Tuesday, September 22, 2020

সুখের সন্ধানে - সহেলী চট্টোপাধ্যায়

 সুখের সন্ধানে

সহেলী চট্টোপাধ্যায়

 

শান্তি জিনিষটার একান্ত অভাব আমাদের রনির জীবনে। গ্র্যাজুয়েশানের পর একটা প্রাইভেট স্কুলে পড়াচ্ছে রনি। প্রথম প্রথম ভালো লাগলেও এখন আর একদমই ভালো লাগে না। এর চেয়ে অন্য কিছু করলে বরং ভালো হতো। বেশ কিছু সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিল রনি। বরাত জোরে একটা লেগেও গেল। বাড়ির সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। কিন্তু রনির কপালে সুখ লেখা নেই। একবছর হতে না হতেই রনি বিরক্ত হয়ে পড়ল। একই কাজ বেশি দিন ও চালিয়ে যেতে পারে না। মাথা গরম করে একদিন চাকরিটা ছেড়ে দিল। বাড়ির সবাই, আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী সবাই রনিকে দোষারোপ করতে লাগল। কেউ কেউ তাকে ভালো কোনও সাইক্রিয়াটিস্ট দেখানোর পরামর্শ দিল। কেউ বলল লম্বা একটা টুর করলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। মা হাতে অনেক রকম তাবিজ কবচ বেঁধে দিলেন। ঠাকুরমা বললেন দেখেশুনে একটা বিয়ে দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। বাবার মত হল বেশ করে ঘা কতক দিলেই সিধে হয়ে যাবে রনি। এইসব শুনে দিশা খুব হাসত। বলতো তুই একটা পাগল! 

    ওদিকে রনি কিন্তু বসে নেই। কিছুদিন সে শহরের রাস্তায় টোটো চালাল। টোটো অবশ্য সে ভাড়ায় খাটতো। একদিন বাবার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। বাবা নিজেই প্যাসেঞ্জার। থমথমে মুখে বসে রইলেন গোটা রাস্তা। রনির টোটো চালানোর ইতি এখানেই। বাবা তারপর থেকে আর কথা বলেন না। দিন কতক রনি খবরের কাগজে খুব লেখালেখি করল। একটাই জীবন আমাদের। রনি চায় সব রকম কাজ সে করে দেখবে। দোকানদারিটাও মাঝে মাঝে করে। ওর এক বন্ধুর স্টেশানারি দোকান আছে।

    একদিন খবরের কাগজে একটা বিজ্ঞাপনে ওর চোখ আটকে গেল। সিরিয়ালে অভিনয় করার জন্য অল্প বয়স্ক অভিনেতা চাই। একদম নতুন মুখ চাইছে। রনি যোগাযোগ করল, অডিশন দিল এবং কাজটা পেয়েও গেল। তবে খুব বেশি পার্ট নেই রনির। এই কাজটা করতে করতে আর ও কিছু অফার পেল রনি। এই ভাবে ছোট ছোট কাজ করতে করতে রনি একটা মেগায় লিড রোল পেয়ে গেল। একেবারে নায়কের চরিত্রে। যে সব আত্মীয়-স্বজন তাকে দেখলে কথা শোনাত তারাই এখন রনির প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এই সিরিয়াল থেকে একদিন সিনেমাও করে ফেলল। রনিকে এখন সবাই চেনে। চোর, পুলিশ, গোয়েন্দা, ডাকাত, ডাক্তার, উকিল, চাকুরে, টিচার, দোকানদার, অটোচালক ইত্যাদি বিভিন্ন ভূমিকায় অভিনয় করার পর রনির মনে হল সে এত দিন যা চেয়েছিল তাই পেয়েছে। অভিনয় এমন একটা প্রফেশন যেখানে তার সব রকম কাজই করা হয়ে যাচ্ছে। 

    টলিউড ছাড়িয়ে বলিউডে গিয়েও সে দু একটা মেগা করে এলো।

    এমনি করেই দিনগুলো সুন্দর ভাবে কেটে যাচ্ছিল। শুটিং এর জন্য রনিকে নানান দেশ বিদেশ ঘুরতে হয়। প্রথম দিকে খুব ভাল লাগলেও রনি আবারও বোর হয়ে গেল। এটা বোধহয় ওর একটা সমস্যা। কোন অবস্থাতেই বেশিদিন সে ভাল থাকতে পারে না। সব চেয়ে দুঃখের কথা হল পাড়ার মোড়ে সে আর দিশার সঙ্গে ফুচকা খেতে যেতে পারে না।  আগের মত বেড়ানো ও হয়না। গল্পের বই পড়ার ও সময় হয় না।  রনি যেখানেই যায় সেখানেই ভিড় হয়ে যায়। আজকাল রনিও চালাক হয়ে গেছে। সে একটা কালো চশমা আর দাড়ি লাগিয়ে মাঝে মাঝে ইচ্ছামত ঘোরাফেরা করে। কিন্তু পাবলিক কে বোকা বানানো ও খুব মুস্কিল। এর থেকে এসএসসি ক্লিয়ার করে স্কুলে চাকরি করলেই ভাল হত। দিশা তাকে কতবার বলতো।  দুর দুর কিচ্ছু মজা নেই এই নায়ক হয়ে। কিন্তু সেটা বুঝতে তার পঞ্চাশটা বছর চলে গেল। 

    বাড়িতে এখন আর কেউ নেই। বাবা মা ঠাকুমা সবাই ছবি হয়ে গেছে।

বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। কতদিন ভাইফোঁটা নেওয়া হয়নি। ভাগ্নে ভাগ্নিরা কোন ক্লাস রনি কিছু জানে না। আর নিজের খামখেয়ালীপনার জন্য সংসারটা হয়েও হয়নি। দিশার সঙ্গে ছ বছর এর মধ্যেই ডিভোর্সটা হয়ে গেছিল। এখন মনে হয় দিশাকে আরেকটু সময় দিলে ভাল হত। তখন মন্দিরা বলে একজন নায়িকাকে এত ভাল লেগে গেল! দিশাকে ওর কাছে খুব সাধারণ মনে হত। কিন্তু মন্দিরা আবার অন্য একজন ভাল মালদার পার্টি দেখে সরে পড়ল। দিশার সঙ্গে তখন ওর সম্পর্ক খুব খারাপ হয়ে গেছে। অথচ দিশা ওর কতদিনের বন্ধু ছিল।

     শুটিং সেরে রাতে যখন ও ঘরে ফেরে গোটা বাড়িটা যেন তাকে গিলতে আসে। পরিচারক তাকে জলের গ্লাস এগিয়ে দেয়। রনি ভাবতে থাকে একটু আগেই একটা সুন্দর পারিবারিক ধারাবাহিক এর শুটিং সেরে সে বাড়ি এলো। সেই বাড়ির সে মেজোকর্তা। কারোর কাকু, কারোর ছেলে, কারোর বোন, কারোর বাবা। আর এখন সে একদম একা। রনি আর ভাবতে পারে না। বিখ্যাত অভিনেতা রঞ্জন রায় নিজের ফোন সার্চ করতে থাকে। বিশেষ একটা নম্বর তার এখন খুব দরকার।  


 

No comments:

Post a Comment