Thursday, September 24, 2020

সাক্ষাৎকার - সুনীল মাজির সাক্ষাৎকার

কবিতার রক্তমাংস

 

কবি সুনীল মাজির সাক্ষাৎকার

মেঘপালক পত্রিকার পক্ষ থেকে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন কবি শুভঙ্কর দাস

 

মেঘপালক : কবিতা কী ?

 

সুনীল : সংকীর্ণ অর্থে বা মুখের ভাষায় কবিতা এক ধরণের শিল্পকলা আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের অনুভবকে বা কাঁচামালকে মাথার আগুন দিয়ে জারিত করে ইচ্ছার নির্মাণ ঘটায় মেধাবী মননে শব্দ যাপন ভাবনাকে পরিশুদ্ধ ভাবে প্রকাশ করতে যে যত পারফেক্ট সে তত হাততালি/বাহবা/সাবাস

 

বৃহত্তর অভিজ্ঞানে কবিতা হলো ঈশ্বর সে হৃদিপদ্ম বা হৃৎকমলসে অনন্ত সে ব্রহ্ম স্বরূপ সে আত্মার মতো তার রূপ নেই প্রত্যেক জীবের ভেতর যে আনন্দ যে সৌন্দর্য থাকে তাকে কিছু শিল্পী বা স্রষ্টা বা ভাবনার ঈশ্বর  নিজের  মতো করে রূপ দিতে চান তিনি স্বপ্ন দেন এই চেতন এই অবচেতন ভেতরে তখন আকাশ আকাশ খেলা সমুদ্র সমুদ্র খেলা আকাশে আলো খেলে সমুদ্রের গভীরে ছায়া খেলে সে এক মহাশক্তি মহাশ্বেতা মহাচেতনা সে আগুনের গভীরে জ্ঞান সাগরের তলদেশে নির্জ্ঞান সমাধিস্থ নির্জনতাকে যিনি স্পর্শ করতে পারেনি তিনি শ্রী সব কবিতাই তাই শ্রীশ্রী তার নাম নেই  দ্বিতীয় নাম তৃতীয় নাম নেই যিনি নিজের নাম ভুলে যান কবিতা তাকে মায়ের  মতো  সন্তানের মতো আদর দেন সেবা দেন কবিতার  কাজ তাই সেবাই পরমধর্ম

 

মেঘপালক : কবিতার যদি  জন্ম থাকে, তাহলে কি মৃত্যু আছে ?

 

সুনীল : দুই ভাবে কবিতা লেখা হয় শব্দ দিয়ে আর নৈশব্দ দিয়ে যে কবিতা শব্দ দিয়ে লেখা হয় সেই কবিতা এই ঘরদোর বাগান উঠোন নদীনালা পুকুরমাঠ টাকাপয়সা ফুলদানির গন্ধে বাতাসের  সঙ্গে সঙ্গম করে একদিন মরে যায় কেননা সব কিছু পার্থিব

 

আর যে কবিতা আকাশ পর্যন্ত পৌঁছায় আর নানা নক্ষত্রের সঙ্গে আলাপন করে আর পরস্পর পরস্পরের আলো দেখে যেখানে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী শব্দের ছলচাতুরী প্রতিবন্ধী যেখানে রাষ্ট্র নেই সমাজ নেই শব্দ ও শব্দার্থ  লীন হয়ে যায় বোধে চেতনায় যেখানে মানুষটা  বুদ্ধের বোধিবৃক্ষ অথবা রামকৃষ্ণের কল্পতরু সেখানে জন্ম নেই কিন্তু অভ্যুদয় আছে এই রিসারেকসন বা সোল লিবারেশন কোনও ঘরানা বা ক্যাম্প বা প্রতিষ্ঠানের প্রডাক্ট নয়

 

আমার বুকের ভেতর কখনো সখনো হাইড্রোজেন ঢুকে পড়ে আবার তখনই  অক্সিজেন ঢুকে এক রসায়ন বা মৌল হয় এই সময় আমি বড়ই অসহায় আমার যাদবপুর নেই প্রেসিডেন্সি নেই অক্সফোর্ড নেই আমি এক দেউলপাড়া নামক ধ্যাড়ধেড়ে গোবিন্দপুরের মাধ্যমিক নিজেই পায়ের ধুলোর তিলক কেটে অনুভব করি কেউ জন্মায় না কেউ মারা যায় না সব কিছু সুপ্ত থাকে রাম আর কৃষ্ণ চার হাজার বছর সুপ্ত ছিল রামকৃষ্ণ নামক এক কথামৃতর জন্য আসলে রামায়ণ আর মহাভারতের গীতার অপেক্ষা ছিল এই গদ্য গীতাঞ্জলি কথামৃত এর জন্য এই কবিতার মৃত্যুকথা কেউ  কি লিখতে পারে?

 

মেঘপালক : প্রেম না কাম? কবিতা কার অনুশাসন বা আলোতে চলে?

 

সুনীল : কেউ ঋষি  বশিষ্ঠ এর  অনুগামী কেউ  বাৎসয়নের আসলে কথায় আছে, পুরুত হয়ে  ঠাকুর পুজো করো বা কসাই হয়ে মাংস কাটো--যা কিছুই করো না কেন ধ্যান দিয়ে করো হৃদয় দিয়ে ভালোবেসে করো ভালোবেসে সঙ্গম করলে শরীর বাদ্য হয় শরীর সঙ্গীত গায় আর ভালো না বেসে সঙ্গমকে ধর্ষণ বলে তখন কেউ কারো  সঙ্গী নয় পরস্পরকে বস্তু ভাবে কেউ কারো প্রাণের  আহ্লাদের টের  পায় না

 

কবিতা খুব সুসামঞ্জস্য আলো-তাপের ব্যাপার কম আলো কম ভালোবাসা নিয়ে মাঝারি কবিতার চাষ হতেই পারে কিন্তু তাপ বেশী হলে মনের জ্বর জ্বালা হয় অসুস্থ  হয় তখন পতন হয়  উত্থান হয় না

 

কবিতা কারো অনুশাসন মানে না গার্হস্থ্য জীবন অনুশাসনের  দেয়ালে  বন্দি বলেই তার ছাদ আছে কিন্তু আকাশ  নেই কবিতা কখনো শর্ত মানে  না যে কবিতা শর্ত বা অনুশাসন মানে তা শিলাবৃষ্টির মতো খুব ক্ষতি করে জীবনকে ভারী করে পাথর করেএকটা  পবিত্র কবিতা রামধনুর মতো তার  জেগে ওঠাই স্বর্গের সৌন্দর্য

বশিষ্ঠ আকাশ পেয়েছিলেন সঙ্গে অরুন্ধতী আলো

বাৎসায়ন আমাদের শরীরে ব্যায়াম শেখায় কাম ছন্দ  শেখায় পিটি ড্যান্স শেখায় কিন্তু  ভক্তিযোগ জ্ঞানযোগ কম প্রেম  ছাড়া সব কবিতা অসম্পূর্ণ কবিতায় প্রেমকাম মিলেমিশে থাকলে নদীর বুকে সেতু গড়া যায় এইটুকু মাত্র

 

মেঘপালক : স্মরণীয় পঙক্তি হলো কবিতা এই ধারণার বৃত্ত আপনি কিভাবে দেখেন? চর্যাপদ থেকে আজ পর্যন্ত লোকে কবির কথা ভুলে গেছে, কিন্তু অবিস্মরণীয় পঙক্তি ভোলেনি! কেন এমন হলো?

 

সুনীল : শরীরের সব অংশ সমান সুন্দর না মানুষের মুখ সবচেয়ে সুন্দর কথায় বলে, মুখশ্রীমুখ হলো সৌন্দর্যের আধার অভিব্যক্তির উৎস তেমনই কবিতার মুখ থাকে সেই মুখ দিয়ে মানুষ যেমন অন্তরের ভঙ্গি প্রকাশ করে তেমনই কবিতার সিলভার/গোল্ডেন লাইন এর মধ্য দিয়ে আমরা কবিতার চুনী পান্না হাসিকান্না শুনতে পাই তাছাড়া মুখ ছাড়া মানুষকে ধড় দেখে চেনা অসম্ভব না হলেও মুশকিল হয় কবিতার শিরোনাম অনেক সময় মনে থাকে না কিন্তু মুখপঙক্তি ঠিক  মনে  থাকে

 

কবি একজন ব্যক্তি ইনডিভিজুয়েল তিনি স্বতন্ত্র তিনি এক বিশেষ সত্তা অস্তিত্ব কিন্তু সেই মানুষটির কবিতা  যখন প্রকাশ পেল তখন তা আর কবির নয় সেই লেখা তখন পাঠকের জনগণের সেই পঙক্তির মধ্যে  পাঠকের ভাব ভালোবাসা ম্লান অম্লান লুকিয়ে আছে পাঠক সেই পঙক্তির ভেতর থেকে আলো নিয়ে দীপ জ্বালান অথবা দীপক রাগে মেতে ওঠেন কবিতার ছত্র মনে রাখা তাই স্বাভাবিক কেননা, আমরা শস্যের স্বাদ নিই মাটিকে মনে রাখার প্রয়োজন পড়ে না

 

মেঘপালক :  প্রতিভা এবং প্রতিষ্ঠান এই দুই যদি মিলে যায়, তাহলে কবি দাঁড়াতে পারে---এই ধারণা কী সত্য? অর্থাৎ মহানগরের ধুলো যতক্ষণ কবিকে না ছোঁবে, ততক্ষণ কী কবিতা সোনা হয় না! 

 

সুনীল : প্রথমত কবি চরিত্রের একটি বৈশিষ্ট্য হলো প্রতিভা কেবল প্রতিভায় কাজ হয় না প্রতিভা  হলো আগুন আগুন ছাড়া ধারালো অস্ত্র হয় না আগুন ছাড়া মানসিক বিকাশ সভ্যতার বিকাশ হয় না কিন্তু  অভিজ্ঞতা হলো ধাতব জিনিস জল তার চেষ্টা বা পিপাসা একটা অস্ত্রে শান দিতে এসব লাগে তদ্রূপ প্রতিভার সম্মিলিত উদ্যোগ সফলতা আনার  চেষ্টা করে আগুন ছাড়া  অস্ত্র ভোঁতা মানুষও ভোঁতা

 

যে কোনও প্রতিষ্ঠান প্রতিনিধির কাজ করে বানিজ্য ও প্রচারের কাজ করেপ্রতিষ্ঠান তো একটা মঞ্চ একটা উঁচু জায়গা অনেক দূর থেকে মানুষটিকে দেখা যায় এবং বড়ো লাগেরঙিন লাগে লার্জার দ্যান লাইফ লাগে তাই  সফলতার জন্য প্রতিষ্ঠান একটা গুরুত্ব পূর্ণ ভূমিকা পালন করে প্রতিষ্ঠান এবং প্রতিভা মিলে গেলে তো সোনায় সোহাগা

 

মহানগরের ধুলো আর পল্লী গাঁয়ের ধুলোর মধ্যে চরিত্রগত তফাৎ নেই ধুলো ধুলোই মহানগর পরশ পাথর নয় মহানগর ধুলোকে সোনা করতে পারে বা ধুলোর বুকে সোনার তরী ভাসাতে পারে আমি বিশ্বাস করি না তবে কেউ যদি সোনা হন তার গহনা তৈরি করে বাজার নিতে পারে মহানগর একটা ব্র্যান্ড আধুনিক সভ্যতার পীঠস্থান হলো নগর রামকৃষ্ণ বিদ্যাসাগর রামমোহন কোলকাতায় এসেছিলেন গ্রাম থেকে এবং নিজেরাই প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিলেন

 

মেঘপালক : একজন কবির পাঠক কিভাবে তৈরি হয়?

 

সুনীল : পাঠক দুই প্রকার ঋদ্ধ পাঠক হুজুগে পাঠক ঋদ্ধ পাঠক স্থায়ী ও বিচক্ষণ হুজুগে পাঠক মত বদল করে স্থান বদল করে

 

পাঠক পেতে  হলে কবিকে ভালো লিখতে হবেভালো লেখার নিজস্ব গন্ধের ডানা থাকে মা সরস্বতী তার প্রিয় সন্তানকে বাহনে চড়িয়ে ঘুরে বেড়াবে এতে আর আশ্চর্য কী! আবারও বলি, পাঠক পাওয়া সহজ পাঠক ধরে রাখা কঠিন পাঠক শস্য খেতে পছন্দ করে ভূষি খায় না ভালো লেখা পেলে পাঠক আসবে, লেখককে তেমন প্রচার করার প্রয়োজন পড়ে  নাতবে আমি বিজ্ঞাপন বিরোধী নই বিজ্ঞাপন এক ধরণের আধুনিক ম্যানেজমেন্ট সুস্থ ও সুন্দর ভাবে তুলে ধরতে হবে লেখার গুণমান

 

ইদানিং লেখকরা যে লেখা পাঠ বা রিসাইট করছেন বা ভিডিও কনফারেন্স করছেন তা প্রত্যক্ষ যোগাযোগ করতে সাহায্য করেতাই সোসাল মিডিয়া এখন একটা সুপারমর্ডান পদ্ধতি আমি  মনে করি শতাব্দী শাসন করবে এই ইলেকট্রনিক মিডিয়া

 

মেঘপালক : প্রাশ্চাত্যের কোন কোন কবি আপনাকে প্রভাবিত করেছে?

 

সুনীল : প্রথমত বলি, আমি এক অন্ধকারাচ্ছন সময়ের বাসিন্দা ছিলাম প্রথম যৌবনের কর্মজীবনে তাই আলো খুঁজতাম আমি রাতের কাছে আলো চেয়েছি, দিনের সূর্যের কাছে নয় আমি কবিতা খুঁজেছি উপন্যাসের ভেতরে, কবিতার ভেতরে  নয় স্কুলজীবনে অসম্ভব ক্ষুধা ছিল অচেনা অজানা জগতের প্রতি শরৎ বঙ্কিম পেরিয়ে বিভূতিভূষণে এসে মনে হয়েছিল ইনি আমার ভাষার মানুষ কবিতার মানুষ বিভূতিভূষণে আমি আমি স্বপ্ন পেয়েছিলাম আর জীবনানন্দ দিয়েছিলেন বোধ আর রবীন্দ্রসঙ্গীত দিল আত্মীয় বন্ধুস্বজনের মতো নদী এই সব বন্ধুত্বের হলুদ খাম বুকে নিয়ে বিমান বাহিনীর কাঁটা তারের ভিতর ও বাহিরের ভারতবর্ষকে দেখা এবং বিশ্ব মানচিত্রে ভারতবর্ষকে খোঁজা

 

প্রাশ্চাত্যের সাহিত্য বলতে ১ ইংরেজি সাহিত্য ২ আমেরিকান সাহিত্য ৩ রাশিয়ান সাহিত্যের সঙ্গে আমার অল্প বিস্তর পরিচয় হয় তবে ৪ ভারতীয় ইংরেজি সাহিত্য তথা অ্যাংলো ইন্ডিয়ান লিটারেচার আমার মানসিক গঠনে সাহায্য করে

 

নদীর তীরে বসে আমার আকাশ দেখা ফলত উপন্যাসের তীরে বসে মেঘ নক্ষত্রের সন্ধান করেছি পথের পাঁচালী, আরণ্যক, মেমসাহেব, ন হন্যতে, গণদেবতা, দেবদাস, পল্লীসমাজ, শেষের কবিতা, অরণ্যের অধিকার, পদ্মা নদীর মাঝি, তিতাস একটি নদীর নাম, আনন্দ মঠ এরকমই ডজন ডজন উপন্যাসে আমার বুক যখন নক্ষত্রের আলোয় ভরে উঠছে তখন মাদার, ইস্পাত, অভ্যুদয়, ওয়ার এন্ড পিস, হান্ড্রেড ইয়ারস্ অব সলিচুড এর মতো লেখার ফাঁকে ফাঁকে কবিতার শস্য ভাণ্ডার নিয়ে হাজির হচ্ছেন জন ডান, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কোলরিজ, মিলটন, কিটস, শেলী, বায়রন, ইয়েটস, টেনিসন, এলিয়ট প্রমুখ

 

আমি দি ওয়েস্ট ল্যান্ড-এর মধ্যে একজন বাউল ফেরিওয়ালা হয়ে সং অফারিঙস বাজাতে চেয়েছি বাঁশিতে নয় বেহালা সেতারে সারদে যাই হোক, আকাশের কথা বলতে গিয়ে অনেক মাটি আবহের কথা এলো জীবনে এই টুকু বুঝেছি, মাটি ভালো থাকলে আকাশ ভালো থাকে, আর আকাশ ভালো থাকলে গাছে গাছে ফল ভালো হয় ফলের কথা বলতে গিয়ে শেকড়ের কথা বলতে হলো কেননা আমার কবিতা যদি নদী হয় তবে উপন্যাস হলো ফল্গু নদী, আর আকাশ ও মেঘ হলো ভাগবত গীতা, ভারতকথা

 

বি.দ্র :  আমাকে আরও কয়েকজন প্রভাবিত করেছিলেন যেমন লোরকা, মায়াকভস্কি, নেরুদা,এলুয়ার, ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ প্রমুখ

 

মেঘপালক : আপনার সমসময়ের  কবিতা নিয়ে নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গিতে বিস্তারিত বলুন

 

সুনীল : নিরপেক্ষ প্রসঙ্গে আমি চিরকাল অকপট এবং সাবলীল আমি নিজের জীবন লিখি আর আমার আত্মজীবনীর অংশ হয়ে উঠেছে যারা তাদের কথা অনিবার্য ভাবে এসে যায় এই ধরিত্রীর বুকে আমি ধুলোকাদা জীবনে একটা বীজ ধারণ করতে চেয়ে তৃণ লুতাগুল্মাদি থেকে বৃক্ষ--এই এক অভিব্যক্তি ও অভিযোজনে উপস্থিত বা যোগদান করতে চেয়েছি আর দেখি কে বা কারা সেই জীবনের মহাযজ্ঞে অংশ নিয়েছেন আর এই অংশ নেওয়ার জন্য কে গ্রাম থেকে শহরে গিয়ে রেচন ত্যাগ করলেন বা নন্দনে কবিতা পড়লেন বা দেশে বা বিদেশে বা কালিকলমে লিখলেন, আমি বদার করি না

 

আমি তাকে লালন করি যার মধ্যে স্বপ্নবোধ বীজ আছে, উর্বর মাটিজল আছে, রোদবৃষ্টি আছে, আকাশনক্ষত্র আছে আমার কাছে কখনও বিবেচ্য নয়, কার আনন্দবাজার আছে না আলিমুদ্দিন স্ট্রিট আছে না কালীঘাট দক্ষিণেশ্বর আছে নদীমাতৃক ও বৃষ্টিমাতৃক এই দেশে সত্তর ভাগ কবিতা হলো কৃষিজীবী আর বিশভাগ নগরকেন্দ্রিক শ্রমজীবী বাকি দশভাগ অরফান বা শাসক তারা কবিতা বোঝে নাতারা কবিতার সঙ্গে ক্রিকেটের তফাৎ জানে না কিন্তু  তারা বিশ্ববাজারের নিয়ন্ত্রক তাই সেই নিয়ন্ত্রণের মধ্যে কবিতা এসে যায়কবিতা তাদের কাছে পণ্যমালযেমনভাবে পতিতা বৃত্তির জন্য লাইসেন্স দেয় তেমনি কবিতার বাণিজ্যিক ছাড়পত্র মেলে ছায়াছবির বেস্ট নায়ক নায়িকা কথা আবহ লিরিক হওয়ার জন্যকবিতা নিয়ে তাই তারা চিত্র তারকা সমাবেশ বা মেলাখেলা করে

 

আমি মনে করি, একজন কবি সারাজীবন বাল্মীকির মতো রামায়ণ লিখবেন বেদব্যাস এর মতো কবি ও দার্শনিক মহাভারত লিখবেন কৃষ্ণের মতো একজন কবি দার্শনিক সাম্যবাদীযোদ্ধা ও আধ্যাত্মিক গীতার পাঠ দেবেন তাই একটা লেখাই যথেষ্ট

 

আমরা কেউ একটা বই লিখতে পারিনি আমাদের দিনলিপি নেই রাত্রিলিপি নেই খাপছাড়া কিছু পরিচ্ছেদ অধ্যায় লিখি অর্ধমৃত আমরা মিথ মৃত্যু খেলি আমাদের বর্তমান নেই নিজেদের অতীত লিখি না সত্য গোপন করতে কিন্তু রাম রাবণের গুষ্ঠি লিখি যমের পিণ্ডি লিখি দ্রৌপদী সহবাস লিখি প্রেমিকার কামাতুর বেদনা লিখি অথচ মাকে বাবাকে লিখি না

 

অনিল ঘড়াই বলতেন, ফাঁকা মাঠ কথাটা মন্দ বলেননি শিক্ষা দীক্ষা নেই আমাদের নিজেরাই অভিভাবক তাই বিছানা বালিশ লিখি আগাছা লিখি মাঠের মাঝে কেউ ডোবা পুকুরে মাছ ধরতে ব্যস্ত দু পয়সা ইনকামের জন্য  কাব্য প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও খবরের কাগজের গোলাম

 

তাহলে কি কিছুই হচ্ছে না? হচ্ছে ছাদে ধানচাষ হচ্ছে আর টবে ফুলের চাষ হচ্ছে  তাই একশ বছর পরেও আমাদের মুক্তি রবীন্দ্রনাথের চুরি যাওয়া নোবেল

 

কবি দু বছর অন্তত ব্রহ্মচর্য পালন করুন তারপর গেরুয়া কথা হবে কেউ সাদা নন সাদা পোশাক না পরেই মংককোন কবি তার মাকে প্রদক্ষিণ করছেন গণেশের মতো অথবা ঘুরে বেড়াচ্ছেন গ্রামে জেলায় প্রদেশে দেশে? খাঁচায় বসে অরণ্যকে গান শোনাচ্ছে শহরে বসে গ্রাম লিখছে ইডিয়ট এই যেমন আমি একজন স্বার্থপর আত্মকেন্দ্রিক কখনো দলপতি বা আংকার সিটিজেন নই মাটি নষ্ট হচ্ছে, জল নষ্ট হচ্ছে, বাতাস নষ্ট হচ্ছে আকাশ মেঘ নষ্ট হচ্ছে অথচ আমার কান্না নেই একটা রাতও কি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কেঁদেছি? অথচ শৈশবে কৈশোরে কেঁদেছি পারুলের জন্য মেমসাহেবের জন্য লাবণ্যের জন্য নন্দিনীর জন্য এখন আমাদের মাঠ নেই সবই সখের মাঠ আমরা সখের রাখাল আমাদের সখের বাঁশি সখের যমুনা

তাই সারেণ্ডার নেই কিন্তু সারেঙ্গা বাজিয়ে বেদনার প্রার্থনা বাজাচ্ছি

 

এতটা হতাশ কেন? হতাশার কিছু নেই ভাবি, আমরা অসময়ে জন্মেছি আড়াই শো বছর আগে যখন ভারত দখল হচ্ছিল তখন কৃষকেরা ধান রুইতে ব্যস্ত ছিল আমরা এখন পেটের আর মাথার সখে কাব্য করি কবিতা পড়ি ও পড়াইআমার বিশ্বাস, এখন থেকে শতবর্ষ পরে রামকৃষ্ণের মতো কেউ আবির্ভূত হলে এক ডজন বিবেকানন্দ জন্ম নেবে তখন বাংলা ভাষা বিশ্বমঞ্চ পাবে চৈতন্য পাবে আমাদের এই চেতনাহীন বা অর্ধচেতনার সাহিত্যের জন্য আমরা এখন বেদ গীতা রবীন্দ্রনাথ জীবনানন্দে মাথা রাখি হৃদয়  রাখি এখন  যারা লিখছেন তাদের লেখায় সব আছে কিন্তু  হৃদয় নেই বিবেকানন্দের সময় কি ভারতবর্ষে জটাধারী সাধু কম পড়িয়াছিল? কেদারনাথ বদ্রীনাথ অমরনাথ রামেশ্বর নর্মেদশ্বর বারাণসীতে কি সাধুডেরা কম ছিল? ছিল কিন্তু প্রদীপের আলো আরতি নিয়ে তারা ছিলেন এই ইদানিংকার কলকাতা নামক এক তিলোত্তমার বুকে যেমন জয় বিজয় গোপীনীনাথেরা আছেন

 

আমরা নিজেরাই নিজেদের চিনি না আমরা পালিয়ে বেড়াই আমরা রত্নাকর না বাল্মীকি না রামকৃষ্ণ না তবে কি আমরা? আমরা শিক্ষিত মঠের মতো সন্ন্যাসী তার তালিকা শতাধিক হবে তাঁরা কেউ কেউ স্কুল পাঠ হয় কিন্তু জীবনের তুমুল পাঠ আমি অন্তত পাইনি বলে নিজেকে বেশি পাঠ করি

 

এই সময় অন্ধ নয় তবে চোখে চশমা লাগে কাঁচের ভেতর দিয়ে দেখতে অভ্যস্ত আমাদের বিশ্ব বিদ্যালয়গুলো যে চশমার কাজ করে ফলে তেমন দৃষ্টিভঙ্গিতে কেউ নেই আজ যে দৃষ্টিতে দৃশ্য কাল তা বদলে যাচ্ছেআমার সমসময় এখন বিভূতি ভূষণ ও জীবনানন্দ আমি তার যুগে আছি মাঝে মাঝে সাবিত্রী আর লাইফ ডিভিইন পড়ি অনেকেই আমার মতো  বীজতলায় আছি অরণ্য পায়নি জয়শঙ্খ যতই  বাজুক

 

বি.দ্র. এই বিষয়ে শুভঙ্কর আমার কাছে আরও বিস্তারিত চেয়েছেন কবি ও কবিতার নাম ধরে আলোচনা করতে বলেছেনআসলে আমি আলো দেখি আলো ফুটলে নিশ্চয়ই চোখ টানবে আমি স্পষ্টতই অকপটে জানাতে চাই, আমি কারো কারো আলোচনায় নিজের আলো ফেলতাম এখন আর ফেলি না

 

আবার বলছি, রত্নাকর যখন বাল্মীকি হলেন তখন তাঁর অয়ন হলো ঈশ্বর ঈশ্বর তাঁর কবিতা কবিতা তাঁর সন্তান বেদব্যাস এর তাই কালিদাস তাইচৈতন্য বুদ্ধ তাই রামকৃষ্ণ যিনি ঈশ্বরের নানা রূপ জানতে একাধিক বার দীক্ষা নেন ওঁরা আমার কবি ও কবিতা আমার কবিতার ঈশ্বর রবীন্দ্রনাথও তাই জীবনানন্দও

 

বাকি এখন যারা লিখছেন এবং প্রথিতযশা তাঁদের পড়ে মনে হয়নি তেমন ঈশ্বর আছে মনে হয়েছে এ লেখা আমিও পারি মনে হয়েছে এই সব লেখা  রঙিন কিন্তু  হাতে আঁকা এখানে ঈশ্বরের  রামধনু  নেই

তো, কেউ তেমন সন্ন্যাসী নন গোঁসাই হতে পারে সন্ন্যাসী নন রবীন্দ্রনাথ যতদিন প্রভাতসঙ্গীত সন্ধ্যাসঙ্গীত লিখলেন ততদিন ব্রহ্মচারী ছিলেন কিন্তু গীতিমাল্য গীতালী ও গীতাঞ্জলির পর সন্ন্যাসী মানুষটি মনে হলো ঈশ্বরের কাছে দীক্ষা নিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণ হলেন গীতাঞ্জলি আমার কাছে তাই কল্পতরু

 

এখন যারা লিখছেন তাদের কেউ কেউ গাছে দোলনা বেঁধে দুলছেন বাগান কাঁপছে হয়তো তবে কারও লেখাতে অরণ্য দুলছে বলে মনে  হয়নি চলো, একটু চোখের আরাম আছে এইটুকু কোলকাতার জয় বিজয়রা মহর্ষি আখ্যা নিয়ে লিগের খেলছে মাত্র ওতো শর্তাধীন সুযোগ পেলে আমিও শট মারতে পারি মহর্ষি হওয়া যায় কিন্তু শ্রী শ্রী খুব সাধনার ব্যাপার আজকের যারা মহর্ষি তাঁরা ব্রাহ্মধর্মের মতো আইসি ইউ তে চলে যেতে পারে কেননা সাধনায় অনেক ফাঁকিবাজি আছে সেই ফাঁক বা গহ্বরের কথা নাই বা বললাম

 

তবে কবিতা লেখা কি হচ্ছে না? হচ্ছে অবশ্যই হচ্ছে বাগানে জল দেওয়া কম কথা নয় সেই ফুল দেবতার পুজোয়  লাগেতবে রামকৃষ্ণের মতো পূজারী কতজন হতে পারে বলুন এখন পুজোও নেই সব কিছু উৎসব তাই এই সময় সেই সময় নয়, কবিতার সুসময় নয়

 

মেঘপালক : একজন নবীন কবির পথরেখা এবং পাঠ কী রকম  হতে পারে  ?

 

সুনীল : তিনি কবি তিনি ঋষি তিনি সংস্কারক নন তিনি বুদ্ধিজীবী রাজনীতিক নন তিনি আগে নিজেকে নিজের আসনকে নিজের কলমকে প্রতিষ্ঠা দিনউইদ আনকন্ডিশনাল লাভ এই লেখার সঙ্গে কোনও আপস নয় নো কম্প্রমাইজ

 

রবিঠাকুর যদি বিশ্বভারতী বা শ্রীনিকেতন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় না তৈরি করতেন বা সমবায় ব্যাঙ্ক গঠনে অবদান না রাখতেন তাহলেও তাঁকে আমরা কবি হিসেবে মনে রাখতাম মাইকেল কতটা কুপুত্র ছিলেন তাঁর  পিতার বা রেবেকার চোখে কত বাজে স্বামী ছিলেন বা কত মদ খেতেন আমরা মনে রাখিনি তিনি শ্রদ্ধাশীল কারণ তিনি বাংলা ভাষার মহাকাব্যের জনক তিনি সৃষ্টিশীল মানুষজাতির গর্ব

 

তো একজন নবীনকে কী করতে হবে? মনে মনে দীক্ষা নিতে হবে কার কাছে? হয়তো কোনও মহান কবির সৃষ্টির কাছে অথবা আকাশের কাছে জলের কাছে মাটির কাছে অথবা নিজের কাছে কেন দীক্ষা? এই যে, তাকে সততার সঙ্গে আনন্দের সঙ্গে কাজের মধ্যে সৌন্দর্যকে খুঁজতে হবে মোহগ্রস্ত হলে একসময়ে লেখার মধ্য গগনে উঠে সমর সেনের মতো লেখা ছেড়ে দিয়ে বলতে পারেন : কবিতা  লিখে  কিছু  হয় নাকি হয় আর কি হয় না এই বিচার করার দায়িত্ব একজন সৃষ্টিশীল মানুষ যেন না নেন কবিতা লিখে যদি কিছু না হয় তা হলে ফ্রন্টায়ার এর মতো পত্রিকা করেও কিছু হয় না

 

আমি বিশ্বাস করি, কবিতা হলো সবচেয়ে বিশ্বাসের জায়গা গভীরতম আত্মবিশ্বাস না থাকলে একজন কবি সমুদ্রের গভীরে বা আকাশের নক্ষত্রের কথা শুনতে পাবেন না তিনি গাছের কথা পাহাড়ের কথা যেমন শুনতে পাবেন তেমনই একশ বছর আগের কথা পরের কথা শুনতে পাবেন যদি ধ্যান করেন আরাধনা করেনতাই খবরের কাগজ পড়ে তাৎক্ষণিক আবেগে অভ্যাসবশত শব্দকে ছন্দের ছাঁচে ফেলে একটা ইমারত হয় সুনাম অর্জনের জন্য বা কবিতা লেখকের স্বীকৃতির জন্য এরকম অট্টালিকা তো লক্ষ মানুষ করেন কিন্তু কবিকে নিজস্ব স্থান খুঁজে নিতে ভাষার দ্বীপ রচনা করতে  হবে, তবে সেখানে দীপ জ্বালিয়ে পরিভ্রমণে আসবেন পরিযায়ী পাখির দল

 

যারা ওড়ার স্বপ্ন দেখেন তাঁরা কবি হন পাঠক হন পাঠক কবি না হলে কবিতা তাঁকে সঙ্গ দেবে নাশব্দ দিয়ে অন্যের জীবনকে অনুকরণ ও অনুসরণ করতে পারলে একজন নাট্যকার হতে পারেন, পাঠক হতে পারেন কিন্তু  আত্মপাঠ ভীষণ কঠিন নিজেকে দেখা তথা আত্মদর্শন আরও কঠিন তবে নিজেকে কিভাবে দেখব? চোখ খুলে নিজের দুটো চোখ অপরকে দিয়ে অন্ধ হয়ে বসে থাকুন আর সেই দুটো দিয়ে দেখুন আপনি কি? আপনি কে? এই কর্তা আর ক্রিয়ার কর্ম  যিনি করেন তিনি ক্রিয়েটিভ তিনি মেকার বা অ্যাক্টর নন তিনি ক্রিয়েটর তিনি হরগৌরী

 

কে কবি আর কে কবিতার লেখক এটাই বুঝতে আমার মাথাটা কেটে নদীর বুকে ভাসিয়ে দিতে হয়েছে কেননা  একজন কবি হৃৎস্পন্দন দিয়ে লেখেন আঙুলে তার পালস উঠে আসেকেবল বই পড়ে গাছ ফুল মাটি নদী আকাশ নক্ষত্র মানুষ চেনা যায় না বই সাহায্য করে মাত্র তাই কবিতা ও কবির জীবন পাঠ করতে হবে কবির জীবনীর মধ্যে তাঁর জীবনীশক্তির টের পাওয়া যাবে কেমন করে ? দীক্ষা  নিলে

 

আমি চির নবীন হওয়ার চেষ্টা করছি আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছি নিজের ছাইয়ে দাঁড়িয়ে আছি পিতামহ আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি ভীষণ উর্বর এক মাটি হতে চাইছি এই নদীপাড়ে/নদীপারে

 

মেঘপালক : কবিতা  লিখতে  এসে  আপনি  অসংখ্য কবিদের সংসর্গ লাভ করেছেন। সেই সব অখ্যাত বিখ্যাত কবিদের নিয়ে  ভালো লাগলো না ভালো লাগা অকপটে বলুন। কোনও কিছু  লুকোবেন না।

 

সুনীল : বিমান বাহিনীতে থাকাকালীন বিশেষ করে দিল্লীতে থাকাকালীন দেশ বিদেশের বহু ব্যক্তিত্বকে দেখি যারা রাজনীতি প্রশাসন শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি সমাজ ধর্মে খুব ধন্য ছিলেন ধনী ছিলেন। যেমন শম্ভু মিত্র ও উৎপল দত্তের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল দিল্লীতে। গোর্বাচেভকে খুব কাছে দাঁড়িয়ে শুনেছি। অটলবিহারী বাজপেয়ী, লালকৃষ্ণ আডবাণী, ভিপি সিং, আই কে গুজরাল, রাজীব গান্ধী প্রমুখের হাত ছোঁয়া দূরত্বে শুনেছি। তবে কল্পনা যোশি(দত্ত ) কে প্রণাম করে শিহরিত হই। যা বলতে চাই তা হলো বিখ্যাত অখ্যাতদের কখনো আলাদা চোখে দেখিনি। আমার পিতামহ বলতেন, কয়েকশ নক্ষত্র আছে যারা সূর্যের চেয়েও  বড়ো। বলতেন, কাউকে তুচ্ছ ভেবে নিজের অন্তরাত্মাকে অপমান করবে না। ফলে আমি ফৌজে অনেক আধিকারিককে সাব স্ট্যান্ডার্ড দেখেছি এয়ারমেন-এর চেয়ে। এখন অনেক বিডিও এসডিও পুলিশ আধিকারিককেও আমার ভোঁতা লাগে সাধারণ কৃষকের চেয়ে। তো, কাকে অখ্যাত বলব? খ্যাতি এতো বানানো জিনিস যে আজ যে চিপ মিনিস্টার কাল সে সাধারণ ক্যাডার বা তেমন  অপরিহার্য নয়। খ্যাতি আসে উপস্থাপনার গুণে। যেমন দেখেছি, একটি কবিতা দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হলে কবি ধন্য ধন্য হয় অথচ হয়তো একই লেখা ক-বছর আগে একটি সাধারণ কাগজে প্রকাশিত হতে কারও নজর কাড়েনি।

আমি সকলের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেছি সম্ভবত। কেননা আমার সঙ্গে কেউ খারাপ আচরণ করেননি। মুগ্ধতার কথা বলি, অগ্রজদের মধ্যে কবি কমলেশ সেন, আজিজুল হক, মণীন্দ্র গুপ্ত, দেবারতি মিত্র, আলোক সরকার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, দেবী রায়, অজিত বাইরী, শীতল চৌধুরী, মৃদুল দাশগুপ্ত, রবীন আদক, অরুণকুমার চক্রবর্তী, শম্ভু রক্ষিত, শম্ভু চট্টপাধ্যায়, মোহিনীমোহন গঙ্গোপাধ্যায়, নির্মল হালদার, শ্যামলকান্তি দাশ, রানা চট্টপাধ্যায়, অনন্ত দাশ, তপন বন্দোপাধ্যায়, হাসমত জালাল, প্রাণজি বসাক, কালীপদ চৌধুরী, প্রভাত মিশ্র, অমৃত মাইতি, লক্ষ্মণ কর্মকার, ক্ষিতীশ সাঁতরা, তপনকুমার মাইতি, শশাঙ্কশেখর অধিকারী, বৃন্দাবন দাস, দেবাশিস প্রধান, প্রফুল্ল পাল, কাশীনাথ সাহা, কালোবরণ পাডুই, হরপ্রসাদ সাহু, প্রাণনাথ শেঠ, শিশিরকুমার বাগ, সূর্য নন্দী, প্রবীর দাস বা সমবয়সী নীলোৎপল গুপ্ত, অজিত ত্রিবেদী, তৈমুর খান, হীরক বন্দোপাধ্যায়, সৌমিত বসু এবং আমার শহরের দুই ব্যক্তিত্ব নন্দদুলাল রায়চৌধুরী ও ভবেশ বসুর সঙ্গে সম্পর্ক ভালো থেকেছে কোনও কিছু প্রত্যাশা ছিল না বা নেই বলেই। কবিরা আমার কাছে গাছের মতো। তাঁরা এই ধরিত্রীকে অনেক কিছু দান করছেন, কিন্তু আমি কেবল অক্সিজেন নেই। তাঁদের লেখা পড়ি আর প্রেরণা  নিই। আমার জীবনে ব্যতিক্রমী প্রেরণা অনিল ঘড়াই। এতো সৎ আবেগপ্রবণ বিবেকবান ও পরোপকারী মানুষ দুটি দেখিনি। সাহিত্য ছাড়া তিনি কোনও কিছু ভাবতেন না। তিনি আমাকে বাংলা সাহিত্যের অসুখ চিনিয়েছিলেন। এবং কিভাবে নিরাময় করে স্বাস্থ্যবান ও স্বাভাবিক করা যায় তার পথ বাতলে ছিলেন।

শুভংকর, আপনার সঙ্গে, আমার সম্পর্ক মুগ্ধকর ও স্বাভাবিক এই কারণে যে, আমরা পরস্পরের পজেটিভ দিকটা দেখি। শূন্য দশকের প্রথম দিকে কয়েকজন তরুণ দেশ পত্রিকার শারদ সংখ্যায় গদ্য পদ্য  লিখে খুব অহংকার প্রকাশ করতেন। আমি তাদের সমীহ ও সম্মান করতাম তাদের লেখাকে। ব্যাস এই পর্যন্তই। এই ইগোইস্টদের আমি সংস্রব ত্যাগ করেছি। সেই চার পাঁচজনকে আমি মনে মনে বাতিল করেছি এই কারণে যে, তারা অপরকে সম্মান দিতে জানে না,  আত্মম্ভরি, কৃপণ নকল অকৃতজ্ঞ এবং স্বার্থপর। একটা কুকুরকে বিস্কুট বা একটা পাখিকে এক দানা চাল গম খুদ দেয় না অথচ তাদের উড়ে যাওয়া দেখে কবিতা লেখে। আমি নাম বললাম না। কারণ ভালো মানুষের নাম নিতে হয় হরিনামের মতো। তাই সৌরভকুমার ভূঞ্যা, অসীম ভূঁইয়া লক্ষ্মীকান্ত মণ্ডল, গৌতম ভট্টাচার্য, অরিন্দম প্রধান, অঞ্জন দাস, অলক জানা, ভবানী প্রসাদ গুইন, নিমাই মান্না, দুখু ভূঁইয়া, দুখানন্দ মণ্ডল, তাপস বৈদ্য, বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখের কবিতা নিয়ে ভাবি। নামের তালিকা দীর্ঘ করলে ভালো হতো। তবে তিনজন নবীনের জন্য আমার মনখারাপ হয় তারা সাহিত্যচর্চা করে না বলে। যেমন প্রসূন পড়িয়া, আনন্দরূপ নায়েক আর সৈকত পট্টনায়ক।

কবিতা প্রকাশ ভালো। তবে নিয়মিত প্রকাশ না হলেও চলে। তবে ইষ্টনাম জপের মতো কবিতার কাছে বসতে হবে। লিখতে হবে। আর পত্রিকা বা বই একা সম্পাদনা করতে হয়।

 

মেঘপালক : কবির জীবনে কবিতা লেখার ক্ষেত্রে স্বকীয়া না পরকীয়া কোন সম্পর্ক সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে বা বেশি কার্যকরী হয়?

 

 সুনীল : মানুষ নদীর মতো। কখনো খরা কখনো বর্ষা। আবহ ভীষণভাবে প্রভাবিত করে। আকাশের কৃপায় বরফগলা জলের কৃপায় বা সাগর বা জমে ওঠা বিস্তৃত জলরাশির কৃপায় এই নদীজন্ম। একটি নদী যখন আর একটি নদ বা নদীর সঙ্গে মিলিত হয় তখন দুই জলরাশির সম্মিলিত ভাবধারায় নদীর আঙ্গিক বদলে যায়। কেননা দুটো শক্তির মিলনে এক ইউনাইটেড ফোর্স বা জোট শক্তি  মহাশক্তিতে পরিণত হয়।

আমি যখন নিজেকে নিয়ে একা কথা বলি, সেই কবিতার শক্তি মৃদু নিশ্বাসের মতো। কিন্তু আমার সঙ্গে যখন মুণ্ডেশ্বরী বা চাঁদ বা অরণ্য জুড়ে যায় তখন ভঙ্গি বদলে যায়। কেননা তখন অনেক স্বর অনেক চরিত্র একদল ছবি তখন একটা  অর্কেস্ট্রা একটা ব্যান্ড একটা অরণ্য তৈরি হয়।

প্রেমের দুটো রূপ থাকে। এক আত্মপ্রেম। দুই সন্ধিপ্রেম বা যুগ্ম প্রেম। নদীর কি পরকীয়া হয়? গাছের কি পরকীয়া হয়?  হয় না। কেননা ওদের সমাজ রাষ্ট্র নেই। গাছের ক্ষেত্রে কলম করা গাছ বলে পুলকিত হই ভালো ফলের আশায়। যাই হোক, সমাজের চোখে কোনও কোনও প্রেম পরকীয়া, যখন তাদের সম্পর্কের বাইরে চলে যায়। সমাজ নদীকেও বাঁধ দেয়। পুরুষ নারীকেও বাঁধ দেয়। সমাজ যেহেতু একটা দল, তাই তার শক্তি বেশি। প্রকৃতিগত ভাবে সবাই খোলা হাওয়া হতে চান কিন্তু সমাজের শক্তির জন্য নিয়ম বহির্ভূত হতে পারেন না। তাছাড়া সারা আকাশে মেঘ থাকে সর্বত্র বৃষ্টি হয় তেমনি সব নারী পুরুষের মধ্যে আবেগ আছে মিলনের ইচ্ছে আছে তবে কজন আর নদী হতে পারে রাধা হতে পারে? সব নারীর শরীর ছুঁয়ে থাকে কলসী কিন্তু রাধার শরীরে থাকে যমুনা। রাধার পিপাসা এক কলসী জল নয়। তার পিপাসা ছিল নদী যমুনা। যারা একঘটি দুঘটি জল তারা কি অনুভব করতে পারে এই মেঘজীবন এই নদীজীবন। সমাজ কাকস্নান করা মানুষ চায়। একটু খাবার হলেই হলো। পচা গন্ধ হলেই চলবে। একটা বাসা হলেই হলো ডিম পারলেই চলবে। অতো সুর আর গানের কি দরকার পান খেয়ে ওষ্ঠাধর লাল করলেই হলো। সেই সমাজের চোখে পরকীয়া একটা ভাঙন বিচ্যুত বা বিচলিত করা নিন্দা শব্দ। নাকী শব্দ। যতই সমাজ নাক ঘেন্না করুক। কোনও পরকীয়া প্রেম কুকুরের জীবনী লেখে না। সে শর্তহীন বলেই অনেক নিশ্বাস নিয়ে জড়িয়ে থাকে। সব প্রেমের কথায় শ্বাস থাকে না। সমাজ যাকে পরকীয়া বলে সেই রাধাপ্রেমে থাকে। এই প্রেমে নেশা আছে। রাধা প্রেমে কৃষ্ণ থাকে। তাই ধরিত্রী আর চাঁদ এতো পূর্ণিমা আনে। এই প্রেমে আকাশ থাকে। ঘরবাঁধা প্রেমে যে আলো থাকে তাকে মানুষ একদিন পাথরে পাথরে ঘষে আবিষ্কার করেছিল। ঘরের আলোয়  কথা থাকে তাপ থাকে তবে সঙ্গীত থাকে না। ঘরের আলো বড়ো একা। তার সঙ্গী  নেই সঙ্গীত নেই। রবিঠাকুর অনুভব করেছিলেন এই মাটি আকাশের বোধ। খুব কম জনই বুঝেছেন। অনেক বিখ্যাতগণ খালের নদী। বাকিরা বাদা ডোবা খাল বিল।

আমাকে শুভঙ্কর নদী বলেন। তবে সে নদী লুনী নদী। তার জোয়ার নেই। নানা ধারা যদিও মিশেছে। তাই আমার  সাহিত্য পবিত্র সঙ্গ পায়নি। সঙ্গীত হয়নি। সে যেন কোনও এক পরদেশীর ভাঙা ভাঙা গান। কেননা বুকের ভেতর এখনও শ্যাডো জোন।

 

মেঘপালক : রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতার যে মূল ভাব : মনের  ঘরে ও বাইরে অন্তরপ্রিয়তমের যে চাহিদা, এই ভাবনা কি কবিতায় অর্থাৎ কবিকে চালিত করে?

 

সুনীল : দেহ নয়, মনই ঈশ্বর। একজন মানুষ যখন অন্যকে মন দেন তিনি আসলে তাঁর ঈশ্বরকে দান করেন। তিনি  তাঁর আলো দান করেন। কবিতা তো সোনার তরী। মন যমুনায় ভাসে। ঘরের মন বাগান তৈরি করে। বাইরের মন  হলো অরণ্য। লোকারণ্য।

প্রেমের একটা স্টেশন হলো শেষের কবিতা। শেষের কবিতার মধ্যে শব্দের কান্না আছে। চোখের জলের কান্না ছিল কিন্তু বাংলার মেঘ কখনো এতো কাঁদেনি। অথচ কোনও কাঁদুনে কথা নেই। বৃষ্টির বাজনা জীবনকে আরও আরও সমৃদ্ধ করেছে। খুব মধুর এই কান্না। আলোকিত কান্না। এই কান্নায় অন্ধকার নেই। এতো চোখ ধোওযা কান্না আমি আগে কখনও পড়িনি। এই শেষের কবিতা যখন পড়ি তখন মনে হয়েছে,ঈশ্বর যেন লাবণ্যের মতো নারী অন্তত একদিনের জন্য দেন। এই  প্রেমে মন পাহাড়ের মতো উঁচু হয়। আর খুব মেঘ বৃষ্টি পায়। এই ভাবনা সবাইকে চালিত করবে এমন কোনও কথা নেই। যারা কবিতায় অমিত রায় তার স্রোত অবশ্য প্রেমের লাবণি সর্বস্ব। তাই প্রভাবিত  হওয়া স্বভাবসিদ্ধ।

 

শুভঙ্কর, সবাই প্রেমের অঞ্জলি পেতে পারে কিন্তু সিদ্ধি পায় না। প্রেমের সিদ্ধি সবার জন্য নয়। একজন নারী কামাতুর হলে তার পুরুষটির মিলনেচ্ছু হেতু শরীর থেকে জল বেরিয়ে আসে, তেমনি যদি মন থেকে আলো নেমে আসে তবে সেই মানসপ্রেমে সৌরশক্তি আছে। এসব কথা দিয়ে বলা যায় না। কথার ফ্রিকোয়েন্সি যত শব্দের কম্পাঙ্ক তার দশ গুণ। আর  আলোর তো কয়েক হাজার গুণ। তাই শব্দের  লিমিটেশন আছে। তবে  কবিতা যেহেতু শব্দের আলোকিত উৎস, তাই অন্তর লোকের আস্পৃহা কেবল সেই ভাবনা মেটাতে পারে বলে আমার বিশ্বাস।

 

মেঘপালক : আপনার কবিতায় প্রেমের গোপন দিকটির স্বীকারোক্তি বা স্বগতোক্তির দিকটি দৃষ্টান্ত সহকারে বলুন।

 

সুনীল : আমার বুকে আছে জন্ম জন্মান্তরের মেঘ। সেই মেঘের উপর পড়েছে অনন্ত সূর্যের আলো। আমি সেই আলো দিয়েই রামধনু আঁকতে চেয়েছি। যারা খরা তারা আমার এই ঈশ্বরের সৌন্দর্য হয়তো দেখতে পাবেন না। যারা রৌদ্রবৃষ্টির মানুষ যারা নানা রঙের ফুল অরণ্য জলাশয় পাখি পতাকা ভালোবাসেন তারা এই রামধনুর গন্ধে আকাশের দিকে তাকাবেন।

কজন নিজেকে আকাশের পুত্র ভাবতে পারে! হয়তো আকাশ সবাইকে আকাশের নীচে আশ্রয় দেয় না। সাত রঙের মধ্যে অমিয় আছে। চোখের দৃষ্টি সেই রঙ গ্রহণ করে দর্শন পায়।

আমাকে অনেক জীবনে এবং এই জীবনে অনেক রঙ ছুঁয়েছে। আমি প্রায়শই মহাজাতকের গল্প দেখতে পাই এবং পাঠ করি। আমার জীবন তাই বেশ বর্ণময়। আমি নিজে সারাদিনের অধিকাংশ সময়েই নীল রঙে মিশে থাকি। সে আমার একান্ত। সে  আমার  অনন্ত ভাগবত। সেখানে মেঘ পৌঁছতে পারে না  সে এক নীল চেতনা। সে আমার কবিতার মানস সরোবর। আমার কবিতা তাই বৃষ্টিঝরার শব্দ নয়। তাই আমি শব্দের ছন্দ সচেতনভাবে ত্যাগ করেছি। আমার  কবিতা তাই নৈশব্দের ছবি। তার অবস্থান মেঘের উপরে। শূন্যতার ওপারে। খুব বুদ্ধিমান মানুষেরা যারা মানুষকে ফুট ইঞ্চিতে দেখে বা সেই মানুষটির মৃত্যু হলে বলে ইঞ্জিন থেমে গেছে। যারা কবিতাকে ছত্রে পঙক্তিতে খোঁজে তাঁরা কবিতার  বাবুমশাই। নৌকায় বসে প্রাত্যহিক জীবনের চাহিদা মেটায়। তাঁরা না ধরতে পারে হাল না দাঁড় না লগি না নোঙর। তাঁরা পারাপারের অর্থ দেয় আর কবিতার অর্থ খোঁজে প্রেমের অর্থ খোঁজে জীবনের অর্থ খোঁজে।

বাকি যে ছটি রঙ আছে তাদের ভেতরে অনেক রিপু অনেক ইন্দ্রিয় আছে। তারা যে কবিতার রক্ত পায়নি এমন নয়। তাদের অবস্থান হৃৎপিণ্ড নয়। হৃদিভৌম নয়। তাঁরা শরীরে আছে। অঙ্গ হয়ে আছে। অনেক নার্ভতন্তু আছে। অনেক তীর্থ হয়ে আছে। কবিতার মন্ত্র তো কোনও বিশেষ তীর্থপীঠের জন্য হয়। যে মন্ত্রে তারকেশ্বরের তারকনাথ পুজো পায়  সেই মন্ত্রে কেদারনাথ অমরনাথ পুজো পায়। আমার সব প্রেমের কবিতা কোনও বিশেষ নারীকে নিয়ে নয় কোনও বিশেষ দিনের সূর্যের রৌদ্রবৃষ্টির মিলনে গমনে আমার  রামধনুর ছবি নয়। প্রেমের সৌন্দর্য যখনই ফুটে উঠেছে তখন কোনও কায়া নয়, ছায়া এঁকেছি। সেই  ছায়া মিথ হয়ে গেছে। পুরাণের নারীরা আশ্রয় নিয়েছে। সেখানে কাম নেই। গোপনীয়তা নেই। আকাশের রামধনু। আর রক্ত মাংসের প্রেমিকারা যারা আমাকে রিপু ইন্দ্রিয়ে খুঁজে আমাকে ইন্দ্রনীল ভেবেও নিজেকে ইন্দ্রাণী সাজিয়ে এক ইন্দ্রজাল রচনা করে 'উই লাভ ইন্ডিয়া' গান গাইতে চেয়েছে আমি সেখান থেকে পালিয়ে  এসেছি।

পৃথিবীর সব মানুষ মহাভারতের কোনও না কোনও চরিত্রে আছে। কোন চরিত্রে আমি? কার ঋষি পুত্র? কোন নারী রাতের ধ্রুবতারা শুকতারা?

শুভঙ্কর, একথা কি সত্যি বলা যায় আমার অঙ্গের কোন ধমনী বহন করে প্রেমিকার রক্ত? কামের উষ্ণতা দান করার জন্য মনুষ্য শরীরে বিশেষ অঙ্গ আছে। তার বৃদ্ধি হ্রাস আছে। কিন্তু জীবন জীবনই। প্রেমে কম জীবন বেশি জীবন বুঝি না। গ্রীষ্মে জীবন কম থাকে আর বর্ষায় বেশি থাকে বুঝি না। জীবনকে ঢেউ স্রোত উজান দিয়ে মাপি না। আমি  দেখি নদীর  বুকে  আকাশ এতটুকু কম পড়েনি। আমি সেই  আকাশে  রামধনু  আঁকি। তাই আমার সব কবিতাই আমার প্রেমিকা।

 

মেঘপালক : কবিতা কি সমাজ বা রাষ্ট্রকে পরিবর্তন করতে পারে? যদি পারে দৃষ্টান্ত সহকারে বলুন।

 

সুনীল : কবিতা হলো কথার আত্মা। কবিতার মধ্যেই আলোর শক্তি আছে, আগুনের শক্তি আছে। একজন মানুষের একটি সমাজের একটি রাষ্ট্রের আত্মকথা প্রকাশ করতে সাহিত্যের সব শাখাই পারে। তবে কবিতার যে মন্ত্র বা গান তা যেন লাইফ ব্লাড। এই কবিতা  হলো চেতনা তথা মানসিক শক্তি প্রকাশের মাধ্যম। একজন মানুষের আবেগ ও মেধাশক্তি লুকিয়ে  থাকে কবিতায়।

কবিতা একটা  স্রোত। নদীর  যদি স্রোত  না থাকে একটি নদীকে মৃত বলে মনে হয়। জাতি মৃত হয় যদি আবেগ প্রকাশ ভঙ্গি যথাযথ শিল্পসম্মত ও শক্তিশালী না হয় । যাই হোক,কবিতাকে সে কারণে শক্তিমন্দির বলে কেউ কেউ।

 

কবিতা সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সমাজ জাতিকে একতাবদ্ধ করে। যেমন দেশপ্রেমের গান ও কবিতা। মুকুন্দরাম অবিভক্ত বাংলার দাবিতে সমস্ত বরিশাল তথা পূর্ব বঙ্গের মানুষকে একতাবদ্ধ করেছিল। বন্দেমাতরম কেবল কবিতা ছিল না। তা ছিল বিপ্লবী ও স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কাছে উজ্জীবনীশক্তি। সারে জঁহাসে অচ্ছা হিন্দুস্থান হমারা, এই কবিতাগানটিও। দেশপ্রেমের যত গান আছে। সবই। ক্ষুদিরাম এর ফাঁসির পর 'একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি' এই গানটি বিপ্লবী জেল কয়েদিদের মুখে মুখে ঘুরত। নজরুলের বিদ্রোহী কবিতাটি নিষিদ্ধ করেছিল ইংরেজ সরকার। বোথা সরকার দক্ষিণ আফ্রিকায় মোলায়েম বেঞ্জামিন মোলায়েজকে ফাঁসি দিয়েছিল কেবল তাঁর কবিত্বশক্তির ভয়ে। কেননা দলে দলে ছাত্রযুবার দল বেঞ্জামিনের কবিতা পড়ে শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল। লোরকা যে খুন হয়েছিলেন তার পেছনে শাসকের ভয়। ডস্টোভস্কি বা সান ইয়াত সেন বা নাজিম হিকমত-এর মতো বিপ্লবী সংগ্রামী কবিরা যুগে যুগে নিজ নিজ দেশে কবিতার ইস্তাহার তৈরি করেন। কবিতা তাই এক নবাগত স্বাধীন দেশের ক্যাপসুল সংবিধান। তাই যে কবিতা ভালোবাসে সে মানসিক শক্তিতে  সাতগুণ এগিয়ে থাকে। মন তো পথ তৈরি করে, সেই পথে শরীর এগিয়ে যায়। তাই যে দেশে কবিতা নেই, সে দেশ শূন্য, ঊষর, শ্যামলিমাহীন। সে দেশ  চামচিকা আর বাদুড়ের বাস।

 

মেঘপালক : কবি জীবনানন্দ দাশের পরে বাংলা কবিতা সাহিত্যে কি নতুন কোনও ভাব বা ধারা বা আঙ্গিকের জন্ম  হয়েছে?

 

সুনীল : একটা সময় ছিল আলোচক কয়েকটা পেটেন্ট সামনে রেখে কবিতার মূল্যায়ন করতেন। এখন সাতটা ফ্যাক্টর বা ষোলোটা ফ্যাকাল্টি নয়, এখন বাহান্নপীঠ। জীবনানন্দ কবিতাসতী রেখে গেলেন বাংলা কবিতার জগতে। তা অর্থের মধ্যে  পঙক্তির মধ্যে  পঙ্গু হয়ে বসে  রইল না। ছড়িয়ে  পড়ল। জীবনানন্দের জন্য শক্তি পুজো শুরু হলো।

তবে এমনকি কোনও সাগর আছে যে কেবল একটি নদীর দ্বারা প্রভাবিত হয়? আর বিশ্বসাহিত্যে আমাজনের মতো মিসিসিপি মিসৌরীর মতো নীলনদীর মতো মানুষ জন্মায়নি যিনি একটি দেশকে নিদারুণ ভাবে প্রভাবিত করতে পারেন।  রবীন্দ্রনাথও গঙ্গার মতো ভারতীয় ভাষাকে উর্বর করেছেন বলে আমার মনে হয় না। একটা দেশ বা সাগর উপসাগর যেমন অনেক কবির কাছে ঋণী থাকে তেমনি বাংলা সাহিত্য তার ভাব শৈলী ও ভাষার জন্য জীবনানন্দের কাছে ঋণী  থাকবে।

জীবনানন্দ এক গভীর নদী যা বাংলাদেশের বিস্তৃত ভূখণ্ডকে প্লাবিত করে। কোনও কবি যদি একটি ভাষার কাব্য-সাহিত্যকে অর্ধ শতাব্দী ধরে প্রত্যক্ষ ভাবে প্রভাবিত করেন তাহলে তিনি অবশ্যই নক্ষত্রকবি।জীবনানন্দ তাই। রাতের  অন্ধকারে তিনি মায়াময় চাঁদ হয়ে থাকবেন। তবে এই প্রসঙ্গে বলা ভালো যে, বাংলা সাহিত্যের আধুনিক বিকাশে প্রথম একটা শতক যিনি সম্রাট ছিলেন, তিনি বঙ্কিমচন্দ্র। কবিতা না লিখেও তিনি কেবল আনন্দমঠের বন্দেমাতরম-এর জন্য  বলছি না। উপন্যাসের ভেতরে যে কাব্যসুষমা তথা কাব্য লাবণি রেখে গেছেন তার ঐশ্বর্য মাধুরী কবিদের কবিতায়  পাওয়া দুষ্কর। যদিও কবিতায় ছিলেন মহাকবি মাইকেল মধুসূদন। তেমনই পরের শতকে টোটাল সাহিত্য ছিল রবীন্দ্রনাথের দখলে। একটা  গোটা জীবনের বিকাশের জন্য তথা শৈশব থেকে বার্ধক্য  আমরা  রবীন্দ্রনাথকে পাই।

কবিজন্ম মানে অনেকগুলো জন্ম। অনেক প্রতীক থাকে। প্রকৃতিগত ভাবে কেউ যদি তৃণ হয়েও জন্মায় তাহলে ভাবতে হবে তিনিও কবিতায় ঈশ্বর হয়ে থাকেন।

আমাদের দেশের ঋষিমুনিরা আত্মমুক্তির সোপান রচনা করতে বৃক্ষ নদী নক্ষত্র এই তিনটির চরিত্র ধারণ করতেন। জীবনানন্দের ভেতর এই তিনশক্তি ছিল। তাঁর পরবর্তীতে কমসেকম পঞ্চাশ জন শক্তিশালী কবি এসেছেন অবিভক্ত বাংলা ভাষায়। তবে কেউ বৃক্ষ পেয়েছেন তো কেউ নদী পেয়েছেন। কেউ আবার নক্ষত্র। আল মাহমুদ প্রথম যৌবনে নদীমেঘনা ছিলেন। সমাজতন্ত্রী বিপ্লবী ছিলেন। দ্বিতীয় যৌবনে তথা শেষ অর্ধ জীবনে তিনি আকাশ আর নক্ষত্র তথা ধর্ম ও আধ্যাত্মিক কবিতা রচনা করেন। শামসুর রাহমানের কবিতা ছিল পদ্মার তরঙ্গ--স্বাধীনতার উত্তাল তরঙ্গ ও তার বানভাসি গৌরব। হাসান হাফিজুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুণ, রফিক আজাদ প্রমুখেরেরা ছিলেন স্বপ্নের সেনানী। তাঁদের সকলের এক নিজস্ব স্টাইল আছে। মিডিয়ার জন্য যে কবিরা অনেকেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন একথা সত্য। তবে মনে রাখতে  হবে, চূড়া সবসময় বিপজ্জনক। খুব ঝড়বৃষ্টি বজ্রপাত হয়। যারা সেই জায়গায় টিকে থাকেন তারা নিজ নিজ প্রতিভা গুণেই শক্তিধর। যেমন নজরুল সুকান্ত। যেমন সুধীন্দ্রনাথ বুদ্ধদেব। যেমন সুভাষ বীরেন। যেমন আলোক মণীন্দ্র। যেমন নীরেন আলোকরঞ্জন শক্তি সুনীল এবং জয়। বিশ শতকে এরাও ছিলেন। তবে এই শতাব্দী কার এখন বলার সময় আসেনি। এই ধূসর সময়ে মিডিয়ার কবি তৈরি করার যে বালখিল্য প্রয়াস তা বেশ আত্মঘাতী। বিশ শতকের শেষের দিকের উজ্জ্বল কবিরা এই একবিংশ শতকের শূন্য দশক ও প্রথম দশকে ধুঁকছেন। এখন অবশ্য  মধ্যমেধার  যুগ। লেখায়  শ্রম আছে স্বপ্ন আছে কিন্তু আত্মবিশ্বাস নেই কেননা মূল্যবোধ নেই প্রেম নেই চরিত্র নেই।

 

মেঘপালক : আপনার সৃষ্ট এমন দশটি কবিতার পঙক্তি উল্লেখ করুন যারা আপনার অসত সন্তান।

 

সুনীল : প্রথমেই বলি, এই একটা জায়গায় আমি অসম্ভব সুন্দর। প্রেম ও সৌন্দর্যচেতনা ও দুখানন্দবোধ আমার  কবিতার  উৎস। নির্জন একটা উঁচু পাহাড়ের বিভিন্ন অঙ্গে কিছু  ভার্জিন ল্যান্ড আছে জ্ঞানগঞ্জের মতো যা অদৃশ্য অথবা খুব শুচিতা ছাড়া  সেখানে  কেউ  প্রবেশ  করতে  পারে না। খুব চমক দেওয়া ডায়ালগ হয়তো আমার নেই। শব্দপ্রধান কবিদের মধ্যে আকর্ষণ করার জন্য এই স্টার লাইন থাকে। আমি কবিতায় পরমহংসকে খুঁজেছি। তাই কথামৃতের প্রতি আমার  বেশ ঝোঁক ছিল এবং আছে। বাইরে থেকে মাসল নেই। ভেতরে এক হাড়ের জোর আছে বা ধমনীতে রক্ত স্রোত আছে। তবে কবিতায় রামকৃষ্ণের ভাবসমাধি আর বিবেকানন্দের উচ্চারণচেতনা দুটোই আমাকে টানে। এখন নিজেকে খোঁজা যাক।

এক :  কান্নার ভিতরও  যেন রয়ে গেছে  এক একটা  জীবন (এই অমল  আকাশের  নীচে)।

দুই :  পৃথিবীর সমস্ত বাদ্যযন্ত্র মানুষের এক একটি অঙ্গ যেন একটিকে বাদ দিয়ে  সঙ্গীতে পূর্ণতা নেই (সাম্যগান)।

তিন : ঋতুও তো গান গায় নিজস্ব ঢঙে, সৃষ্টি করে  রঙলিপি (বসন্ত বাউরির গান)।

চার : স্ত্রী মরে, স্বামী মরে... বন্ধু  মরে না (বন্ধু )।

পাঁচ : হাসি আর অশ্রুতে প্রতিটি দিন পিয়ন, ইচ্ছার সৌরভ নিয়ে চিঠি সংগ্রহ করে (বর্ণলিপি প্রেম)।

ছয় : অধর বদলে গেলে চুম্বনের শব্দ ভিন্ন হয় (চুম্বন)।

সাত : ফুলের গন্ধ খুঁজতে হয় না, গন্ধ আলোর মতো নিজেকে  ছড়ায় (সিদ্ধি)।

আট : প্রেম যদি হয় আলোর চুম্বন, তবে যুদ্ধ এক বিশাল আকারের কালো বৃষ্টি (প্রতীপ)।

নয় : কিছুই লিখি না; শুধু অনুবাদ করি এক ভাষার কথা অন্য ভাষায়, এক জন্মের কথা অন্য জন্মে (বীজতলা)।

দশ : সব নারী মনে মনে অপ্সরা---সব  নারী মনে মনে  রাধা (রাস )।

এগারো : পৃথিবী কৃষ্ণপক্ষে চিঠি লেখে, শুক্লপক্ষে সেই চিঠি পড়ে (রাস)।

বারো : কপালে আগুন আর দু চোখে জল এই দুই উপাদানে কবির জীবন (সে)।

তেরো : শিশিরের কালি ছাড়া আমি আর একটাও কবিতা লিখব না (মেঘ আছে বৃষ্টি নেই)।

চোদ্দো :  নবগ্রহ উপশমে প্রেমই জীবনে কাঁচামূল (কথামূল)

পনেরো : চাঁদের  দিকে তাকিয়ে দেখো ও কি ভয় পায়  অমাবস্যাকে? (ঝাঁপ দেওয়ার আগে)।

ষোল : যে নারী গীত গায় প্রতিদিন---প্রতিদিন সে একবার গর্ভবতী মা হয় (সঙ্গীত)।

সতেরো : প্রেমের প্রকৃতি দূরে চলে গেলে জীবনে সবাই নষ্ট কোনারক (কোনারক )।

আঠারো : কথাই ব্ল্যাক বক্স প্রেম হেম বীজের মতন (ব্র্যাক বক্স )।

উনিশ : অন্ধকার এক কুরুক্ষেত্র, তবু সেই যুদ্ধের ভেতর গীতার অক্ষরমালা আকাশের তারা হয়ে যায় (হাঁ)।

বিশ : সেই অষ্টাদশী চাঁদ আমার বুকে চিতা হয়ে ভাসে এখনও (চাঁদকথা)।

একুশ : আমার শরীরের ভেতর মেঘমল্লার আর শেকড়ে বসে আছেন আমার বাবা  ( শেকড় )।

বাইশ: আমার বাবার নাম ধান আমার মায়ের নাম অন্ন (ভাত)

তেইশ : মাকে বুকে নিয়ে জন্ম নিক আমার সন্তান (শারদীয়া)

আমার উনিশটি কবিতার বইয়ের মধ্যে প্রথম দশটা থেকে অর্থাৎ ২০১০ সাল পর্যন্ত যা লিখেছি তা থেকে এই কটি পঙক্তি দিলাম।

 


 

 

 

1 comment:

  1. মননশীল সাক্ষাৎকার । অভিনন্দন সুনীলবাবুর ও মেঘপালককে ।

    ReplyDelete