Tuesday, September 22, 2020

বনবাড়ি উপাখ্যান - মিতা চ্যাটার্জী

বনবাড়ি উপাখ্যান

মিতা চ্যাটার্জী

 

ফ্লাস্কের ভিতর মুসুর ডালের স্যুপটা ভরে নিল মিঠি। সাথে নিল কিছু ফল আর টাকা, যদি ওষুধপত্র কিছু লাগে অথবা কোন টেষ্ট যদি ডাক্তারবাবু লিখে দিয়ে থাকেন তখন তো টাকা লাগবেই। মিঠিকে এই রান্নাগুলো শিখিয়েছে তপুপিসি। এই যেমন চা, কফি, স্যুপ, অমলেট এইসব আর কী সেদিন মিঠির ঠাম্মি তার এই নতুন নতুন রান্না শেখার কথাগুলো শুনেই মুখ টিপে হেসে বলেছিল, চা,কফি এগুলো বুঝি রান্না!

আহা! জেঠিমা শেখার চেষ্টাটা তো আছে, এখনকার দিনে কটা মেয়ে এত কিছু শেখে বলো তো? সারাক্ষণ বস্তা কাঁধে নিয়ে এই কোচিং সেই কোচিং করে বেড়ানো আর বাড়িতে ঢুকেই কানে কী সব গুঁজে ফোন নিয়ে ব্যস্ত। মিঠি কিন্তু একদম অন্যরকম। পড়াশুনা বাদেও সবার সঙ্গে কথা বলে। তোমার কাছে বসে বসে গল্প করে।

সে সবই তো বুঝলাম, তবে ওর বাবা, মা জানতে পারলে তোর চাকরিটা কিন্তু যাবে তপু। তারা তাদের একমাত্র সন্তানকে উচ্চশিক্ষিত করে বিদেশে পাঠাবে। আর তুই তাকে রান্নাঘরের কাজ শেখাচ্ছিস?

ওসব চাকরী চলে যাওয়ার ভয় আমাকে দেখিও না জেঠিমা। বিদেশ যাবে সে তো খুব ভালো কথা, তবে নিজের থাকা খাওয়ার জন্যও কিছু কাজ তো শিখতে হবে। সেখানেও কি চারপাশে পাঁচটা কাজের লোক ঘুরবে? শুনেছি ওসব দেশে নাকি কাজের লোকই পাওয়া যায় না।   

তপুপিসি আমাদের বাড়িতে রান্না করে। আমার জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই দেখছি তপুপিসিকে। আর এ বাড়ির সর্বময়ী কত্রী আমার ঠাম্মি শ্রীমতি রুদ্রাণী সেন। সারাক্ষণ বই পড়েন আগে স্কুলে পড়াতেন। আমাদের এই বিশাল বাড়িটার নাম বনবাড়ি আসলে এই বাড়িটা আমার ঠাম্মির বাবার বাড়ি। ঠাম্মির আর কোন ভাই-বোন ছিলো না। তবে এবাড়ির নাম বনবাড়ি কেন? কে জানে  অনেক গাছপালা আছে বলেই হয়তো।  

ঠাম্মিকে জিজ্ঞেস করলেই হেসে জবাব দেন, কেউ হয়তো ভালোবেসে রেখেছিলো। 

আমার বাবা মা দুজনেই সেক্টর ফাইভে-এ চাকরী করেন। দুজনেই বাড়িতে কথা কম বলেন আর কথা বললে সে শুধু আমাকে নিয়ে, আমার নাকি পড়াশুনায় একদম মন নেই। এবারে উচ্চমাধ্যমিকে আমি এইটি নাইন পারসেণ্ট মার্কস পেয়েছি। তাতে বাবা, মা দুজনেই খুব একটা খুশী নন। ওনারা চান আমি কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়ি আর আমি চাই হিস্ট্রি নিয়ে পড়তে। সায়েন্সের সবকটা সাব্জেক্টে লেটার পেয়েছি, কিন্ত হিস্ট্রি আমার ফেভারিট। বাবা মা দুজনেই বলেন, আমি খুব জেদি অনেকটা ঠাম্মির মতো। এসব কথা শুনলে আমি আর ঠাম্মি দুজনেই খুব হাসি। আসলে কী জানো, হাসতে পারলে অনেক কষ্টকে জয় করা যায়।

তবে কলেজে কবে যে ভর্তি হতে পারবো কে জানে এই দেখো, বড্ড দেরি করে ফেললাম, শান্তনু দাদুর কাছে পৌঁছতে বড্ড দেরি হয়ে যাচ্ছে। যাই একটু সাজুগুজু করে নিই।

সাজুগুজু কথাটা ভেবেই মিঠি ফিক করে হেসে ফেলল মুখে মাস্ক পরো, মাথায় টুপি, হাতে গ্লাভস যে যেমন পারছে আর কী! আগে ছিলো লিপস্টিক, লিপগ্লস, রুজ, আইলাইনার, আইস্যাডো ইত্যাদি ইত্যাদি। আর এখন করোনার কল্যাণে সব প্রসাধন মাথায় উঠেছে। তবে মিঠি কোনদিনই সাজগোজ নিয়ে মাথা ঘামায় না। এখন শুধু মাস্কের রমরমা। মাস্ক তো এখন শুধু বিশ্ব মহামারীর প্রকোপ থেকে সাবধান হওয়ার অস্ত্র নয়, এখন এটা স্টাইল স্টেটমেন্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে অনেকে আবার অনলাইনে ডিজাইনার মাস্ক আনাচ্ছে, আর তারপরেই ফেবুতে পোষ্ট। পারেও বটে!

যাকগে, এখন তাকে বেরোতে হবে। মিঠি জানে এসময়টা তার কাছে কেউ কৈফিয়ত তলব করবে না। বাবা-মা অফিসে,  ঠাম্মি নিজের ঘরে পড়াশুনায় ব্যস্ত। তবুও বেরোনোর আগে একবার ঠাম্মির ঘরে উঁকি দিল সে। দেখতে পেলো ঠাম্মি পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছে। যাক ফিরে এসে সব কথা বলবে ঠাম্মিকে। আপাতত তপুপিসিকে একবার ঘুম থেকে ডেকে তুলতে হবে, বাইরের গেট বন্ধ করার জন্য।

মিনিট দশ পনেরো হেঁটেই মিঠি পৌঁছে গেল পাঁচ ইঞ্চির গাঁথনি দেওয়া টালি চাপানো আট বাই দশ ঘরটির সামনে। যদি এটিকে বাড়ি বলা যায় তবে এই ঘরখানি নীহারপিসির বাড়ি। চাঁদ ও সূর্যের মতো নীহারপিসি সবার পিসি। পাড়াশুদ্ধ, এরিয়াশুদ্ধ সবাই নীহারকে পিসি বলেই ডাকে। ছয় থেকে ষাট সকলেরই পিসি সে। আপাতত এই ঘরেই আশ্রয় নিয়েছে সুস্নাতর দাদু শান্তনু। কেন সেকথা পরে জানলেও চলবে। আপাতত কাঁধের ভারি ব্যাগটা নীহার পিসির হাতে দিতে পারলেই হবে।

ঘরে ঢুকতে গিয়েও মিঠি একটু থমকে দাঁড়ালো। পরম মমতায় নীহারপিসি শান্তনু দাদুর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বাটি থেকে দুধ জাতীয় কিছু চামচ দিয়ে খাইয়ে দিচ্ছে।

-শান্তনুদা একবার বনবাড়িতে খবর দেবো? আমার এই ঘরে তুমি থাকলে আর অসুস্থ হয়ে পড়বে

শান্তনু দাদুর কুঁকড়ে যাওয়া শরীরটা যেন আর্তনাদ করে উঠল। প্রায় ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গীতে নীহারপিসি বলল, তুমি একটু শান্ত হও শান্তনুদা। তোমরা তো একসাথে পড়াশুনা করতে, তাই... আমি আর কোনদিন এসব কথা বলবো না তোমায়। তুমি যতদিন বাঁচবে এখানেই থাকো।

শুনে আর এক মুহূর্ত দাঁড়ায়নি মিঠি। ব্যাগটা দরজার সামনে রেখেই প্রায় দৌড়ে চলে এল সেখান থেকে।   

এই মিনিট দশেকের রাস্তাটা আসতে আসতে সে ভাবছিলো নীহারপিসি কেন তাদের বাড়ির নাম করলো? শান্তনুদাদু কেনই বা অমন করে বাধা দিলো। কাকে জিজ্ঞেস করবে সে? ঠাম্মিকে?  

বাড়িতে ঢুকেই মিঠি দেখল রুদ্রাণী উদ্বিগ্ন হয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন। মিঠির মনে হল তার উচিত ছিলো ঠাম্মিকে জানিয়ে যাওয়া। ঠাম্মিতো তার কোন কাজেই বাধা দেয় না। তাড়াতাড়ি রুদ্রাণীর ঘরে এসে তাঁর হাতটা ধরে বারান্দায় পাশাপাশি বসল মিঠি। কাঁচুমাচু মুখ করে বলল, ভারি অন্যায় করেছি তোমাকে কিছু না জানিয়ে বেরিয়েছি। পরশু রাতেই তোমাকে বলা উচিত ছিল আমার। সুস্নাতর দাদু প্রায় মাস ছয়েক হল টিবিতে ভুগছেন।

-সেকি! আমি তো কিছুই জানিনা।

-তুমি কী করে জানবে ঠাম্মি? তুমি তো তোমার বনবাড়ির তিনতলার ঘরে রাশি রাশি বইয়ের মাঝে নিজেকে বন্দী করে রেখেছ কতকাল, সে খবরই কি তুমি রেখেছ?

একদৃষ্টে তার সদ্য আঠারো ছোঁয়া নাতনির অপাপবিদ্ধ মুখের পানে তাকিয়ে কোনমতে বলল,তারপর?

-তার সাথে গত পঁচিশ দিন থেকে করোনা পজিটিভ। হাসপাতালে ছিলেন। গত দুদিন হল হাসপাতাল থাকে রিলিজ করে দিয়েছে, অবশ্যই রিপোর্ট নেগেটিভ আসার পরেই। গত পরশু সন্ধ্যার সময় যখন মুলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল, তোমার কোলে মাথা রেখে আমি যখন তোমার কাছে গল্প শুনছিলাম,  সেসময় একজন সত্তর বছরের বৃদ্ধকে থানার পুলিশ তারই নিজের বাড়িতে পৌঁছে দিতে আসেন।  যাতে বাড়ি বা পাড়ার লোকজনদের দ্বারা তাঁকে নিগৃহীত হতে না হয়। পুলিশের সামনেই সুস্নাতর মা, জেঠিমা, আর জেঠু, শান্তনুদাদুকে বাড়িতে ঢুকতে দিতে অস্বীকার করেন। তাঁকে গালিগালাজ করেন। মানিক কাকু মানে সুস্নাতর বাবা বাধা দিতে গেলে তাঁকেও গালিগালাজ করে ওরা। শারীরিক কষ্টের চেয়েও অপমান, ভয় ও লজ্জায় শান্তনুদাদু বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে কাঁপতে থাকেন। তখন সুস্নাত দাদুর হাত ধরে জোড় করে বাড়িতে আনতে গেলে সুস্নাতকে ওর মা মারধোর করে। সুস্নাতও জানিয়ে দেয় ওর মাকে, “তুমি আমায় মারতে মারতে মেরে ফেললেও আমি দাদুর হাত ছাড়বো না, যদি এ বাড়িতে দাদুর থাকার জায়গা নাহয় তাহলে এবাড়িতে আমিও থাকবো না।বৃষ্টি ঝড়  উপেক্ষা করে সুস্নাত যখন দাদুকে নিয়ে বেড়িয়ে আসে, তখন ওই বৃষ্টির মধ্যেও পাড়ার লোকজন ভিড় করে দাঁড়ায়, অবশ্যই শুধু দর্শক হয়ে, কেউ সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেনি। একমাত্র নীহারপিসি ছাড়া, যার নিজের উপার্জন বলতে একটি ছোট চায়ের গুমটি। পুলিশের সাহায্যে সুস্নাত ওর দাদুকে নীহার পিসির ঘরে নিয়ে যায়। শান্তনুদাদু ওনার বাড়িটা পরম বিশ্বাসে অনেক দিন আগেই বৌমা আর ছেলেদের নামে লিখে দিয়েছিলেন। পরশু রাতেই সুস্নাত ফোন করে আমাকে সব জানায়। সুস্নাত পাগলের মতো একটা ঘর খুঁজে বেড়াচ্ছে। আমিও আমার সব বন্ধুদের বলেছি। মানিক কাকুর আর্থিক অবস্থা খুব ভালো নয়, সুস্নাত ওর পড়াশুনার জন্য বাড়ি থেকে কোন পয়সা নেয় না, টিউশন পড়িয়ে নিজের খরচ চালায়। একলা সুস্নাত কী করবে বুঝতে পারছি না। নীহারপিসির ঘরে শোনা কথাগুলো মিঠির মাথায় পাক খেতে লাগল। হঠা করেই সে জিজ্ঞেস করল, “ঠাম্মি তুমি কি সুস্নাতর দাদুকে চেনো?” মিঠির মাথায় হাত বুলিয়ে  দিয়ে উঠে দাঁড়ালো রুদ্রাণী,সুস্নাত বুঝি তোর খুব ভালো বন্ধু? এক কাজ করতো দিদিভাই, তপুকে নিয়ে নিচের দুটো ঘর খালি করে রাখ।

পরশু রাতের মতোই বৃষ্টি শুরু হয়েছে আবার। বারান্দা থেকে মিঠি দেখতে পাচ্ছে ঠাম্মির গাড়িটা আস্তে আস্তে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। এই বয়সেও ঠাম্মি কি সুন্দর ড্রাইভ করেন! মহামারী শুধু হারাতে শেখায় না, মাঝেমাঝে মিলিয়েও দেয় আঁকাবাঁকা রাস্তাগুলোকে এক সরলরেখায়। ঝাপসা বৃষ্টির  মাঝেও ভিজে গুলঞ্চগুলো বেশ দেখতে পাচ্ছে মিঠি। অনন্তের পথে জেগে আছে ওরা। এই গাছটার পানে তাকিয়েই সেদিন ঠাম্মি জবাব দিয়েছিলো, কেউ হয়তো ভালোবেসেই এ বাড়ির নাম রেখেছিলো বনবাড়ি।’ 


 

 

2 comments:

  1. অসাধারণ গল্প৷ লেখিকাকে অভিনন্দন

    ReplyDelete