Saturday, May 14, 2022

পালকি

 পালকি

সৌরভকুমার ভূঞ্যা

 

সবুজ শ্যামল গ্রামের ধুলিমাখা সরু পথ ধরে পালকিতে করে এগিয়ে চলেছে নব-দম্পতি। ছজন বলিষ্ঠ লোক কাঁধে করে বয়ে নিয়ে চলেছে সেই পালকি। পায়ের ছন্দবদ্ধ গতির সঙ্গে সঙ্গে মুখে তাদের ছন্দময় সুর—হুনহুনা রে হুনহুনা, হুনহুনা হুনহুনা। কৌতূহলী নববধু মাঝে মাঝে পালকির পর্দা আলতো ফাঁক করে লাজুক চোখে তাকাচ্ছে আশেপাশে। রাস্তায় এদিক-ওদিক বউ ছেলেমেয়ের জটলা। অদ্ভুত কৌতূহলভরা চোখে তারা তাকিয়ে আছে পালকির দিকে। এমন সুন্দর দৃশ্য আজকাল আর দেখা যায় না। এখন পালকির ব্যবহার নেই বললেই চলে। সময়ের সাথে সাথে আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থার অভূতপূর্ব পরিবর্তন ঘটে গেছে। কিন্তু একটা সময় যাতায়াত ব্যবস্থার অন্যতম মাধ্যম ছিল পালকি। বর্তমানে পালকি আমাদের জীবনে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে।

    শুধুমাত্র আমাদের দেশ নয়। একটা সময় পালকি পৃথিবীর বহু দেশে ব্যবহৃত হত। দেশ ও জায়গাভেদে পালকির নামকরণ ভিন্ন ছিল কিন্তু মূল জিনিসটি এক। আমাদের দেশে এটি পালকি নাম পরিচিত। পালকি শব্দটি এসেছে সংস্কৃত পল্যঙ্ক বা পর্যঙ্ক থেকে যার অর্থ বিছানা বা খাট। পালকি দেখতে সাধারণ চৌকো কিংবা আয়তাকার বাক্সের মতো। বলা যেতে পারে কাঠ দিয়ে তৈরি একটি ছোটো ঘর। যার মধ্যে একজন কিংবা দুজন লোক বসতে পারে। বাক্সটির দুদিকে দুটি মোটা দণ্ড বের করা থাকে। বেহারারা এই দণ্ড কাঁধে পালকি বয়ে নিয়ে চলেন

    গঠনগত বৈশিষ্ট্য এক হলেও পালকি বিভিন্ন আকৃতির হয়। একেবারে ছোটো আকৃতির যে পালকি তাকে ডুলি বলা হয়। ডুলিতে একজনমাত্র লোক বসতে পারে। দুজন বেহারা এটি বয়ে নিয়ে যায়। এটিতে যাতায়াত করতে অনেক কম খরচ হত এরপর রয়েছে আয়না পালকি। এটির আকার ডুলির থেকে বড়ো। এই পালকিতে আয়না লাগানো থাকে। পালকির মধ্যে দুজন বসার মতো দুটি চেয়ার ও মাঝখানে একটি ছোটো টেবিল থাকে। সবথেকে বড়ো এবং আকর্ষণীয় পালকি হল ময়ূরপঙ্ক্ষী পালকি। আয়তাকার এই পালকিটি দেখতে অনেকটা ময়ূরের মতো। এর মধ্যে দুটি চেয়ার, একটি টেবিল ছাড়া একটি তাক থাকে।

    পালকি সাধারণত সেগুন, শিমূল কাঠ দিয়ে তৈরি হত। এর দুই দিকে যে দণ্ড তাকে বলা হয় বাঁট। সাধারণত বটগাছের মোটা ঝুরি দিয়ে এই বাঁট তৈরি হয়। পালকির তলা তৈরি হত বেত দিয়ে তার ওপর গদি থাকত পিঠের দিকে দুই পাশে তাকিয়া থাকত অনেক পালকির গায়ে আবার সুন্দর সুন্দর নক্সা করা থাকত। বিশেষ করে রাজা-রাজরা, জমিদার কিংবা অভিজাত মানুষেরা যে পালকি ব্যবহার করতেন তাদের গায়ে বিভিন্ন নকশা ও কারুকার্য করা থাকত। বহু মানুষ পালকির নক্সা, কারুকার্য করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করত।

    পালকির প্রচলন সঠিক কোন সময় থেকে একথা নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। তবে পালকির ব্যবহার যে খুব প্রাচীন সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আমাদের রামায়নে পালকির ব্যবহারের কথা আছে। সেসময় পালকিকে শিবিকা বলা হত।

    একেবারে প্রথম দিকে পালকি ব্যবহার করা হত ঠাকুর দেবতাকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। এখনও কোথাও কোথাও এমন দৃষ্টান্ত দেখা যায়। যাই হোক, ক্রমে ক্রমে পালকি মানুষের যাতায়াতের মাধ্যম হয়ে ওঠে। তবে একেবারে সাধারণ মানুষের পক্ষে পালকি করে যাতায়াত করার সামর্থ্য ছিল না। কেননা পালিকতে যাতায়াত করা ছিল বেশ ব্যায়বহুল। একসময় আমাদের দেশে রাস্তাঘাটা, যানবাহন ব্যবস্থা উন্নত ছিল না। দূর দূরান্ত মানুষ পায়ে হেঁটে যাতায়াত করত। তবে গরুর গাড়ির ব্যবহার ছিল। পালকি কেবল অর্থবান লোকেরা ব্যবহার করতে পারত। সেই সময় পালকি করে যাতায়াত যেমন একটা আভিজাত্যের ব্যাপার ছিল, ঠিক তেমনি বাড়িতে নিজস্ব পালকি থাকাওঅভিজাত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে পালকি উপহার দেওয়ার একটা প্রচলন ছিল। রাজা, জমিদারদের বাড়িতে একাধিক পালকি থাকত। সেইসব পালকি ছিল বেশ দামি ও অনেক কারুকার্যখচিত। রাজা মাহারাজারা ঝালর দেওয়া পালকি ব্যবহার করতেন সবাই এই পালকি ব্যবহার করার অনুমতি পেতেন না কেননা ঝালর দেওয়া পালকি ব্যবহার করা একটা সম্মানের ব্যাপার ছিল

    ব্যক্তিগত পালকি ছাড়া ছিল ঠিকা পালকি। আজকালকার রিক্সা, টোটো, অটো প্রভৃতি স্ট্যান্ডের ন্যায় তখন পালকিরও স্ট্যান্ড থাকততবে সেটাও মূলত শহরাঞ্চলের দিকে। বেহারারা তাদের পালকি নিয়ে স্ট্যান্ডে অপেক্ষা করত। লোকেরা স্ট্যান্ডে এসে পালকি ভাড়া করতে পারত।

    পূর্বেই বলেছি পালকি যারা বহন করে তাদের বেহারা বলা হয়। সাধারণত চারজন কিংবা ছজন বেহারা পালকি বহন করত। দূরযাত্রার ক্ষেত্রে তাদের সঙ্গে মালবহনকারী লোক এবং রাত্রে মশাল দেখিয়ে আলো দেখানোর লোক থাকত। বেহারা এক অদ্ভুত ছন্দে পথ হাঁটে। সেটা না হাঁটা, না দৌড়। তার মধ্যবর্তী এক দুলকি চালে তারা পালকি বয়ে নিয়ে যেত। কবির সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের পালকির গান কবিতায় বেহারাদের পালকি নিয়ে যাওয়ার সুন্দর ছবি ছুটে উঠেছে....পাল্কী চলে,/পাল্কী চলে-/দুল্ কি চালে/নৃত্য তালে !/ছয় বেহারা,-/জোয়ান তারা,-/গ্রাম ছাড়িয়ে/আগ্ বাড়িয়ে/নাম্ ল মাঠে/তামার টাটে !/তপ্ত তামা,-/যায় না থামা,-/উঠ্ ছে আলে/নাম্ ছে গাড়ায়,-/পাল্কী দোলে/ঢেউয়ের নাড়ায় !/ঢেউয়ের দোলে/অঙ্গ দোলে !

    পালকি বহন করা বেশ কষ্টসাধ্য কাজতাই ক্লান্তি দূর করতে পালকি বয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় তারা হুনহুনা সুর ভাঁজত, গান করত কিংবা নিজেদের মতো ছন্দবদ্ধ বুলি আওড়াত। তাদের সেই বুলির মধ্য দিয়ে গ্রাম বাংলার আশপাশের চিত্র ফুটে উঠত। অনেক সময় দেখা যেত তারা গুপ্ত ভাষায় কথা বলছে। একদল বলত অন্য দল জবাব দিত। এই গুপ্ত ভাষার মাধ্যমে একদিকে যেমন রাস্তাঘাটের নির্দেশ, চলার নির্দেশ থাকত তেমনি করে নিজেদের মধ্যে ঠাট্টা তামাশাও করত তারা।

    তিলোত্তমা কলকাতা এখন কল্লোলিনী। গতিশীল তার জীবন। অসংখ্য ঝাঁ চকচকে রাস্তা। কত রকমের যানবাহন সারাদিন তার বুকে ছুটে বেড়াচ্ছে। শুধু কি তাই. মাথার উপর দিয়ে তৈরি হয়েছে রাস্তা। যাকে বলে ফ্লাইওভার বা উড়ালপুল। কোথাও তৈরি হয়েছে স্কাইওয়াক। আবার মাটির নীচ দিয়ে ছুটছে মেট্রোরেল। রাজধানী কলকাতার অন্যতম বৈশিষ্ট্. হল তার গতি। অথচ একটা সময় এই কলকাতা ছিল ধীর। তখন কলকাতার চেহারা আজকের মতো ছিল না। সেই সময় কলকাতার যানবাহনের অনযতম ছিল পালকি, গরুর গাড়ি প্রভৃতি। ঘোড়ার গাড়ি তখনও প্রচলন হয়নি। অফিস, যাতায়াতে, সরকারি কাজ পরিদর্শন কিংবা দূর যাতায়াতে মানুষ পালকি ব্যবহার করত।

    কলকাতায় পালকির প্রচলন হয় অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে থেকেই প্রথম দিকে দুলে বাগদিরা বেহারার কাজ করত। এরা ছিলেন নিম্নবর্গের মানুষ। সেই সময়কার হিসেবে অচ্ছুৎ সম্প্রদায়। তাই ছোঁয়াছুয়ি নিয়ে নানান সমস্যা হত। তাই নিয়ে নানান সমস্যাও হতে থাকে। সেই সমস্যা দূর করতে মহারাজা নবকৃষ্ণ উড়িস্যা থেকে গোপ জাতীয় ব্রাহ্মণদের বেহারা কররে আনেন এরা অচ্ছুৎ নয়। ধীরে ধীরে এদের কদর বাড়তে থাকে। ফলে উড়িস্যা থেকে এই সম্প্রদায়ের মানুষেরা কলকাতায় এসে ভিড় জমান। দেখতে দেখতে কলকাতায় ছেয়ে যায় এই গোপজাতীয় বেহারায়। উড়িয়া বেহারাদের যে নেতা তাদের বলা হত পরামানিক। পরবর্তী সময়ে হিন্দুস্থানী বেহারা কলকাতায় পালকি বইতে শুরু করে মূলত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাহেব মানুষেরা এই বেহারাদের রাখতেন ১৮৯১ সালের হিসাব অনুযায়ী শুধু কলকাতার পালকির সংখ্যা ছিল ৬০৬ এবং বেহারার সংখ্যা ছিল ১৬১৪

    যাই হোক, পালকি করে যাতায়াত বেশ ব্যায়হুল। মূলত দূরত্বের বিচারে পালকির ভাড়া নির্ধারিত হত। তাই দূরযাত্রার ক্ষেত্রে যেমন খরচ বেশি পড়ত তেমনি সময়ও লাগত বেশ। কেননা একটানা পালকি বয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। বেহারাদের বিশ্রামের প্রয়োজন ছিল। এই সমস্যা দূর করতে ক্যাপ্টেন জন হাবি ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে পালকির রিলে পরিষেবা চালু করেন কলকাতা থেকে বারাণশী পর্যন্ত। প্রতি দশ মাইল অন্তর বেহারাদের একটি করে দল থাকত। প্রতি দলে আট জন বেহারা থাকত। একজন মশালচি থাকত রাতে আলো দেখাবার জন্য এবং মাল বহন করার জন্য একজন থাকত। একটা দল যাত্রীকে দশ মাইল নিয়ে যাওয়ার পর অন্য দল সেই যাত্রীকে নিয়ে পাড়ি দিত পরের গন্তব্যের উদ্দেশ্যেআর আগের দল সেখানে অপেক্ষা করত। এর ফলে দূর যাতায়াতে সময় সাশ্রয় হত। ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দে ডাক বিভাগ এই রিলে পরিষেবার দায়িত্ব নেয়।

    এক সময় পালকির ভাড়া নিয়ে সমস্যা শুরু হয়। বেহারারা পালকির জন্য তখন চড়া দাম নিত। নিজেদের ইচ্ছেমতো দাম হাঁকাত। মানুষ বাধ্য হত তাদের দাবি মানতে। আসলে তখন বেহারাদের দাপট ছিল বেশ। তাই যাত্রীদের ওপর একপ্রকার জুলুম করে ভাড়া নিত তারা। ইতিমধ্যে ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানি কলকাতা শহরে যে সকল দাসদাসী কাজ করত তাদের জন্য নির্দিষ্ট মাস মাইনে স্থির করে দেয়। ১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানি বেহারাদের জন্যও নির্দিষ্ট ভাড়া বেঁধে দেন। এই ব্যবস্থায় বেহারারা মোটেও সন্তুষ্ট ছিল না। কিন্তু সেই সময় তারা একপ্রকার বাধ্য হয়ে কোম্পানির নিয়ম মেনে নেয়। কিন্তু মনের মধ্যে অসন্তোষ তুষের আগুনের মতো জ্বলতে থাকে।

    কয়েক বছর পর সেই আগুন যেন দাবানলের আকার ধারন করে। আসলে কোম্পানি নির্দিষ্ট ভাড়া বেঁধে দিলেও অনেকক্ষেত্রে দেখা যেত বেহারারা নিজেদের ইচ্ছেমতো ভাড়া নিত। তাদের দাপট এতখানি ছিল যে যাত্রীরা তা মেনে নিতে বাধ্য হত। এই নিয়ে মানুষের মনে অসন্তোষ সৃষ্টি হতে থাকে। তাই পালকি বেহারাদের নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য ১৮২৭ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কতগুলি নিয়ম চালু করে। বলা হয় প্রত্যেক পালকিতে নম্বর থাকতে হবে। প্রত্যেক বেহারাকে নম্বর দেওয়া ব্যাজ বা চাকতি লাগাতে হবে। আর এই ব্যাজ বা চাকতি তৈরির টাকা বেহারাদের নিজেদের বহন করতে হবে। আর সরকারের স্থির করে দেওয়া ভাড়া তাদের নিতে হবে।

    বেহারারা বুঝতে পারে কোম্পানির এই সিদ্ধান্তে তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পাশাপাশি তারা মনে করে হাতে চাকতি লাগালে তাদের জাত যাবে তাই তারা এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারে না। কিন্তু নিজেদের সিদ্ধান্তে অনড় থাকে। ফলে বেহারাদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়তে থাকে। তারা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। কোম্পানির আইনের বিরুদ্ধে তারা আন্দোলন করার সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের সেই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন পাঁচু সুর। তাদের আন্দোলনকে সমর্থন করে মাঝি মল্লারাও। কলকাতার গড়ের মাঠে এই নিয়ে বিশাল সভা হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন পাঁচু সুর। বেহারাদের পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন তাদের নেতা গঙ্গাহরি। মাঝি মল্লাদের পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন তাদের নেতা তিনকড়ি। সম্ভবত এটাই ভারতবর্ষের বুকে প্রথম কোনো সংগঠিত গন আন্দোলন। এই সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় কো্পানির এই নিয়ম কোনোমতেই বেহারারা মানবে না। সেখানে সভা শেষে তারা দল বেঁধে লালবাজার ও সুপ্রিমকোর্টের সামনেও ধর্না দেন। ম্যাজিস্ট্রেট ব্যাচের জন্য বেহারাদের টাকা দেওয়ার ব্যাপারটা মকুব করেন কিন্তু বাকি সব নির্দেশ যেমন ছিল তেমনি বহাল রাখেন। কিন্তু তাতে সন্তুষ্ট হয় না বেহারারা।

    পরের দিন দেখা যায় স্তব্ধ হয়ে গেছে কলকাতা। সমস্ত বেহারাও ধর্মঘট করেছেন রাস্তায় পালকি নেই। এমনকি যে সমস্ত বেহারারা মাস মাইনেতে নিযুক্ত তারাও এই ধর্মঘটে সামিল হয়। ফলে রাস্তায় কোনো পালকি দেখা যায় না। এটাই সম্ভবত প্রথম কোনো ধর্মঘট। ধর্মঘটের কারণে মন্থর শহর আরও মন্থর হয়ে পড়ে।

    কোম্পানির লোকেরা ভাবতে পারেনি সাধারণ বেহারারা এমন কোনো সংগঠিত আন্দোলন করতে পারেন পালকি বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে মানুষ সমস্যায় পড়েঅফিস আদালতে যেতে সমস্যা হয়। যাদের নিজস্ব পালকি আছে, বেহারারা ধর্মঘট করায়, তারও সমস্যায় পড়েন। দিনের পর দিন সমস্যা বাড়তে থাকে। আর ঠিক এমন সময় এমন এক কাণ্ড ঘটে যা কলকাতার যাতায়াত ব্যবস্থায় এক যুগান্তকারী পরিবর্তনের বীজ প্রেথিত করে।

    পালকি ধর্মঘটের কারণে আন্যান্য অনেকের মতো সমস্যায় পড়েন ব্রাউন লো সাহেব। তিনি চৌরঙ্গীতে থাকতেন। তিনদিন ধরে তিনি অফিস যেতে পারেননি। ঘরে বসে বসে ক্লান্ত ও বিরক্ত হন। তার নিজের পালকি আছে, কিন্তু বেহারা নেই। অবশেষে তিনি এক বুদ্ধি করেন। পালকির দুটি ডান্ডা খুলে তাতে চারটে চাকা পরিয়ে দেন। আর সামনে নিজের ঘোড়াটা জুড়ে দেন। বেহারার কাঁধ নিয়, ঘোড়ায় টানা সেই পালকি গড়গড়িয়ে চলে রাস্তা দিয়ে। ব্রাউন লো সাহেবের এই পালকি গাড়ির ঘটনাটি শ্রীপান্থ বেশ সুন্দর করে বর্ণনা করেছেন তাঁর শ্রীপান্থের কলকাতা বইতে। শ্রীপান্থ লিখেছেন, একদিন সকালে উঠে তিনি নিজের পালকি নিয়ে বসলেন। তিনদিন মনমরা হয়ে পড়েছিলেন সাহেব। আপিস যাওয়া হয়নি। সেদিন ঘুম থেকে উঠেই লাগলেন হাতুড়ি বাটুলি নিয়ে। পালকির নীচে চারটা চাকা জুড়লেন। তারপর সামনে হাতলটায় একটা ঘোড়া জুড়ে দিয়ে চললেন আপিসে।

    ব্রাউন লোর নামানুসারে সেই গাড়ির নাম হল ব্রাউনবেরি। ১৮২৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রাউনবেরির জন্ম। লোকেরা একে বলত পালকি গাড়ি। সে গাড়ি দিব্যি গড়গড়িয়ে চলে। সময় অর্থ সব সাশ্রয়। ঝামেলাও কম। লোকেরা দেখল ব্যাপারটা মন্দ নয় দেখতে দেখতে কলকাতার রাস্তায় ছেয়ে গেল এমন পালকি গাড়ি। স্তব্ধ কলকাতা কেবল সচল হল না, একধাক্কায় যেন অনেকটায় বাড়তি গতি পেয়ে গেল। সেই সঙ্গে সঙ্গে আগামীর যোগাযোগ ব্যবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা করে দিল। পরবর্তী কালে ১৮৭৫-৭৬ খ্রিস্টাব্দে গ্রিনফিল্ড সাহেব পালকি আর গাড়ি মিলিয়ে এক ধরনের গাড়ি তৈরি করেন। তার নামানুসারে এই গাড়ির নাম হয় গ্রিনফিল্ড

    যাই হোক, বেহারাদের ধর্মঘট চলতে থাকে। প্রায় এক মাস ধরে এই ধর্মঘট চলে। কিন্তু তাতে বেহারাদের কোনো লাভ হয়নি উল্টে কলকাতার রাস্তায় ঘোড়ায় টানা পালকি গাড়ির বাড় বাড়ন্ত দেখে তারাও বুঝতে পারে তাদের রুজি রোজগারে টান পড়তে চলেছে। অগত্যা ধর্মঘট ত্যাগ করে আবারও তারা পালকি কাঁধে তুলে নেয়। কলকাতার বুকে আবারও মানুষের কাঁধে ছুটতে থাকে পালকি। কিন্তু পালকির গৌরব আর একচ্ছত্র আধিপত্য যে ফুরিয়ে আসছে, তার বিপদবার্তা সুনিশ্চিত হয়ে যায়।

    এরপর সময় এগিয়েছে একটু একটু করে। ধীরে ধীরে আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থায় দ্রুত পরিবর্তন আসতে শুরু করে। সেই গতির সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে ক্রমশ পিছিয়ে পড়ে পালকি। একটা সময় তা আমাদের জীবন থেকে আপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। বর্তমানে শহর থেকে শুরু করে গ্রাম, যোগাযোগ ব্যবস্থায় প্রভূত উন্নতি ঘটেছে। এখন গতির যুগ। জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে কেবল গতি আর গতি। ঐতিহ্যের পালকি ধীরে ধীরে হারিয়ে গেছে যোগাযোগের মানচিত্র থেকে। পালকি আর এখন দেখা যায় না বললেই চলে। কোথাও কোথাও পুরোনো কোনো ঐতিহ্য পালনে বিশেষ বিশেষ কোনো অনুষ্ঠানে হয়তো পালকির ব্যবহার হয়। কোথাও বা ঠাকুর দেবতা বহনের ক্ষেত্রে। কিন্তু সেও ধীরে ধীরে কমে আসছে। এককথায় পালকির ব্যবহার এথন আর নেই বললেই চলে। তার স্থান হয়েছে মিউজিয়ামে আর স্মৃতির অতীত পাতায়। তবে একথা অস্বীকার করা যাবে না, এই পলকি একটা সময় যোগাযোগা ব্যবস্থায় একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে। যতই হারিয়ে যাক স্মৃতির পাতায় কিংবা ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে তার গৌরবোজ্জবল ভূমিকার কথা।

 

 

 

তথ্যসূত্র

শ্রীপান্থের কলকাতা – শ্রীপান্থ

কলকাতা দর্পণ – রাধারমণ মিত্র

No comments:

Post a Comment