মৃত এবং মৃত্যুপথ
রুমেলা দাস
পেন হাতে নিয়ে থরথর করে কেঁপে
চলেছে কৌশিক রায়। আজও কথা শুনছে না হাত, হাতের আঙুলগুলো। এই নিয়ে পাঁচ-পাঁচটা
মাস পুরো ব্ল্যাংক। বাণিজ্যিক পত্রিকার পুজোসংখ্যা তো দুরস্থ, ছোটখাটো
লিটিল পত্রিকার নিমন্ত্রিত লেখাটুকুও দেবার সামর্থ্য পর্যন্ত নেই! কি
অসম্ভব এক লড়াই হয়ে চলেছে মনের মধ্যে!
রাতের পর রাত দুঃস্বপ্ন দেখছে, মনে
হচ্ছে কোন অতলে তলিয়ে যাচ্ছে শরীর! এটাকে ঠিক কি বলা যায়, নিজেই বুঝে উঠতে পারছে
না! রাইটার্স ব্লক? নাকী মাথাটাই আদপে খারাপ হয়ে যাচ্ছে! লিখতে
বসার মুহূর্তে সব ঠিক। সাহসটাও পেয়ে বসে। পারবে, এবারে
ঠিক পারবে ভেবে প্রবল উৎসাহে বসে চেয়ার টেবিল গুছিয়ে। এত বছরের চেষ্টায় যে ভিত গড়ে
তুলেছে, তা কি এত সহজে শেষ হয়ে যেতে পারে? কিন্তু পেন ধরলেই কোনো
শব্দই আর বেরোয় না। নিতান্ত চুপ করে বসে থাকতে হয় ঘন্টার পর ঘন্টা। কি অসহ্য! সাহিত্যিক
কৌশিক রায় হারিয়ে যাচ্ছে! একটু একটু করে সব নষ্ট হয়ে যেতে বসেছে! বড়
দুর্বল, অসহায় লাগছে। এ হয় না। এ হতে পারে না। একটা উপায় বের করেছিল মাঝে। খাতা
পেন ছেড়ে ল্যাপটপে ট্রাই করেছিল লিখতে, যদি কোনো সমাধান হয়! আজকাল কে
আর খাতা পেনে লেখে? হয়ত পরিবর্তন নতুন কোনো পথ দেখাবে। হয়ত একঘেয়েমি
ব্যাপারটা কেটে গেলেই লেখা আপনি বেরিয়ে আসবে। কিন্তু সমস্ত ব্যাপারটা বলতে গেলে
মাঠে মারা গেছে! কিছুতেই হয়নি। কীবোর্ড টাইপ করার সময়ই সেই একই অসহায়
অবস্থা! সেই হাতজুড়ে রাক্ষুসে কাঁপুনি বন্ধ করে দিয়েছে আঙুলের চালনা! এ ধরণের
অসুস্থতা আজ পর্যন্ত কোনোদিন হয়নি পঞ্চাশ বছরে। বিপদটা সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছিল! এভাবে
চলতে থাকলে...! ছুটেছিল ফ্যামিলি ডাক্তার নিউরো স্পেশালিস্ট শৌনক
চ্যাটার্জির কাছে। এককালে বাবার মারাত্মক বাতের ব্যাথা সারিয়েছিলেন এই
ডাক্তারবাবুই। তাই একটা ভরসার জায়গা ছিল বরাবর। কিন্তু কপালের ফের! ডাক্তারও
ঠাওরাতে পারেননি সমস্যাটা কোথায়! অবসাদ আঁকড়ে ধরেছে। ঘুম আসে না রাতে! চোখের তলায়
কালো কালির মোটা পোচ পড়েছে। যে কেউ দেখলেই বুঝতে পারবে, সাহিত্যিক কৌশিক রায়
মানসিক অবসাদে ভুগছে। নাছোড়বান্দা হয়ে ডাক্তারের কাছ থেকে নিয়েছিল কিছু কম ডোজের
স্লিপিং পিল। লাভ হয়নি তাতেও। শেষমেষ বুদ্ধি দিয়েছিল বন্ধু প্রমিত। আজকালকার
ছেলেমেয়ের মত, ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলতে বলেছিল। প্রমিত হাসতে হাসতে
বলেছিল,
'এই একটা মিডিয়া। মানুষ থেকে মানুষের জনপ্রিয়তা যাই
হারিয়ে যাক না কেন, ফিরিয়ে আনতে বেশ সাহায্য করে। এখন তো প্রায়ই চোখে পড়ে, লেখক-লেখিকাদের
লেখার বিজ্ঞাপন অনেকটাই এগিয়ে নিয়ে যায় ফেসবুক। কয়েকজন তো ফেসবুকে লিখেই ঘন ঘন
সাহিত্যসভাতেও যাতায়াত শুরু করে দিয়েছে! তুই ও একবার ফেসবুকে উঁকি দিয়ে দেখতে
পারিস!'
প্রমিতের কথাটা মনে ধরেছিল
কৌশিক রায়ের! রাতারাতি অ্যাকাউন্ট খুলে কয়েকদিনে পোষ্টও করেছিল গোটাচারেক পুরোনো
জনপ্রিয় লেখার। কিন্তু দেখেছে হাতে গোনা পাঠক! যেসব লেখা পড়ে নিজের ম্যাগাজিনের জন্য
সম্পাদকেরা ফোনের পর ফোন করেছে। সেই লেখাতেই আজ দায়সারা বুড়ো আঙুল ঠেকিয়ে দিয়েছে
জনা-কতক! কেউ হয়তো না পড়েই...! নিজের
জন্য হাসি, না করুণা কোনটা করবে বুঝে উঠতে পারছে না। সত্যিই কি তাঁর সময়টা খারাপ
যাচ্ছে? সাহিত্যমঞ্চের পুরস্কারগুলো যেন কাঁচের আলমারি থেকে বেরিয়ে
গিলে খেতে আসছে ওঁকে। ঘেন্না ধরছে নিজের উপর। প্রচন্ড এক মানসিক যন্ত্রণায় কুঁকড়ে
আসছে সমস্ত শরীর। শীতল বরফকুচির মত চোরাস্রোত নেমে যাচ্ছে শিরদাঁড়া বেয়ে। দুহাতে
খামচে ধরেছে নিজের মাথা। আর কি কোনো উপায় নেই এই অবস্থা থেকে বেরোনোর? যে করেই হোক
এর থেকে বেরোতেই হবে! সবসময় কেমন যেন নিজেকে পাগল পাগল লাগছে! মনের
তেতো ভাবটা দিন দিন বিষের মত একটু একটু করে ছড়িয়ে পড়ছে সারাশরীরে। একদিন যে বাড়ির
নিস্তব্ধতা তাকে সাফল্যের শিখরে পৌঁছে দিয়েছে, মনে হচ্ছে তাই আজকে ওকে নিঃশেষ করে
দেবে? একটা মানুষ, অন্ততঃ একটা মানুষ যাকে ওর এই অসহায়তার কথা বললে কিছুটা স্বস্তি
পেত! কিন্তু কাকে পাবে? সবাইকে যে পিছনে ফেলে, এগিয়ে গেছে
সাহিত্যিক কৌশিক রায়!
ড্রয়িংরুমের চেয়ার ছেড়ে
বারান্দায় একটু পায়চারি করবে ভেবে, চেয়ার ছেড়ে উঠে যাবার মুহূর্তে হটাৎ-ই চোখ
পড়ে সেই ফ্রেমে বাঁধানো সাদা-কালো ছবির দিকে! চাপ চাপ অন্ধকার জমা হয় চোখের সামনে।
মাথার যন্ত্রণা যেন দ্বিগুণ হয়ে ওঠে। টলতে থাকে পায়ের তলার মাটি। মনে হয়, প্রবল এক
ভূমিকম্প উপস্থিত তার আর পৃথিবীর মাঝে! ছবিটা সাদা-কালো হলেও কি উজ্জ্বল সেই
মানুষটার চোখদুটো! কি নিদারুণ দীপ্তি!
সেই হাসি! সেই কঠিন আত্মবিশ্বাস!
শান্ত, কোমল অথচ কি দৃঢ়! উচ্চমাধ্যমিক
পাশের পর স্কুলের মাঠে দাঁড়িয়ে ব্যাচের
ছবিটা তুলিয়ে দিয়েছিলেন প্রধান শিক্ষক। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে বছর পনেরোর কৌশিক আর
সে...! ব্যঙ্গ করছে যেন কৌশিকের দিকে চেয়ে! তাচ্ছিল্যের আঙ্গুল তুলে বলছে-
"কি কৌশিক তুমি হেরে
যাচ্ছো? সবাই কথা শুনলেও তোমার হাতই যে আর তোমার বশে নেই! আর কত
দৌড়বে তুমি? এবার তো থামো!
জীবনের গতি হারিয়েছ তুমি! জিততে
তুমি পারবে না কৌশিক! কিছুতেই না! তোমার দিন শেষ!"
***************
"তোমাকে আত্মমগ্ন হতে হবে, যখনই
বিপদ গ্রাস করবে। সেই মুহূর্তে একমাত্র উপায় হবে তোমার আত্মমগ্নতা!"- বাবার
কথাগুলো অনেকবছর পরে আবার মনে পড়ছিল অতনুর। দক্ষিণ দিনাজপুরের ছোট্ট গ্রামেই ছিল
ওদের বাস। ওখানেই বাবা দীন হয়েও সেবা করতেন সমস্ত দীনজনের। বাবার কবিরাজি বিদ্যা
শিখেছিলেন অতনুর ঠাকুরদার কাছ থেকে। মানুষ পারে না এমন কোনো কাজ নেই। তাই দূর্বল
অসহায় মানুষগুলোকে সেবা করার সঙ্গে সঙ্গে ইচ্ছা শক্তির বিকাশ ঘটাতে বলতেন বাবা। ভিজে
উঠছিল চোখ, চোখের পাতা। নিঃশ্বাস পড়ছিল ঘন হয়ে। সমস্ত ব্যাপারটা বড়
আচমকাই ঘটেছে। কিভাবে, কিকরে? ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না এখনো। তবে কি
সত্যিই চোদ্দো নাড়ি আবর্তিত হয়েছে? ছোটবেলায় বাবা- দাদুর
কাছ থেকে শোনা 'টেলিকিনেসিস'
শক্তিটা কোনো অজানা কারণের
রন্ধ্রে রন্ধ্রে জেগে উঠেছে? অতি সূক্ষ্ম মূলাধার চক্র যেন গ্রথিত হয়েছে
কেন্দ্রে? কোথাও কি মানসিক ও শারীরিক শক্তি মিলে গেছে পরস্পর? রাগ,
খেদ যা কিছু জমা ছিল তীব্র কম্পনে অনুরণিত হতে হতে জমাট বেঁধেছে কি এই শরীরে? এও কি
সম্ভব? অতীতে এশিয়ায় যোগী সাধক, আফ্রিকাতে শামান নামের মানুষ এমনকি বৌদ্ধ লামাদের
গল্প ছোটবেলায় বাবা দাদুর মুখে শুনেছিল! জেনেছিল অনেক অজানা রহস্য! কিন্তু
তাই বলে...? নিজের
উপর বিশ্বাসটা হারালে যে চলবে না কোনোমতেই। এক আধটা বছর তো নয়, টানা কুড়ি বছরের
জমা হওয়া অভিশাপই সম্ভব করেছে হয়তো এসব...! ঈশ্বরে বিশ্বাস করে অতনু। এটুকু মানে, ভগবান
যদি কারুর থেকে কিছু ছিনিয়ে নেয় তার পরিবর্তে হয়ত কিছু দিয়েও দেয়! হতে পারে
ফেরত পাওয়াটা হয়ত সবাই সবসময় চোখে দেখতে পায় না। অনেকটা সমুদ্রের মত! মনে পড়ে
খুব ছোটবেলায় বাবা-মার সঙ্গে পুরী বেড়াতে গিয়ে একটা শাঁখের তৈরি চাবির রিং হারিয়ে
ফেলেছিল সমুদ্রে স্নান করতে গিয়ে। প্রিয় জিনিসটার জন্য সারাবিকেল এমনকি রাতেও ঘুম
হয়নি! কি আশ্চর্য! পরেরদিন ভোরে বাবা-মায়ের সঙ্গে পাড়ে হাঁটতে বেরিয়ে ঠিক হারিয়ে
যাওয়া জায়গা থেকেই খুঁজে পেয়েছিল মস্ত একটা ঝিনুক। ঝিনুকটাকে দেখে কি করে যেন আগের
দিনের মনখারাপ ভ্যানিশের মত উবে গিয়েছিল! কি সুন্দর ঝলমলে রামধনুর মত ছিল দিনগুলো? ছাপোষা
জীবনটা কিভাবে এমন করে বদলে গেল? কুড়িটা বছর! খিদে, তেষ্টা কোনোটাই আর তেমন লাগে না।
বাক্সের মত ভ্যাপসা ঘরটায় যেন জীবনের সমস্ত কালো একসঙ্গে জমাট হয়ে থাকে! পিচমোড়া
করে বেঁধে রাখা হাতদুটো শীর্ণকায় হয়ে গেছে! একটুও
মায়া হয় না কারুর? মাথাটা সামান্য ঘুরিয়ে নিজের হাতের দিকে বেশ
খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকে ও! মায়া হয় নিজের উপরই! নীলচে শিরাগুলো ঠেলে বেরিয়ে আসতে
চাইছে যেন চামড়ার ভিতর থেকে! শরীরে রয়েছে শুধু প্রাণবায়ু। এভাবে আর কতদিন বেঁচে
থাকতে পারবে ও? শরীরের বলশক্তি হারাতে বসেছে, তাকে ঈপ্সিত পথে চালিত করতে পেরেছে কি?
নাকি সবটাই মনের ভুল! কিন্তু চোখ বুজে থাকলেই মনে হয় প্রচন্ড ক্ষিপ্র এক
আগুনের গোলা, ক্রমাগত এগিয়ে আসছে ওর দিকে। কেঁপে ওঠে শরীরের সমস্ত স্নায়ু! আর
তারপরেই একজোট হয়ে অবচেতনে গড়ে ওঠে সব চিন্তা, সব ভাবনা।
যা ও ভাবতে চায়, দেখতে চায়! কিন্তু মন যে বড় জটিল। তাকে বোঝা যায়। মনে হয় এই কালো
শূন্যের মাঝে বসেও ওর শরীর, মন একজোট হয়ে সেই শত্রুর মুখোমুখি হয়ে সমস্ত
অন্যায় স্তব্ধ করে দিতে পারবে! বেশ কিছুক্ষণ অতনুর শরীরে দানা বাঁধে অন্য এক অতনু।
যে শুধু প্রতিশোধ চায়। প্রতিশোধ! শরীরময় আগুন নিভে গেলে, অতনু যেন এলিয়ে পড়ে।
সাড়হীন হয়ে পড়ে। আর তারপরেই সাংসারিক মন বারবার ছুটে যায় তময়ী-র কাছে! কান্না
পায়! তময়ী কোথায় আছে কিভাবে আছে কিছুই জানে না ও! একলা পথের বাধা পেরোতে পেরোতে
ওকে ভুলে যায়নি তো তময়ী? যে সময়টা একজন স্বামীর তার স্ত্রীর কাছে থাকা
জরুরি সে সময়ই হারিয়ে গেছে অতনু। চোখ বুজলেই এখনো মনে পড়ে সেই খোলা ছাদের কথা! যেখানে
ওরা দুজনে মুখোমুখি বেতের চেয়ারে বসে থাকত ঘন্টার পর ঘন্টা! কাস্তে চাঁদের হাসি
মেখে যেত ওদের দুজনের সোহাগ। মুছে যেত সমস্ত কষ্ট! সমস্ত
ব্যথা বেদনা। তময়ীর গলার রবীন্দ্রসংগীত মুগ্ধ করত ওকে। গোটা রাত ধরে পরম আদরে
ছুঁয়ে থাকত দুজন দুজনের হাত! মনে হত,
এর থেকে বড় সুখ হয়ত পৃথিবীতে আর
কিছু নেই! এর জন্যই হয়ত ও অপেক্ষা করে আছে জন্মযুগ! কিন্তু
কোথায় সেই আলো? কোথায়
সেই পরম আশ্লেষ? কবে একটু চোখের দেখা দেখবে তময়ীকে? আদৌ কি
কোনোদিন ওর কাছে ফিরে যেতে পারবে ও? হয়ত না! শ্বাসটুকুই যা আছে! মনে মনে
হাসে অতনু।
"আপনার খাবার!"- একটা
থালা মাটি ঘষটে এগিয়ে আসে অতনুর দিকে।
পোড়া রুটি দুটোর দিকে চেয়ে করুণা হয় নিজের উপর। করুণা হয় ওই রোগাটে পাকানো শরীরের লোকটার উপরও! গোলামী
করে যাচ্ছে কিভাবে বছরের পর বছর ওই শয়তানটার?
আজও চোখের সামনে ভেসে ওঠে সহজ
সরল কচি তরতাজা দুটো মন! ও কি তখনো এমনই ছিল? এমনটা
হবে যে ভাবেনি কোনোদিন অতনু। চারদেওয়ালের মাঝে পোকামাকড়ের কামড়, প্রায় না খাওয়া দিনের
অসম্ভব যন্ত্রণা। কুড়ি বছর বন্দী জীবনের শাস্তি, সঙ্গে
অসহনীয় বিদ্যুতের শক্...!
তবু যন্ত্রণাই যে শক্তি! ভয়
দেখেছে অতনু, ওর চোখে! কিসের ভয়? ইদানিং যতবারই আসছে ওকে অস্থির দেখেছে অতনু!
প্রথম যেদিন অতনুকে বন্দী করা হয়েছিল, সেইদিনও দেখেছিল ঠিক একইরকম ভয়...!
**************
"কি মশাই! নববর্ষ সংখ্যায় তো লেখা দিলেনই না! এখন
বলছেন পুজোসংখ্যার জন্যও পারবেন না! নেহাৎ
আপনি, তাই এতবার করে বলছি! ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছি না তো? বড় কোনো
পুকুরে ছিপ ফেলে বসে আছেন নাকি? তা পরিষ্কার বললেই হয়! উপন্যাসের রেটটা নিয়ে ভাবা
যেত! মাঝখান দিয়ে আমি বারবার মুখ নষ্ট করছি!"
"কার সঙ্গে কথা বলছেন মনে আছে?"
"হে হে তা আছে বৈকি!"
"দিনকাল বদলাচ্ছে দাদা। সেকেলে সাহিত্য সম্মান নিয়ে আর
কতদিন টানবেন! নতুন নতুন লেখক উঠে আসছে!
বিতান ধর বলে একটা বাচ্চা ছেলে
খুব ভালো লিখছে ইদানিং! বড় দরের পত্রিকাতে এখনই আমন্ত্রিত লেখা ছাপছে ওর! ফেসবুকে
ওর একেকটা পোষ্টে হাজার হাজার লাইক। একবার ওর ওয়ালে ঢুঁ দিয়ে আস্তে পারেন! ভাবুন..."
কট করে মোবাইলের লাল বোতামটা
টিপে দেয় কৌশিক রায়। এভাবে শুনতে হয়নি কোনোদিন! এতবড় স্পর্ধা! কান মাথা
বোঁ বোঁ করছে। মুখ বন্ধ করতে হবে সবকটার! পুরোনো একটা ভয় গুলিয়ে উঠছে শরীরের বাঁকে
বাঁকে! কেন এমন ভয় লাগে? বাড়ি, গাড়ি, টাকা কি
নেই কৌশিক রায়ের। বাবা ঠাকুরদার বনেদি ব্যবসার সঞ্চয় তো ছিলই! লিখেও কম কিছু পায়নি
ও! পায়ে পায়ে পকেটে ঢুকে পড়েছে সম্মানও। কারুর তোয়াক্কা করে না সে! কিন্তু আজ
সামান্য একটা সম্পাদক হয়ে এভাবে কথা বলে কিকরে লোকটা? তবে কি
সত্যিই ফুরিয়ে আসছে কৌশিক রায়? সত্যিই কি দিনশেষ হয়ে আসছে ওর?
চিন্তায় চিন্তায় ঘেমে ওঠে সমস্ত
শরীর। পিছিয়ে পড়ার চোরা আতঙ্কগুলো যেন আরো একবার মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে! ক্ষুধার্ত
নখ, দাঁত নিয়ে কেউ যেন ক্রমাগত কুরেকুরে খাচ্ছে। কপালের
ভাঁজগুলো একে একে জড়ো হয় দুই ভ্রুয়ের মাঝখানে! গুমোট ভাবটা বাড়তে বাড়তে শ্বাসনালির
অনেক কাছে চলে আসে। ঝিম ধরে আসে উত্তেজিত শরীরটা। দম আটকে আস্তে থাকে তার! নাহ, আর
কিছু ভাবতে পারছে না। প্রচন্ড অস্থির হয়ে ডায়াল করে একটা নাম্বার!
"হ্যালো...শুনতে পাচ্ছো? ... তোমাকে
একটা খোঁজ নিতে হবে...বিতান...
"দাদাবাবু, আপনার চিঠি!"- অস্ফুটে
একটা নিচু স্বর পর্দা সরিয়ে এসে দাঁড়ায় কৌশিক রায়ের ড্রয়িংরুমে।
টেবিলের দিকে আঙ্গুল তুলে
দেখাতেই চিঠিটা রেখে বেরিয়ে যায় বয়স্ক লোকটা! আরো
একবার ফোনের ওপাশের জনকে কিছুর নির্দেশ দিয়ে লাইনটা কাটে সেও। মুখে একচিলতে বাঁকা
হাসি ফুটে ওঠে। কৌশিক রায় বুঝতে পারেন, কিসের চিঠি এসেছে ওঁর কাছে। এবারের
সম্মাননার চিঠি! প্রসন্ন মুখে খুলে ফেলে খামের মুখটা! লাল সাদা শক্ত
কাগজটা টেনে বের করে আনেন খাম থেকে মুখের সামনে। নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস হচ্ছে
না! কি করে সম্ভব? তাহলে কি সত্যি সত্যি ...? শক্ত করে
চেপে ধরে হাতের খাম। শ্বাপদের মত ঘৃণা কিলবিল করে জড়িয়ে ধরে তাকে। দাঁতে দাঁত পিষে
আরো একবার পড়ে নামটা! বড় বড় সোনালী হরফে লেখা "বিতান ধর"! এবারের মনোনীত
লেখক বিতান ধর সাহিত্যিক সম্মান পাচ্ছে। নিমন্ত্রিত অতিথি কৌশিক রায়। টুকরো টুকরো
করে ছিঁড়ে ফ্যালেন কাগজটা। ঝুঁকে আসে মাথা। টেবিলের কাঁচে নিজের ছায়ায় দ্যাখেন
কৌশিক রায়! কুঁচকে যাওয়া গালে ভয় তিরতির করছে। কোথায় সেই দম্ভ! স্বমহিমা! আতঙ্কের
স্বেদ বিন্দু জমা কপালের এক প্রান্ত থেকে ওপর প্রান্তে। কার ষড়যন্ত্র এ? তবে কি
সেই নিভে যাওয়া আগুন, আবারো জ্বলে উঠেছে? ওরই
পিছনে জাল বিছিয়েছে? যে করে হোক জানতে হবেই! এভাবে থেমে যেতে পারে না
সব! ছিটকে বেরিয়ে আসেন ঘর থেকে। দ্রুত পায়ে এগিয়ে যান লম্বা লনের দিকে!
***************
সপাটে একটা লাথি মারতেই দরজাটা
খুলে যায়!
"কি করছিস তুই আমার সঙ্গে? বলবি
নাহলে এখুনি...
হাই ভোল্টেজ প্ল্যাগের সুইচের
দিকে হাত বাড়ায় কৌশিক রায়।
"করেছিস তো তুই আমার সঙ্গে! নিজেকে
প্রশ্ন করে দ্যাখ! নিজেকে হারানোর এত ভয়? তুই যে এতটা ভীতু সত্যি আমি
বুঝিনি। নাহলে কিকরে বন্ধু হিসাবে সেই স্কুল জীবন থেকে তোকে এতটা কাছে টেনে নিলাম।
আর তুইই...আমাকে এভাবে আটকে রাখলি..শেষ করে দিতে চাইলি আমায়...শেষ করে
দিলি আমার পরিবারটাকে?"- মৃদু স্বরে বলে ওঠে অতনু।
"যা করেছি বেশ করেছি! দেওয়ালের স্কুলের তোলা তোর পুরোনো
ছবিটা পর্যন্ত শান্তি দিচ্ছে না আমায়!"
"মেনে নিতে শেখ,
দেখবি পৃথিবীটা সুন্দর! তুই আসলে
লেখাকে ভালোবাসিস না। খ্যাতি ভালোবাসিস! লেখাকে যদি ভালোবাসতিস তবে এমন করতে
পারতিস না। অথচ দ্যাখ তোর পরিবার আর আমার পরিবারের আর্থিক অসঙ্গতি কতখানি। দুবেলা
দুমুঠো অন্ন জোগাড় করতেই হিমশিম খেতে হয়েছে ছোট থেকে। বাবা কবিরাজি ছেড়ে অকালে চলে
যাওয়ার পর টিউশন করে আর দু-কলম লেখার চেষ্টা করছিলাম। তুই তো সবই পেয়েছিলিস! গাড়ি
বাড়ি এমনকি বাবার ব্যবসাও! যদি চাইতিস আমি এমনি দিতে দিতাম আমার সমস্ত লেখা...আমার
এতগুলো পাণ্ডুলিপি তোকে চুরি করতে হত না! বন্ধুত্বের নাম করে বাড়ি এসে একটার পর
একটা চুরি করেছিস! আর আমি, আমি বুঝতেই পারিনি। শেষ পর্যন্ত আমাকেও এভাবে..."
"জ্ঞান দিস না! এমনি কোনো কিছু কেউ কাউকে দেয় না! ছিনিয়ে
নিতে হয়!"
হো হো করে হেসে ওঠে কৌশিক রায়।
"নিজেকে প্রশ্ন করে দ্যাখ। যা চেয়েছিলিস, পৌঁছতে
পেরেছিস সে জায়গায়?"
"পেরেছিতো। আমি জিতে নিতে শিখেছি। আজ অবধি সবকিছু। তোকে
আড়াল করার পর থেকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলাম। একের পর এক সাহিত্য পুরস্কার আমার
হাতের মুঠোয় আসছিল। খবরের কাগজের পাতায় উঠছিল ছবি। আমি পারছিলাম। সবাই তোকে ভুলে
গেছে! কেউ খুঁজে পায়নি তোকে! দু-তিনমাস!
তারপর তো পুলিশও... সব, সব
জায়গায় আমি...! পরিস্থিতি হালকা হতে তাই বনগাঁর গ্যারেজ ঘর থেকে
কলকাতাতেই আমার বাড়িতে রাখি! জানতাম কেউ আসবে না তোর খোঁজ করতে এখানে! আর
তাছাড়া এমন বন্ধুত্ব আমাদের! তোকে চোখে চোখে রাখাটাও প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। কিন্তু
কদিন ধরে ভোজনদা তোকে দেখছে। তুই বিড়বিড় করে কিসব বলিস? আর চোখ বুজে বসে থাকিস
ঘন্টার পর ঘন্টা! সব সব নিংড়ে নিয়েছি ওই শরীরটা থেকে! ওই আঙুলগুলো
থেকে! তাও তুই থামছিস না? বরাবরের জন্য তুই আমার প্রতিদ্বন্দ্বী। লেখাপড়া, খেলাধুলা
সব সব কিছুতেই। মেনে নিতে পারছিলাম না কোনোভাবেই। তাই মনের রাগগুলো লুকিয়ে
বন্ধুত্ব করি তোর সঙ্গে। মনে মনে ঠিক করেনি একদিন তোকে শেষ করবই। ছোট থেকে বাড়ির
সবাই আমার জেদের কাছে মাথা নিচু করেছে! আর তুই কোথাকার কে? কেন কেন এগিয়ে যাবি তুই?
একটা ফালতু কবিরাজের ছেলে হয়ে। সবাই ভালোবাসতো তোকে। রাগ হতো খুব। এমনকি আমার মাও
তুই অন্ত প্রাণ ছিল। আমার সব কিছু থাকা সত্ত্বেও কিছুতেই তোকে পেরোতে পারতাম না। নিজের
অজান্তেই তোকে নকল করে বসেছিলাম। ব্যবসাতেও মন বসত না। খালি মনে হত তোর সাফল্য যেন
আমার থেকে অনেকটা এগিয়ে। লিখতে শুরু করি। তোর স্বপ্নগুলো তছনছ করে দেবো ভাবি। কিন্তু
না কিছুতেই যেন পেরে উঠছিলাম না। তোকে সরাব ঠিক করেনি। কেন যে তোকে আজও বাঁচিয়ে
রেখেছি? ভুল করেছি। চরম ভুল করেছি আমি! আর তুই
এখানে বসে আমাকে তুকতাক করছিস? তাইতো থেমে যাচ্ছে আমার সবকিছু...কেন
লিখতে পারছি না আমি? কোনোদিন তো এমন হয়নি! আমার লেখার পথে যে আসবে, তাকেই..শেষ
করব আমি! বিদ্যুৎ বিষ!
এখন তুকতাক করে কি করতে পারবি
তুই? তোর ওই আত্মবিশ্বাস তোর ওই হাসি আমি সহ্য করতে পারি না।
আর তারপর-ই...
এক, দুই ,তিন আরো আরো হাই
ভোল্টেজ করে দেয় কৌশিক রায় সুইচটা ঘুরিয়ে
ঘুরিয়ে। থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে নীল হয়ে যায় অতনুর শরীরটা! অতনু কি মরে গেল? যাক! তাতেই
বুকটা জুড়োবে ওর। অদ্ভুতভাবে দ্যাখে অতনুর মুখে তখনো হাসি লেগে! যেন কৌশিককে
কি এক অদৃশ্য রেখায় হারিয়ে দিচ্ছে। বন্দি এতগুলো বছরেও এতটুকু শক্তি হারায়নি যেন!
ভাইব্রেট মুডে আচমকা কেঁপে ওঠে
কৌশিক রায়ের প্যান্টের পকেট। ফোনটা কানে ধরতেই একটা পুরুষ কন্ঠস্বর বলে ওঠে,
"স্যার, আমি জেনেছি। বিতান ধর, স্বনামধন্য
নিখোঁজ সাহিত্যিক অতনু ধর ও তময়ী ধরের একমাত্র ছেলে, এবারের
সাহিত্য..."- কানের মধ্যেটা বোঁ বোঁ করতে থাকে কৌশিক রায়ের। হাতের
মুঠো আলগা হয়ে মাটিতে পড়ে যায় মোবাইল ফোনটা! একি শুনল ও? এ কি করে সম্ভব? দেওয়াল
ধরে আসতে আসতে বসে পড়ে কৌশিক। সামনের শক লেগে পড়ে থাকা নিস্তেজ শরীরের সঙ্গে নিজের
একটা অসম্ভব মিল খুঁজে পাচ্ছে সে। দুটো শরীরই মৃত্যুর পথে...!
![]() |
রুমেলা দাস
|
No comments:
Post a Comment