Friday, June 19, 2020

গ্রন্থ আলোচনা - এই হৃদয়ে হাত রেখে


কাব্যগ্রন্থ - এই হৃদয়ে হাত রেখে
কবি - রাজকুমার আচার্য
আলোচক – শুভঙ্কর দাস

প্রেম নৌকাসমগ্র।স্রোতের প্রতিটি মুখ চুম্বন করে চলা এক শরীরী পারাপার। স্পর্শ জলের ডাক।তটের  সংসারী অভিযানে, এই নাও, সন্ততি, চমৎকার!
শুধু নৌকা দেখলে,গভীরের গমনপথ তাও প্রেম।
প্রেম নোঙর পর্যন্ত, যার পাশে কালো কাদা পাঁক লেগে আছে!
কাদা ছাড়া কোনো শরীর গড়ে ওঠে না, এমন কী মূর্তিও, ভালোবাসার ফুল কোথায় দেব?

সেই ফুল আর কাদার মূর্তি সন্ধানী এক কবি।রঞ্জনকবি রাজকুমার আচার্য।
প্রসঙ্গ। এই হৃদয়ে হাত রেখে।
যেমন পূজায় বেলপাতা ছাড়া পুজো অসম্পূর্ণ থাকে,তেমনই যে কবি একটিও প্রেমের কবিতা লেখেনি,তাঁর কবিতাপুজো সম্পূর্ণ হয় না! সেখানে রঞ্জনকবি রাজকুমার স্রোতের মতো অসংখ্য প্রেমের কবিতায় নির্মাণ করেছেন,এই কাব্যপ্রেমগৃহ। তিনি বলছেন,"দুটি হলুদ পোস্ট কার্ড জড় হয়ে/তোমার মন উড়ে আসে ডাকে/সবুজ হৃদয়ে আমি/ছুটে ছুটে নির্জনতা খুঁজি/মন চুরি হয়ে যায় পাছে"
অথচ মনচুরি তো দরকার হয় না!কবির মন তো চোর নয়। প্রেমের এমন আকাশ, যেখানে ডানা চুরি করে উড়তে হয় না, এমন অবকাশ, যেখানে কৃত্রিম প্রসাধন লাগিয়ে ভোলাতে হয় না! এমন শ্বাসের বাতাস, যেখানে বাজারজাত সুগন্ধী ব্যবহার করতে হয় না। কবি তা জানেন, তাই বললেন, "আমি ওকে ভালোবাসি আজও বলিনি/আমাকে উসকে দিচ্ছে বদ্ধ পড়ার ঘরে/সদ্য ভেজা চুলে আলতা রাঙা পা"
ভালোবাসা কেমন? না, কে মন? না, মন কে? উলটেপালটে সেই সত্য বেরিয়ে আসে, ভালোবাসি বলার আগে নীরব নিঃশ্বাসে যতবার ভালোবাসি বলেছি,ততই তো পেয়েছি, আমি আমাকে, আমার ঢেউকে, আমার দুপুরকে, আমার আলপনা আঁকাহীন অশ্রুকে,আমার আয়নাকে! আশ্চর্য, তা সব চোখে পড়ে যখন "তুমি"র জন্ম হল।
সেই এক অনাবিল তুমি র জন্মকথা লিখেছেন,রঞ্জনকবি।" জঙ্গলের পাশে এসে দাঁড়ালে,ইঙ্গিতে দেখালে দেবী/এই আমাদের প্রথম ডাকঘর"
একজন প্রেমিকের হৃদয় ডাকঘর প্রেম,প্রেমিকা তার জীবনের গোপনগহন চিঠি, যা পাঠ করার জন্য কবি জেগে থাকেন আজীবন।অক্ষরে অক্ষরে। মধ্যযুগের রোমান্টিক কবি সৈয়দ আলাওল প্রেমের স্বরূপ বোঝাতে লিখেছিলেন, "প্রেম বিনে ভাব নাহি,ভাব বিনে রস/ত্রিভুবন যত দেখ প্রেম হস্তে বশ"
এই প্রেমের হাত অনুসন্ধান করেছেন, হৃদয়ের হাত তৈরি করে।
রক্তকরবী নাটকে রঞ্জন তার হৃদয়দেবী নন্দনী না আলিঙ্গন, না চুম্বন, না দেহমিলন কোনোকিছু পর্যায়ে পায়নি, কিন্তু যখন সে শুনেছে, রাজাকে নন্দনী বলেছে, আমার হৃদয় যে জয় করে আছে, সে একমাত্র রঞ্জন।
তাই রঞ্জনের জীবনযাত্রায় পরমপ্রাপ্তি স্বর্ণস্বর্গ হয়েছে। একথা শুনে রঞ্জন এবার মরতেও পারবে।
রঞ্জনকবি রাজকুমার তাই, একবার হৃদয়ের হাত দিয়ে বুকের দরজাটা খুলে দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন, ঢুকতে পারা না পারা নিয়ে কোনো চিন্তা চেতনা নেই।দরজা খোলার এই প্রেমভাবনা নন্দনীর সেই আত্মস্বীকারোক্তির মতো। এইটুকু চান কবি রাজকুমার।
এই প্রেমের কাব্যে নৌকা আছে,স্রোত আছে, তট আছে, পারাপার আছে শুধু নোঙর পর্যন্ত দেখার চোখ এসে গেলেই,বাংলা কাব্যে নতুন এক বনলতার জন্ম নেবে নন্দীগ্রামের মাটি থেকে। যেমন কবি বলেন,"সারারাত ভাঙনের স্বপ্ন দেখে/উদ্ধত দরজা দিয়ে পালিয়ে এসে/মনের গোপনে বসে আছি পথপাশে/অনাথের মতো।"
এই অক্ষরের প্রেমযাত্রা কবিকে অনাথ নয়,কোনো একজন হৃদয়বতীর প্রাণনাথ করে তুলবে। সেই অপেক্ষায় আমি, নন্দিনী এবং রাজা রইলাম, প্রেমের ঘাটে নোঙর ফেলে!

No comments:

Post a Comment