরবুঝতে পারছিলাম এগিয়ে যাওয়ার যাবতীয় উপায় বাতলানোর সঙ্গে সঙ্গে আমার যা-কিছু ইমোশন সব যেন আলগা হয়ে যাচ্ছে। রীতিমত ঘাম ঝরিয়ে চেষ্টা চরিত্র করে ভাল আইটি জবও হয়েছিল হায়দ্রাবাদে এসে। নাহ পদবী বা বাবা-মায়ের নাম নিয়ে কেউ কোনও ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করত না। সত্যি কথা বলতে কী কেউ আমাকে চট করে ঘাঁটাতে আসত না, নিতান্ত ছাপোষা গোবেচারা তকমাটা যে আমি দাঁত দিয়ে টেনে ছিঁড়ে ফেলেছিলাম। পায়ের নীচের শক্ত জমিটা যে শুধু সৎ থেকে রেজাল্ট দিয়ে করা যায় না; সেকথা আমি ছাড়া আর ভাল করে কেই বা জানবে? আমার না-হয় নেহাৎ বংশ পরিচয় নেই, কিন্তু হাই-ফাই রেজাল্ট করা পাড়ারই সত্যিজেঠুর ছেলে কৌশিকের কী হাল? বেচারা মার্কস গলায় ঝুলিয়ে বসে আছে। চাকরির ত্রিসীমানায় যেতে পারছে না। লিস্টে নাম ওঠা সত্ত্বেও কোনও চেনা জানা হাত ওর থেকে বিশ-পঁচিশ নম্বরের নীচের ছাত্রকে ওপরে তুলে দিয়েছে। আর ওর বাবা সরকারি চাকরি করেও এক পয়সা হাতটান করেননিতাইতো মনে মনে ওনাকে সত্যিজেঠু নাম দিয়েছিলাম। নাও এবার ঠেলা সামলাও। বেঁচে থাকো চিরকালীন মধ্যবিত্ত মেন্টালিটি নিয়ে। আর ভাগ্যকে দোষ দাও।

    সবকিছু মোটামুটি ঠিকঠাক করার পরে আমি নতুন শহরে এসে পড়েছিলাম। ভালই চলছিল। কিন্তু হঠাৎই একটা সমস্যায় পড়ি। ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। কাউকে ঠিক বলাও যাচ্ছিল না। এককথায় রাতের ঘুম উড়ে গেছিল।

    নিজামের শহর, হায়দ্রাবাদ। পুরোনো ঐতিহ্যের পাশাপাশি ভারতের আইটি হাব-ও বটে তাই থাকার জায়গার জন্য বিশেষ কাঠ-খড় পোহাতে হয়নি। ঘর পেয়ে যাই ডিল্যাক্স বয়েজ হোস্টেলেই। হোস্টেল থেকে হাঁটা পথে অফিস। মাঝে মধ্যে রাতের ডিনার হায়দ্রাবাদী বিরিয়ানি। জমিয়ে ভালমন্দ খাওয়া বেশ চলছিল।

    আচমকাই একটা ঘটনা ঘটল।

    এখানকার মেন রোডে গাড়ি চলাচল করে সাংঘাতিক। যেহেতু এখনও নিজস্ব যানের ব্যবস্থা করে উঠতে পারিনি আর হোস্টেল থেকে অফিসের দূরত্বও খুব একটা বেশি নয় তাই একটা গলিপথ খুঁজে বের করি। সেটা দিয়েই দু'বেলা যাতায়াত করতাম। বেশ নিঝুম আর ছায়া ছায়া জায়গা। চারধারে যেমন ফ্ল্যাট বাড়ির বহর এখানে তেমনটা নেই। মনে মনে একটু অবাকই হয়েছিলাম। কারণ প্রতি সেকেন্ডে উন্নতির শিখরে ওঠা শহরটা যেভাবে মানুষ থাকার বস্তিতে পরিণত হচ্ছে তাতে খুব বেশি দিন এই একটু ফাঁকা জায়গাও যে আর অবশিষ্ট থাকবে এমন কথা মনে হয় না। অবশ্য তাতে আমার কী এল গেল। বাকিদের মত আমিও এসেছি কামাতে। থাকব, খাব, কামাব। এর বাইরে দুনিয়াদারির খবর রাখতে গেলে আর বাঁচতে হবে না। মাথা থেকে আলফাল চিন্তা ঝেড়েই ফেলেছিলাম প্রায়।

    একদিন অফিসে যাওয়ার সময়টায় দেখি আমার সামনে দিয়ে কেউ যেন চেনাপরিচিত ভাষায় কথা বলতে বলতে যাচ্ছে। বাংলা? তার মানে বাঙালি। এখানে বাঙালি বেশ ভালই আছে, আসলে কলকাতা বা আশপাশ থেকে অনেকেই তো আসেন জব জয়েন করতে। তাদের কেউ কেউ পরিবার নিয়েও থেকে যান এই শহরে। দেখলাম বাচ্চাটা মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে টলমল হাতে একটা রঙিন ছাতা কোনওমতে নিজের মাথার ওপরে ধরে আছে। আর খুব কথা বলে যাচ্ছে পাশের হাত ধরা মানুষটার সঙ্গে। ব্যাপারটা খুবই সাধারণ। বাচ্চাটা স্কুলে যাচ্ছে। এমন প্রায় মাস খানেক ধরেই দেখি। আমি চলার পথে খানিকটা হেঁটে এগোলেই একইভাবে বাবা-বাচ্চা হাত ধরাধরি করে আমার ঠিক নাক বরাবর এসে হাজির হয়। আমতা আমতা শিশু গলায় পরিচিত কথা ভেসে আসে কানে। তবে অফিসের তাড়া থাকায় ভাল করে ওদের কথা খেয়াল করিনি কোনদিনই। তালগোল পেয়েছিল তারও কয়েকদিন বাদে। সেদিন অফিসে তাড়া ছিল। কী যেন একটা প্রজেক্ট মিটিং ডেকেছিল অফিস আওয়ার্সের আগেইআমি গলিপথে আসতেই দেখি আমার সামনে সামনে ওরা চলেছে! বাচ্চাটার স্কুল কী আজ আগে শুরু হবে? এত সকালে? তাড়াতাড়ি ওদের পাশ কাটিয়ে এগোতে গিয়েই দেখি ওরা নেই।

    মানে?

    ব্যাপারটা কী হল?

    ভ্যানিশ?

    এই তো ছিল। অফিসে দেরি হচ্ছিল তাও এগিয়ে গিয়েও সেকেন্ডের জন্য পেছনে তাকালাম। নাহ নেই...। কোত্থাও নেই। কী জ্বালা। সেদিন মাথায় এত কাজের প্রেশার ছিল ব্যাপারটা নিয়ে অতটা জলঘোলা করে ভাবিনি। তারপরের চার-পাঁচদিন একইরকম ব্যস্ততায় কেটেছে। রোজ-ই বাড়ি থেকে তাড়াতাড়ি বেড়িয়েছি, মনে মনে অবাক হয়েছি। প্রতিদিনই একইভাবে ওরা আমার সামনে এসেছে আবার আমি এগিয়ে গেলে হারিয়েও গেছে। নিজেকে ক্রমাগত বুঝিয়েছি সবটাই হয়ত বা আমার মনের ভুল। কিন্তু তাই বা কী করে হয়? এতদিন ধরে যে দু'দুটো জলজ্যান্ত মানুষ চোখের সামনে হেঁটে গেছে। চিন্তাগুলো ঘোঁট পাকছিল। আচ্ছা যখনই দেখেছি ওরা সামনে দিয়ে হেঁটে যেত এটা কী খেয়াল করেছি ওরা আসত কোথা থেকে? যে গলিটা ধরে চলাচল করি সেটার ডায়ে-বাঁয়ে অন্য কোনও গলিপথ তো নেই; তবে? রীতিমত সোজাই একটা পথ গিয়ে উঠেছে বড় রাস্তায়। তাহলে কি এতদিন আমি ধাঁধার মধ্যে ছিলাম? চরম ভাবনায় কুঁচকে আসছিল ভ্রু'র সোজাসুজি দুটো সমান্তরাল রেখা।

    রাতে ঘুমাতে গেলেও ছেলেটার বকবক আর ওর হাতে ধরা রঙিন ছাতাটা মনে পড়ে যাচ্ছিল বারবার। ঘুম আসত না চোখে। বারবার মনে হত ওরা দু'জন যেন আমার ধারে কাছেই আছে। আমি ওদের শরীরের তাপ পাচ্ছি। ওদের অদৃশ্য অনুভব যেন সমস্ত 'আমি'কেই ঘিরে রয়েছে। আমার 'আমি' ভয় পাচ্ছে; পিছু হটছে। কিন্তু কেন? কেন এসব হচ্ছে আমার সঙ্গে? কেমন একটা অসহায় অবস্থা। রাতে দিনে যখনই একটু একা একটু নিজের সঙ্গে থাকার অবসর আসে ঠিক তখনই ঠিক সেই মুহূর্তেই ভাবনারা তালগোল পাকাতে থাকে।

    এরকমই একটা দোলাচল অবস্থার মধ্যে ভোররাতের দিকে একটা স্বপ্ন দেখি;

    নামেই স্বপ্ন। স্বপ্ন যে এত স্পষ্ট, এত পরিষ্কার হয় আমার জানা ছিল না। সেটা যে ঘুম ভাঙার পরে এভাবে মনেও থাকতে পারে সাতাশ বছরের জীবনে তাও জানা ছিল না আমার। মনের মধ্যে একটা অস্বস্তি দানা বাঁধছিল। কিছু যেন একটা; কিছু যেন একটা আটকে ছিল গলার কাছটায়। ভাবনা, দোনামনা চরম টানাপোড়েনে হটাৎ মাথার মধ্যে চিড়িক করে ওঠে; ঝাপসা ঝাপসা চেনা কিছু ছবি ভেসে ওঠে সামনে।...সত্যি? নিজের চেনা ছবিগুলো নিজেরই বিশ্বাস করতে বাঁধছিল। তবে কি?

    কোথায় দেখেছি, কোথায় দেখেছি মনে করতে করতে মনে পড়ে গেছিল ঠিক ঐরকমই একটা লাল-নীল রঙিন ছাতা। আলতো ডগমগ হাতে যেটা প্রায়ই চোখে পড়ত বাচ্চাটার হাতে। হ্যাঁ ঠিকই। একেবারে হুবহু। এতো ছেলেবেলায় আমারও ছিল। সঙ্গে করে নিয়ে স্কুলেও যেতাম। কিন্তু তারপর... স্কুলের দিব্যেন্দু, শ্যামলরা যে দামি রেনকোট পরে আসত, কখনও বা ওদের হাতের অন্যরকম ছাতা দেখে হাত পা ছুঁড়ে বায়না করতাম বাড়ি এসে। বেশ মনে আছে এরকম একদিন বায়নার শেষে নাওয়া খাওয়া ছেড়ে আমি যখন মেজাজ দেখিয়ে ঘরের মেঝেতে বসে, বাবার মত মানুষটা বলেছিল, 'যা আছে তাইতেই ভাল থাকার চেষ্টা করিস। যা হয় না তাকে জোর করে আঁকড়াতে যাস না। তা দেখে কখনও লোভ করিস না; দেখবি ধৈর্য্য ধরলে মা তোকে সব দেবে। খেয়ে নে বাবা।'

    শুনিনি আমি কিছুই শুনিনি সেদিন ছাতাটাও যে কোথায় হারিয়েছিলাম নাকি কোথাও ফেলে দিয়েছিলাম ঠিক মনে করতে পারছি না। কেন মনে পড়ছে না আর কিছু...?

    আজ এতবছর পর এসব হটাৎ করে মনেই বা আসছে কেন আমার? এইরকম রঙিন ছাতা হাজার একটা ছোট শিশুর-ই তো থাকতে পারে! তবে...? মনকে বোঝাচ্ছিলাম। শান্ত করবার চেষ্টা করছিলাম কিন্তু পারছিলাম না। কেমন যেন মনে হচ্ছিল আমার 'আমি' ডুকরে কেঁদে উঠছে। কিছু একটা 'নেই' আমাকে সবকিছু থেকে নিঃসঙ্গ দীন করে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত!

    বুকের ভেতরটা চলকে উঠছিল কোনও অজানা কারণেই।

    রাতশেষ হয়ে আসছিল। দেখি লাল থালার মত সূর্য কালো আকাশ সরিয়ে একটু একটু করে তার আলো আভা ছড়াচ্ছে। সকাল হয়েছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি অফিসে যাব বলে তৈরি হয়ে নি। আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে আমার মনের কোণে উঁকি দেওয়া সন্দেহগুলো পিছিয়ে পড়ছিল। সাধারণ সহজ বাস্তব মেনে আমি মনে মনে ঠিকই করে নিয়েছিলাম আজ আমাকে যে করেই হোক ওই ছোট্ট ছেলেটা আর ওর বাবার সঙ্গে কথা বলতেই হবে। সবকিছু থেকে নিজেকে সরিয়ে নয়, সবকিছুর সামনে থেকে বাস্তবটাকে মেনে নিতে হবে।

    এই ক'দিনের টানা দুশ্চিন্তায় মনে জেদ আনলেও শরীর যেন কোনোভাবেই সায় দিচ্ছিল না। মাথা ভার হয়েছিল। চোখ জ্বালা করছিল বিনিদ্রায়। কোনোমতে পা টেনে টেনে পৌঁছে যাই নির্জন গাছগাছালি ঘেরা মাঠের মাঝের রাস্তাটায়। ফোনে সময় দেখে বুঝি রোজ যে সময়ে আমি বেরোই তাড়াহুড়োতে তার থেকে বেশ অনেকটা আগেই চলে এসেছি। কিন্তু যতই আগে আসি না কেন; ওদের দেখে তবেই আমি যাব ঠিক করি। অপেক্ষা করি একঘন্টা। কিন্তু নাহ ছোট্ট ছেলেটা, ওর বাবা কাউকেই দেখিনি সেদিন। মনের মধ্যে যে কী অসম্ভব অস্থিরতা কাজ করছিল সেসময় বলে বোঝাতে পারব না। আমিও দমে যাওয়ার পাত্র নয়। জীবনে কম ঝড় পেরিয়ে আসিনি। বাপ-মা বংশপরিচয় ছাড়া এই সমাজের বুকে মাথা তুলে তো দাঁড়িয়েছি। কেউ আমাকে হাতে তুলে সুযোগ তো করে দেয়নি? মনের সঙ্গে যুদ্ধ করে যাচ্ছিলাম অবিরাম। বারবার মাথা তুলে দাঁড়াতে চাইছিলাম। কিন্তু বারবারই মনে হচ্ছিল কেউ যেন আমার হাঁটু দুটোতে অদৃশ্য হাতুড়ি মেরে ভেতর ভেতর দুর্বল করে দিচ্ছে। একবার মনে হল আমি কী পাগল হয়ে গেলাম? তাও এত সামান্য একটা কারণে? কই এতদিন তো এমন কিছু হয়নি। রোজ-ই সকালবেলা ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করতাম। ফিরে আসতাম। আবার যেতাম। কিন্তু এরপরের একটামাসেও আমি ওদের খুঁজে পাইনি। বা বলা ভাল আমি ওদের হারিয়ে ফেলেছি চিরদিনের মত। যেমন হারিয়ে ফেলেছিলাম আমার ছোট্টবেলার সেই হুবহু দেখতে রামধনু ছাতাটাকেও। অসহনীয় একটা কষ্ট বুকের মধ্যে হাঁকপাক করছিল।

    এতদিন ওই জায়গায় অবান্তর ঘোরাফেরা করতে দেখে একজন স্থানীয় লোকের কৌতূহল হয়েছিল, কথায় কথায় সে জিজ্ঞাসা করেছিল আমি কিছু খুঁজছি কিনা। কীই বা বলব? স্পষ্ট করে কিছুই উত্তর দিয়ে উঠতে পারিনি আমি। লোকটা বেশ কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়েছিল, জঙ্গলের পাশে গাদা হয়ে পড়ে থাকা ভাঙাচোরা পরিত্যক্ত একটা বাড়ি দেখিয়ে বলেছিল,

    'বহু বছর আগে নাকি এখানে কীসের পুজো হত। কোনো পাগলা সাধু পুজো করত পাথুরে মূর্তিতে। কালের স্রোতে সেসব কবে হারিয়ে গেছে। কিন্তু এখন জমি জায়গার যা চাহিদা ফাঁকা কী আর কিছু থাকে? কিন্তু কপালের এতই ফেরএই জায়গাটা যতবারই প্রমোটার নিতে এসেছে। ততবারই কোনও না কোনও সমস্যায় পড়েছে। তাই এখন আপাততঃ এদিকটায় কেউ নজর দেয় না।' আমাকে ঘোরাফেরা করতে দেখে লোকটা সেরকমই প্রমোটারের শাকরেদ বলে হয়ত ভেবেছিল।

    কথাগুলো শুনে হাত পা ঘেমে উঠছিল। মনে হচ্ছিল আমার গোটা শরীরটাকে মাটির সঙ্গে কেউ পুঁতে দিচ্ছে একটু একটু করে। এও কি বিশ্বাসযোগ্য? লোকটা হয়ত আমাকে নেহাতই বুরবাক বানাচ্ছে। নিজের ওপর নিজেরই রাগ ধরছিল কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে একটা পুরোনো অপরাধবোধও আমার শরীরটাকে নিস্তেজ করে দিচ্ছিল। যেন দুই ভিন্ন 'আমি'র মাঝে একটামাত্র ইচ্ছে শক্তি নিয়ে সেতু হয়ে দাঁড়িয়ে আছি।

মাথার ঠিক রাখতে পারছিলাম না। সমস্ত কাজ ফেলে অফিসে গিয়েই একে ওকে ফোন করে জোগাড় করেছিলাম একটা ফোন নাম্বার।

    একটা চেনা অথচ ভুলে যাওয়া ফোন নাম্বার।

    ডায়াল করেছিলাম ঘামে ভিজে ওঠা কাঁপা কাঁপা হাতে। গলাটা কেমন যেন শুকিয়ে আসছিল। প্রাণটা অল্প মুহূর্তের জন্য আটকে ধুকপুক করছিল ঠিক কন্ঠির কাছটায়।

    ফোনের ওপার থেকে একটা গলার আওয়াজ শুনেছিলাম। চেনা অথচ ভুলতে বসা একটা গলার আওয়াজ।

আজ অনেকগুলো বছরের পর; হ্যাঁ ঠিকই সেই সেই ভদ্রলোক; যিনি আমাকে আপন করে সহবত শিখিয়ে শুধুমাত্র মানুষ করতে চেয়েছিলেন। কিছু না হোক অন্ততঃ ডাল ভাত জুটিয়ে নিয়ে একজন মিশে থাকা আটপৌড়ে মানুষ।

    বিশ্বাস করুন একটা কথাও স্বর হয়ে ফুটে উঠছিল না আমার গলায়। আমি যে কথা বলতে পারি সেটাই ভুলতে বসেছিলাম সেইসময়।

    কেন জানি না ওপার থেকে সেই চিরচেনা কন্ঠস্বরটা বলে উঠেছিল, 'কথা বল। আমি যে জানতাম তুই নিশ্চয়ই একদিন আমাকে মনে করবি। লজ্জা কিসের? কথা বল বাবা। দেখ আমি কিন্তু তোকে ভুলিনি;  কবে আসবি বাবা? তোর বাবা শিউচরণ যে কবে থেকে পথ চেয়ে আছে। আর যে শরীর দেয় না এখন।'

    কী জানি কেন একগাদা জল ভিড় করে আসছিল চোখে, জিজ্ঞাসা করেছিলাম, 'বাবা আমার সেই লাল নীল ছাতাটা...।'

    'ঐতো এখনও আমার খাটের পাশে রাখা...' উত্তরে বয়স্ক মানুষটা বলেছিল।

    নতুন শহর আর আমাকে আটকাতে পারেনি। কলকাতা ফিরে আসি চিরদিনের জন্য কিন্তু যাবার আগে ওই ঝিমঝিমে নির্জন পথে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম আরও একবার। চোখ মেলে তাকিয়েছিলাম চারদিক; হয়ত কিছু খুঁজেছিলাম।

    লতাপাতা সবজে গাছের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে থাকা একচিলতে আকাশটার দিকে তাকিয়ে মনে মনে জিজ্ঞাসা করেছিলাম,

    'ঈশ্বর কি সত্যিই আছেন...?'


 

1 comment: