Saturday, May 14, 2022

ঐতিহ্যের রথযাত্রা উৎসব

 ঐতিহ্যের রথযাত্রা উৎসব

সৌরভকুমার ভূঞ্যা

 

হিন্দুদের একটি অন্যতম উৎসব হল রথযাত্রা সাধারণত জুন-জুলাই মাসে ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় তো বটেই, দেশের বাইরেও নানা জায়গায় এই রথযাত্রা উৎসব দেখা যায় মূলত হিন্দুদের উৎসব হলেও বর্তমানে এটি গণউৎসবে পরিণত হয়েছে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সমস্ত মানুষকে এই উৎসবে সামিল হতে দেখা যায় রথযাত্রা উৎসবের কথা বলতে গেলে অবশ্যই করে এসে যায় পুরীর কথা পুরী হল ভারতের চারটি পবিত্র ধামের একটি বাকি তিনটি হল বদ্রীনাথ, দ্বারকা ও রামেশ্বর ভারতবর্ষের সবচেয়ে বড়ো রথযাত্রা হয় পুরীতে অনেকের মতে পুরীতেই রথযাত্রা উৎসবের সূচনা তবে এই নিয়ে ভিন্ন মতও রয়েছে

    অেক ঐতিহাসিকের মতে রথযাত্রা উৎসবের ইতিহাস অনেক প্রাচীন বিখ্যাত চীনা পর্যটকের বিবরণে পঞ্চম শতকে রথযাত্রা উৎসবের উল্লেখ রয়েছে তিনি বলেছেন খোটানের রথযাত্রা উৎসবের কথা পশ্চিম চীনের একটি ছোট্ট শহর হল খোটান এখানকার রথযাত্রা উৎসবে রথে বুদ্ধমূর্তি থাকত খোটানের রাজা রথে ঝাড়ু দিয়ে জল ছিটিয়ে দেওয়ার পর রথযাত্রা উৎসবের সূচনা হত জুন মাসে এই উৎসব পালিত হত বর্তমানে পুরীতে যে রথযাত্রা উৎসব হয় সেখানেও আমপা একই সময় ও একই প্রথা দেখতে পাই ফা-হিয়েন পাটলিপুত্রের রথযাত্রার কথাও বলেছেন গৌতম বুদ্ধের জন্মদিনের দিন এই উৎসব পালিত হয় কুড়িটি রথের এক বিশাল বুদ্ধ রথযাত্রার কথা তিনি বর্ণনা করেছেন এখান থেকে অনেকে মনে করেন বর্তমানে পুরীর যে রথযাত্রা তা বুদ্ধরীতির অনুসরণ এখানে একটি কথা বলার, পুরীর রথ মানে মূলত জগন্নাথের রথ জগন্নাথদেবকে বিষ্ণুরই আরেক রূপ বলে মনে করা হয় আবার গৌতম বুদ্ধকে মনে করা হয় বিষ্ণর নবম অবতার পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে বিষ্ণুর যে দশ অবতারের মূর্তি খোদিত আছে সেখানেও নবম অবতার হিসাবে গৌতম বুদ্ধের মূর্তি খোদিত আছে আবার হেমচন্দ্র সুরি তাঁর বই পরিশিষ্ট পর্বতে জৈনদের রথযাত্রা উৎসবের কথাও উল্লেখ করেছেন

    রথযাত্রা উৎসবের সূচনা নিয়ে যে মতই থাক না কেন, একথা পরিস্কার রথ-সংস্কৃতি অনেক প্রাচীন হিন্দু ধর্ম-মতে রথের উল্লেখ রয়েছে বৈদিক যুগ থেকে সেখানে বলা হয় সূর্য দেবতা সাতটি ঘোড়ায় টানা রথে করে গোটা পৃথিবী প্রদক্ষিণ করতেন ঞক বেদেও আমরা রথের উল্লেখ দেখতে পাই রামায়ণ-মহাভারতেও আমরা রথের ব্যবহার দেখি আবার রথযাত্রা উৎসব মূলত যে দেবতাকে কেন্দ্র করে, সেই জগন্নাথ দেবের আরাধনার উল্লেখ রয়েছে রামায়ণে বাল্মিকী রচিত রামায়ণে উল্লেখ রয়েছে লঙ্কা ছেড়ে দেশে ফিরে আসার সময় রাম বিভীষণকে বলেছিলেন তাঁর অনুপস্থিতিতে প্রভু জগন্নাথের আরাধনা করতে

    এসব বিচার করলে অবশ্যই বলতে হয় রথযাত্রার ইতিহাস অনেক প্রাচীন তবে বর্তমান সময়ের যে রথযাত্রা অনেকের মতে তার সূচনা পুরীতে কিন্তু ঠিক কবে থেকে এখানকার রথযাত্রার সূচনা তা নিয়ে সঠিক কোনো তথ্য আজও জানা যায়নি বিখ্যাত ঐতিহাসিক এস.এন. রাজগুরু, অধ্যাপক কে-এস. বেহেরা, ড. হরনাথ ঝুলকি পুরর রথযাত্রা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন তবে মোটামুটি ভাবে এটা ধরে নেওয়া হয় পুরীর রথযাত্রা উৎসবের সূচনা ত্রয়োদেশ শতাব্দীতে উল্লেখ্য, গজপতিরাজ চোড়গঙ্গাদেব পুরীতে প্রথম জগন্নাথ মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন তার বংশধর গজপতিরাজ প্রথম নরসিংহবর্মণ কোনারকে রথ নির্মান করেন এবং রথযাত্রা উৎসবের সূচনা করেন তাঁর নির্মিত রথের ছিল ২৪ টি চাকা। সাতটি ঘোড়া এই রথ টানত

    রথযাত্রা উৎসবের সূচনা এই নিয়ে নানান পৌরাণিক ব্যাখ্যা রয়েছে তেমনি করে পৌরাণিক ব্যাখ্যা রয়েছে প্রভু জগন্নাথদেবের আবির্ভাবেরও রথযাত্রা উৎসবের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বিষ্ণুর অবতার কৃষ্ণের নাম মনে করা হয় খ্রিস্টপূর্ব ৩২২৮ অব্দে তিনি পৃথিবীতে জন্মেছিলেন জগন্নাথ রূপে তিনি পৃথিবীতে পূজিত হতেন রথযাত্রা উৎসব মানে জগন্নাথ, দাদা বলরাম ও বোন সুভদ্রার রথে করে মাসিবাড়ি যাত্রা

    ভগবত পুরাণ মতে, কৃষ্ণের মামা কংস কৃষ্ণ ও বলরামকে হত্যা করার মতলবে তাদের মথুরাতে আমন্ত্রণ জানান তিনি অক্রুরকে পাঠান রথে করে কৃষ্ণ ও বলরাম সেই রথে করে মথুরার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন সেই দিনকে স্মরণ করে রথযাত্রা উৎসবের সূচনা বলে অনেকের বিশ্বাস

    আরেকটি মতে, সূর্যগ্রহণ উপলক্ষ্যে কৃষ্ণ বলরাম ও সুভদ্রাকে নিয়ে কুরুক্ষেত্র গিয়েছিলেন ঘোড়ায় টানা রথে করে অনেক ব্রজবাসীও একই উপলক্ষ্যে কুরুক্ষেত্র গিয়েছিলেন সেখানে কৃষ্ণের সাক্ষাৎ পাওয়ার পর তারা তাকে বৃন্দাবনে নিয়ে যেতে চান কৃষ্ণ-বলরাম-সুভদ্রার রথের ঘোড়া ছেড়ে দিয়ে তারা নিজেরাই রথ টেনে নিয়ে আসেন বর্তমান রথযাত্রার যে রীতি তা এই ঘটনাকে স্মরণ করে বলে অনেকের মত এমনও বলা হয় যে সুভদ্রা তার বাবার বাড়ি দ্বারকা যেতে চাইলে কৃষ্ণ ও বলরাম তাকে সঙ্গে নিয়ে রথে করে শহরের রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছিলেন সেটাই রথযাত্রা উৎসব হিসাবে পালিত হয়ে আসছে

    পুরাণে আমরা আরও একটি ব্যাখ্যা দেখতে পাই পুরাণ মতে জগন্নাথের জন্ম গুণ্ডিচাবাটিতে তিনি ইচ্ছা প্রকাশ করেন প্রত্যেক বছর তিনি একবার করে তার জন্মস্থানে যাবেন এবং সেখানে সাতদিন কাটাবেন তাই প্রত্যেক বছর তিনি বলভদ্র ও সুভদ্রাকে নিয়ে রথে করে গুণ্ডিচাবাটির উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন এবং সাতদিন সেখানে কাটিয়ে ফিরে আসেন

    রথযাত্রা উৎসবের এমনই আরও অনেক পৌরাণিক ব্যাখ্যা রয়েছে যাই হোক, রথযাত্রা উৎসবের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে প্রভু জগন্নাথদেবের নাম পৃথিবীতে তাঁর আবির্ভাব নিয়ে কিংবা পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে তাঁর অবস্থান নিয়ে নানান পৌরাণিক ব্যাখ্যা রয়েছে পূর্বেই বলেছি জগন্নাথ হলেন কৃষ্ণের আর এক রূপ, যিনি বিষ্ণুর অবতার জগন্নাথ কথার অর্থ, জগতের নাথ বা পৃথিবীর অধীশ্বর অনেকের মতে জগন্নাথের মূর্তি বুদ্ধমূর্তির রূপান্তর আবার কেউ কেউ বলেন তিনি আসলে ছিলেন অনার্যদের দেবতা সময়ের প্রবাহে তিনি হিন্দুদের দেবতায় পরিণত হয়েছেন

    জগন্নাথ যে অনার্যদের দেবতা তাই নিয়ে স্কন্দপুরাণে সুন্দর ব্যাখ্যা রয়েছে সেকথা বলার আগে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করার তখন দ্বাপর যুগ কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শেষে কৃষ্ণ তখন দ্বারকায় অবস্থান করছেন একদিন তিনি এক গাছের নীচে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন জরা নামে এক শবর দূর থেকে তাঁর রাঙা পা কে টিয়াপিখ মনে করে বাণ মারে সেই বাণের আঘাতে কৃষ্ণের মৃত্যু হয় তাঁর মৃত্যুর খবর পেয়ে অর্জুন দ্বারকায় আসেন তিনি দেখে সৎকারের পর কৃষ্ণের শরীর পুড়ে ছাই হয়ে গেলেও নাভিদেশ অক্ষত রয়ে গেছে সেই সময় দৈববাণী হয় এবং সেই নির্দেশ মতো অর্জুন তাঁর নাভিদেশ সমুদ্রে নিক্ষেপ করেন সমুদ্র স্রোতে ভেসে চলতে থাকে সেই নাভি অনুতপ্ত সেই শবর সেই লক্ষ্য করে ছুটতে থাকেন দ্বারকা থেকে যাত্রা শুরু করে তিনি এসে থামেন পুরীতে এখানে তিনি স্বপ্নাদেশ পান ভগবান তাকে আদেশ দেন সমুদ্র থেকে তার নাভি তুলে নিতে এবং জানান এখন থেকে তিনি তার বংশধরদের হাতে পুজো  নেবেন জরা সেই মতো কাজ করেন এবং ভগবান বিষ্ণু ক্রমে নীলমাধব রূপে শবরদের দ্বারা পূজিত হতে থাকেন

    এবার আসি স্কন্দপুরানের কথায় সময়টা কলিযুগ আজ থেকে কয়েকশো বছর আগের কথা বর্তমানে যা উড়িস্যা পূর্বে তার নাম ছিল কলিঙ্গ সেখানে ইন্দ্রদুম্ন নামে এক রাজা ছিলেন তিনি বিষ্ণুর উপাসনার জন্য একটি বড়ো মন্দির নির্মাণ করেন কথিত আছে যে, একদিন রাজসভায় তিনি জানতে পারেন ভগবান বিষ্ণু নীলমাধব নাম নিয়ে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছেন এবং পূজিত হচ্ছেন কিন্তু তিনি কোথায় আছেন সে বিষয়ে জানতে পারেন না তাই তিনি একদল ব্রাহ্মণকে পাঠালেন রাজ্যের চারিদিকে, ভগবানের খোঁজে কিন্তু সমস্স ব্রাহ্মণ ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসেন একজনই কেবল ফেরেন না, তিনি হলেন বিদ্যাপতি

    হাঁটতে হাঁটতে পথ হারিয়ে বিদ্যাপতি অনার্য শবরদের শহরে এসে পৌঁছোন জঙ্গেলর মধ্যে তাকে উদ্ধার করেন ললিতা ললিতার পিতা বিশ্ববসু শবররাজ প্রথম দর্শনে বিদ্যাপতি সুন্দরী ললিতার প্রেমে পড়ে যান এবং একসময় তাকে বিয়ে করেন বিশ্ববসুর অনুরোদে বিদ্যাপতি সেখানে থেকে যান

    বেশ কয়েকমাস কেটে যায় সেখানে থাকতে থাকতে বিদ্যাপতি লক্ষ করেন বিশ্ববসু প্রতিদিন রাতে জঙ্গলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যান এবং পরেরদিন দুপুরে ফিরে আসেন ললিতাকে জিজ্ঞেস করে বিদ্যাপতি জানতে পারেন বিশ্ববসু জঙ্গলে নীলমাধবের পুজো করতে যান বিদ্যাপতি বিশ্ববসুকে অনুরোধ করেন তাকে নীলমাধবের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিশ্ববসু প্রথমে রাজি হন না শেষমেষ তাকে চোখ বন্ধ করে নিয়ে যাবেন এই শর্তে রাজি হন যাওয়ার দিন ললিতা বিদ্যাপতিকে কিছু সরিষার বীজ দেন বিদ্যাপতি সেগুলো রাস্তায় ফেলতে ফেলতে যান যাতে ভবিষ্যেত এই পথ চিনতে কোনো অসুবিধা না হয় নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছোনোর পর বিদ্যাপতি নীলমাধবকে দেখতে পান

    এরপর বিদ্যাপতি সেখান থেকে রাজ্যে ফিরে আসেন এবং রাজা ইন্দ্রদুম্নকে নীলমাধবের কথা জানান এও জানান নীলমাধব রাজার মন্দিরে পূজিত হতে চান নীলমাধবকে আনার জন্য রাজা নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছোন কিন্তু গিয়ে দেখেন নীলমাধবের মূর্তি সেখানে নেই ক্রুদ্ধ রাজা বিশ্ববসুকে গ্রেপ্তার করেন ঠিক তখন রাজা এক দৈববাণী শোনেন সেই কন্ঠ রাজাকে বলেন শ্রীক্ষেত্রে মন্দির নির্মান করতে সেখানে তিনি দারুমূর্তিত পূজিত হবেন

    রাজা ফিরে এসে শ্রীক্ষেত্রে মন্দির নির্মাণ করেন কিন্তু অনেক অপেক্ষার পরও তিনি নীলমাধবের সন্ধান পান না তখন রাজা স্থির করেন অনশন করে দেহত্যাগ করবেন ঠিক এমন সময় রাজা স্বপ্নাদেশ পান নীলমাধব রাজাকে বলেন যে পুরীর সমুদ্রতটে দারুব্রহ্মরূপে তিনি প্রতীয়মান হবেন স্বপ্নের নির্দেশ মতো রাজা সমুদ্রতটে যান এবং একটি কাষ্ঠখণ্ড দেখতে পান যার গায়ে শঙ্খ, গদা ও পদ্ম শোভিত ছিলকিন্তু লোকজন নিয়ে অনেক চেষ্টা করেও রাজা সেই কাষ্ঠখণ্ড তুলতে পারেন না এমন সময় রাজা আবারও স্বপ্নাদেশ পান সেই নির্দেশমতো তিনি পুরীর তটে সোনার রথ আনেন এবার সেই কাঠের একদিক ধরেন বিশ্ববসু অন্যদিক ধরেন বিদ্যাপতি এবং খুব সহজেই সেই কাঠ রথে উঠে যায়

    নীলমাধাব রাজাকে স্বপ্নে জানান এই দারুব্রহ্ম থেকে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার মূর্তি নির্মাণ করে মন্দিরে রাখতে কেননা এখানে তারা তিনজন একসঙ্গে পূজিত হবেন তিনজনের একসঙ্গে পূজিত হওয়ার ব্যাপারেও একটি পৌরাণিক ব্যাখ্যা রয়েছে একদিন কৃষ্ণের স্ত্রীরা মাতা রোহিনীকে অনুরোধ করেন কৃষ্ণের লীলাকথা শোনানোর জন্য সেকথা বলার সময় পাছে কেউ ঘরের মধ্যে না ঢুকে পড়ে সে জন্য তিনি সুভদ্রাকে দরজার বাইরে পাহারা দিতে বলেন ইতিমধ্যে কৃষ্ণ ও বলরাম সেখানে হাজির হন সুভদ্রা দু-হাত মেলে তাদের ভেতরে ঢুকতে বাধা দেন দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে তারা রোহিনীর কথা শুনতে পান তাঁরা এতটাই আকৃষ্ট হন যে নিমগ্ন হয়ে শুনতে থাকেন ঠিক সেই সময় নারদ মুণি সেখানে হাজির হন তিনজনকে স্থির হয়ে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তিনি ইচ্ছা প্রকাশ করেন তাঁরা যদি মর্ত্যে এভাবে পূজিত হতেন ঈশ্বর তার মনোবাঞ্ছা পূরণ করেন তাই এখন পুরীর মন্দিরে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা একসঙ্গে পূজিত হন তবে এই নিয়ে আরও অনেক ব্যাখ্যা আছে

    তবে যাই হোক, দারুব্রহ্ম থেকে মূর্তি নির্মাণ করার জন্য রাজা দক্ষ কারিগরের খোঁজ করতে থাকেন অবশেষে অনন্ত মহারাণা নামে এক বৃদ্ধ কারিগর হাজির হন আসলে তিনি ছিলেন ছদ্মবেশী বিশ্বকর্মা অনেকের মতো তিনি বিষ্ণু স্বয়ং তিনি রাজাকে জানান একুশ দিন মন্দিরের দরজা-জানালা বন্ধ করে তিনি মূর্তি তৈরি করবেন একুশ দিন পর তিনি নিজে বের হয়ে আসবেন তার আগে কারুরই মন্দিরে প্রবেশ করা চলবে না তাহলে তিনি আর কাজ করবেন না রাজা তার শর্ত মেনে নেন কিন্তু দু-সপ্তহ কাটার পর মন্দিরের ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে রাজা-রানী উভয়েই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন অবসেষে রানীর পরামর্শে রাজা মন্দিরের দরজা খোলেন ঢুকে দেখেন বৃদ্ধ কারিগর সেখানে নেই মূর্তিগুলো তখনও অসমাপ্ত তাদের হাত-পা তৈরি হয়নি রাজা খুব হতাশ হয়ে পড়েন নিজেকে অপরাধী মনে হয় তার তিনি নিজেকে শেষ করে দিতে চান তখন জগন্নাথ তাকে স্বপ্নে বলেন, রাজার কোনো অপরাধ নেই যা হয়েছে সব তার ইচ্ছানুযায়ী হয়েছে কলি যুগে তিনি এইরূপে পূজিত হতে চান তিনি রাজাকে নির্দেশ দেন তাগের এই রূপে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করতে খুম সংক্ষেপে এই হল প্রভু জগন্নাথের আবির্ভাবের পৌরাণিক ব্যাখ্যা এখানে একটি কথা বলার পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের জগন্নাথদেবের পাশাপাশি আছে বলরাম, সুভদ্রা ও সুদর্শমচক্র বর্ণভেদ প্রথায় আমাদের সমাজে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র নামে চারটি সমাজ ছিল এই চারমূর্তি সেই বর্ণাশ্রমের প্রতীক বলরাম ব্রাহ্মণ, সুদর্শণচক্র ক্ষত্রিয়, সুভদ্রা বৈশ্য আর স্বয়ং জগন্নাথ শূদ্রদের প্রতীক

    পুরাণ থেকে এবার ফিরে আসা যাক বাস্তবের কথায় পূর্বেই বলেছি পুরীর রথযাত্রা ভারতবর্ষের সবচেয়ে বড়ো ও প্রাচীন রথযাত্রা আষাঢ় মাসের শুক্ল পক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে এই উৎসব হয় এই দিন জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রা রথে করে দুই কিমি দূরত্বে অবস্থিত গুণ্ডিচাবাটিতে যান পুরীর রথযাত্রার বৈশিষ্ট্য হল জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা তিনটি আলাদা রথে পাড়ি দেন জগন্নাথের রথের নাম নন্দীঘোষ বা চক্রধ্বজ এর পতাকায় কপিরাজার মূর্তি আঁকা থাকার কারণে একে কপিধ্বজও বলা হয় এর সারথি মাতলি এটির উচ্চতা ৪৫ ফুট এই রথটির রং হলুদ এবং এটিত সাত ফুট ব্যাসের ১৬ টি চাকা থাকে বলভদ্রের রথের নাম তালধ্বজ এর সারথি সুদ্যম্ন এই রথটির রং নীল এর উচ্চতা ৪৪ ফুট এবং এতে ১৪ টি চাকা থাকে সুভদ্রার রথের নাম পদ্মধ্বজ বা দর্পদলন এটির সারথি অর্জুন এর উচ্চতা ৪৩ ফুট এবং ের রং লাল এই রথে ১২টি চাকা থাকে এই রথের পতাকায় পদ্মফুলের ছবি থাকে উল্লেখ্য, প্রত্যেকবার এই তিনটি রথ নতুন করে তৈরি করা হয় এবং রথযাত্রা শেষে এগুলিকে ভেঙে ফেলা হয় বৈশাখ মাসের অক্ষয় তৃতীয়া থেকে এই রথ তৈরির কাজ শুরু হয় তিনটি রথ তৈরি করতে ৬০০–এরও বেশি গাছ প্রয়োজন হয়

    রথযাত্রা শুরুর প্রায় দু-সপ্তাহ আহে হয় স্নান যাত্রা জৈষ্ঠ্য পূর্ণিমার দিন হয় স্নানযাত্রা উসব এই দিন মন্দির থেকে বিগ্রহগুলি বের করে এনে বিশেষ বেদীর ওপর রাখা হয় তারপর তাদের ওপর ১০৮ কলসী জল ঢালা হয় এর ফলে তাদের ঠাণ্ডা লেগে যায় তখন তাদের একটি নির্দিষ্ট জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয় বিশেষ চিকিৎসার জন্য প্রত্যের আরো থেকে আঠারো বছর অন্তর পুরোনো মূর্তিগুলো বাদ দিয়ে অবিকল নতুন মূর্তি তৈরি করা হয় পুরোনো মূর্তিগুলো মন্দিরের মধ্যে মাটিতে পুঁতে দেওয়া হয় বিশেষ কিছু বৈশিষ্টযুক্ত নিমগাছ থেকে এই মূর্তি তৈরি করা হয় এ-অনুষ্ঠানটিকে বলা হয় নব কলেবর

    রথযাত্রার দিন লক্শ লক্শ মানুষ পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের সামনে উপস্থিত হন সেখানে তিন রথ সারিবদ্ধভাবে থাকে পুরীর রাজা অনুষ্ঠান সহকারে তিন মূর্তিকে তাদের নির্দিষ্ট রথে নিয়ে আসেন প্রথা অনুযায়ী পুরীর রাজবংশের উত্তরাধিকারীরা সোনার ঝাঁটা দিয়ে পাটাতন পরিস্কার করে জল ছিটিয়ে দেন এরপর উপস্থিত মানুষজন রথের দড়ি টানতে টানতে গুণ্ডিচাবাটির দিকে এগিয়ে চলেন

    এই প্রসঙ্গে একটি সুন্দর কাহিনি রয়েছে একসময় পুরীর রাজা পুরুষোত্তমদেব কাঞ্চীর রাজার মেয়ে পদ্মাবতীকে বিয়ে করতে চান কিন্তু কাঞ্চির রাজা সম্মত হন ক্রুদ্ধ পুরুষোত্তমদেব তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন কিন্তু যুদ্ধে তিনি হেরে যান পুরুষোত্তমদেব জগন্নাথের মন্দিরে আসেন এবং তার আনুকূল্য প্রার্থনা করেন এরপর তিনি পুনরায় কাঞ্চির রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন কথিত আছে যুদ্ধে স্বয়ং জগন্নাথ ও বলরাম তার হয়ে লড়াই করেছিলেন দ্বিতীয়বার যুদ্ধে তিনি জয়ী হন কিন্তু পুরুষোত্তমদেব রাজা কর্তৃক পদ্মাবতীকে বিয়ে করার প্রত্যাক্ষাণে এতটাই ক্রুদ্ধ ছিলেন যে তিনি পদ্মাবতীকে নিজের রাজ্যে নিয়ে আসেন কিন্তু বিয়ে করেন না তিনি ঘোষণা করেন কোনো চণ্ডালের সঙ্গে রাজকন্যা পদ্মাবতীর বিয়ে দেবেন ইতিমধ্যে রথযাত্রা উৎসব এসে যায় রথের দিন প্রথা অনুযায়ী রাজা পুরুষোত্তমদেব ঝাড়ু নিয়ে রথের সামনের রাস্তা ঝাঁট দেন বুদ্ধিমান পুরোহিত সেই মুহুর্তে ঘোষণা করেন রাজা যেহেতু চণ্ডালের কাজ করেছেন তাই তিনি নিজেও এখন চণ্ডাল এবং তিনি পদ্মাবতীকে বিয়ে করতে পারেন এরপর পদ্মাবতীর সঙ্গে পুরুষোত্তমদেবের বিয়ে হয়

    রথের দড়ি টানা, এবং রথের দড়ি ছোঁওয়াকেও অনেকে পুন্য কাজ বলে মনে করেন শাস্ত্রে আছে, রথস্থ বাম নং দৃষ্টা পুনর্জন্ম ন বিদ্যতে অর্থাৎ রথের ওপরের বামন জগন্নাথকে দর্শন করলে মানুষকে আর পুনর্জন্মের কষ্ট ভোগ করতে হয় না এখানে প্রথমে যায় বলরামের রথ, তারপর সুভদ্রার এবং সবার শেষে জগন্নাথের গুণ্ডিচাবাটিতে সাতদিন কাটানোর পর নবম দন পুনরায় রথে করে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রাকে ফিরিয়ে আনা হয় ফিরে আসার উৎসব উল্টোরাথ নামে খ্যাত

    পুরীর রথযাত্রা প্রসঙ্গে একটি কথা বলার এখন পুরীতে তিনটি রথ টানা হলেও প্রায় সাত-আট শতাব্দী আগে এখানে ছটি রথ টানা হত সেই সময় পুরীর জগন্নাথ মন্দির আর গুণ্ডিচা মন্দিরের মধ্যে বলাগুণ্ডি নামে একটি নালা ছিল জগন্নাথ মন্দির থেকে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রাকে তিনটি আলাদা রথে চাপিয়ে প্রথমে এই নালার পাড় পর্যন্ত আনা হত এর বিপরীত দিকে অনুরূপ তিনটি রথ থাকত নালা পার করানোর পর সেই রথগুলিতে করে তিন মূর্তিকে গুণ্ডিচা মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হত ফেরাও হত ঠিক সেইভাবেই ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ দিকে পুরীর রাজা ছিলেন কেশরী নরসিংহ তিনি এই নালা বুজিয়ে দেন তখন থেকে তিনটি রথ চালনা শুরু হয়

    পুরীর রথযাত্রা ছাড়া ভারতবর্ষের নানা জায়গায় রথযাত্রা উৎসব পালিত হয় এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল মহিষাদলের রথযাত্রা প্রাচীনত্ব ও ঐতিহ্যের বিচারে মহিষাদেলর রথযাত্রা বিশেষ মর্যাদার দাবি রাখে মহিষাদলের রথ কে তৈরি করেছিলেন তা নিয়ে মতভেদ আছে কেউ কেউ মনে করেন ধর্মপ্রাণা রানি জানকীদেবী ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে ১৭ চূড়া বিশিষ্ট রথটি নির্মাণ করেন আবার কারও মতে ১৮০৪ খ্রিস্টাব্দে মতিলাল পাঁড়ে এই রথটি তৈরি করেন তবে বিভিন্ন তথ্য প্রমাণ বিশ্লেষণ করে দেখা যায় রাজনী জাননী নন, মতিলাল পাঁড়ে এই রথ নির্মাণ করেন

    শুরুতে রথের ছিল ১৭ টি চূড়া এবং ৩৪ টি চাকা রথটির উচ্চতা ৭৫ ফুট রথের ভেতরে কাঠের সিঁড়ি আছে ওপরে ওঠার এবং এর চারিদিকে রয়েছে ঘুর বারান্দা রথটিতে নানা কারুকার্যখচিত রয়েছে বিভিন্ন সময়ে রথটি বেশ কয়েকবার পুড়ে যায় শেষবার পুড়ে যাওয়ার পর রাজা লছমনপ্রসাদ গর্গ তাঁর ফ্রান্সের বন্ধু মতিনো পেরুর পরামর্শে ১৭ চূড়ার পরিবর্তে ১৩ চূড়া করেন বর্তমানে সেই ১৩ চূড়াবিশিষ্ট রথটি রয়েছে ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে রাজা সতীপ্রসাদ গর্গ রথের সামনে দুটো প্রকাণ্ড সাদা ঘোড়া যুক্ত করেন

    পুরীর মতো মহিষাদলেও আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে এই রথযাত্রা উৎসব হয় রথের আগের দিন রথের সামনে বিশেষ মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান হয় যা ‘লেদ উৎসব’ বা ‘নেত্র উৎসব’ নামে খ্যাত পরের দিন নির্দিষ্ট সময়ে রাজ পরিবারের কোনো সদস্য পাল্কি চড়ে রথের সামনে আসেন তিনি রথের দড়ি ছুঁয়ে প্রণাম করে রথযাত্রার আনুষ্ঠানিক সূচনা করেন এরপর রথের সঞ্চালক বা সারথি রথটানার নির্দেশ দেন উপস্থিত হাজার হাজার মানুষ এরপর রথকে টেনে প্রায় এক কিলোমিটার দূরের গুণ্ডিচা মন্দিরে নিয়ে যান নবম দিন পুনরায় একইভাবে রথকে টেনে তাঁর আগের জায়গায় নিয়ে আসা হয় মহিষাদলের রথে জগন্নাথদেবের পাশাপাশি মদনগোপালজিউর মূর্তি থাকে এই রথ উপলক্ষে এখানে পনেরোদিনেরও বেশি মেলা হয়

    উল্টোরেথর কয়েকদিন পর পূর্ণিমার দিন রাজার গড়ে একট ছোট্ট পেতলের রথ টানা হত এটি পূর্ণিমার রথ বা রানির রথ নামে খ্যাত এইদিন সমস্ত জনসাধারণের রাজার গড়ে অবাধ প্রবেশাধিকার ছিল কিন্তু বর্তমানে সেই রথটি বন্ধ হয়ে গেছে তার জায়গায় ভারত সেবাশ্রম সংঘ ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দ থেকে একটি পাঁচচূড়া বিশিষ্ট রথা চলনা করে আসছে এই রথটানাকে কেন্দ্র করেও মানুষের মধ্যে প্রচুর উৎসাহ ও উদ্দীপনা দেখা যায়

    সময়ের ্গ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে রথযাত্রা উৎসবের ব্যপ্তি ও দৃষ্টিভঙ্গীতে বদল এসেছে আমাদের রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় ছোটোবড়ো বহু রথযাত্রা হয়ে থাকে পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা বাদে ভারতবর্ষের বহু রাজ্যে যেমন এই উৎসব হয় তেমনি ভারতবর্ষের বাইরে নানা জায়গা যেমন জাপান, লন্ডন, মেক্সিকো, ফিলাডেলফিয়া, বাংলাদেশ প্রভৃতি জায়গায় রথযাত্রা উৎসব চালু হয়েছে একসময় এটি কেবল হিন্দুদের উৎসব থাকলেও বর্তমানে রথের উৎসবে ভিন্ন ধর্মের মানুষেদরও সমাগম ঘটে এককথায় এটি একটি গণ উৎসবে পরিণত হয়েছে মেলা মানে মিলন উৎসব রথযাত্রা উপলক্ষে যে মেলা অনুষ্ঠিত হয় তা আসলে মানুষে-মানুষে মেলবন্ধন ঘটানোর প্রয়াস এটাই হল ভারতীয় উৎসবের ঐতিহ্য যে ঐতিহ্যের ছবি পরিলক্ষিত হয় রথযাত্রা উৎসবে

No comments:

Post a Comment