Thursday, June 25, 2020

ছোটোগল্প - পূর্ণপ্রভা ঘোষ


অন্য মাকড়সা
পূর্ণপ্রভা ঘোষ

সিরিনকে না জানিয়েই দেশে ফিরে এসেছিলেন নম্রতা। বলতে গেলেই তো তাঁর ফিরে আসাটাই আটকাতো সে। তাইতো তিনি না বলেই ফিরে ছিলেন। মনটা একটু খচখচ করছিলো, কিন্তু উপায় কি! ভাগ্যিস সিরিন সেসময় অষ্ট্রেলিয়াতে গিয়েছিল মাস দুয়েকের জন্য।
   মেয়েটা এমনিতে বেশ ভালোই, দোষের মধ্যে বড্ড বেশ আঁকড়ে ধরে। ছেলেটাই তার পর হয়ে গেল আর...! আজ সেইসব কথাই ভাবতে ভাবতে বাড়ির সামনেই রাস্তা পেরোচ্ছিলেন, আচমকা একটা অটো এসে ধাক্কা দিল! পড়ে যেতেন আর একটু হলেই, কে যেন হাতটি ধরে পড়ে যাওয়াটা আটকে দিল।
   কয়েক সেকেন্ড সময় নলেন ধাতস্থ হতে। তারপর রক্ষাকারী মানুষটিকে একবার ধন্যবাদ দিতে বাঁদিকে ফিরলেন, অবাক কান্ড! সিরিন?
   একগাল হাসি নিয়ে তার সামনেই দাঁড়িয়ে। সত্যি সিরিন!
   আশ্চর্য! কি করে হয়? ঠিক দেখলেন তো? বিশ্বাস হয় না!
   ভ্রম বুঝি? পিঠে একটা মস্ত ঢাউস ব্যাগ। সেই যেমন-তেমন সাধারণ একটা টি-সার্ট গায়ে। হাঁটু অব্দি নামার আগেই থমকে থেমে যাওয়া ঢোলা প্যান্ট। পায়ে বহু পথ ছুটে চলা শক্তপোক্ত জুতো। শনের নুড়ি চুলগুলো মাথার উপর চুড়ো করে বাঁধা, যেন চড়ুই পাখির বাসা! সত্যিই দেখছেন তো? জলজ্যান্ত সিরিন!
   নম্রতা নিজের ব্যথার কথা ভুলে আকাশ থেকে পড়লেন।
   সিরিন নাকি তাঁর খোঁজেই চলে এসেছে এদেশে।
   ‘মাম্মি না ডাকলেই বা ক্ষতি কি!’ তাকে না জানিয়ে তিনি যেমন দেশে ফিরে এসেছেন, তেমনই না জানিয়ে সিরিনও! চলে এসেছে এই দেশে!

   ভাঙা বাংলাভাষা সিরিনের মুখে। তাই দিয়েই কাজ চালিয়ে যাচ্ছে দিব্যি। নম্রতা খুব একটা ভালো ইংরেজি বলতে পারেন না। তবে যাইহোক গোছের কাজ চালিয়ে নেন সবখানে। সিরিনের সামান্য বাংলাভাষার জ্ঞানকে তিনি কয়েক মাসেই বাড়িয়ে নিয়েছিলেন নিজের সুবিধার্থে। সবকিছু চটপট শিখে নেওয়ার ভারি অদ্ভুত ক্ষমতা আছে মেয়েটির। শেখেও অতিবাধ্য ছাত্রীর মতো। সিরিন তো এখনও সমানে বাঙলা বলে চলেছে! ভুল হচ্ছে, হলই বা! এক্কেবারে থেমে থাকার পাত্রী নয় সে! হাসিও পায়!
   নম্রতা রাগ করতে গিয়েও পারেন না! অগত্যা মেয়েটিকে বাড়িতে নিয়ে যেতে হয়। যৌথপরিবারে বাস করেন, ঝামেলার আশঙ্কা ছিলই, হলও তাই!
   শ্বশুরমশাই এখনও বেঁচে রয়েছেন সেই কথা মনে করিয়ে আড়াল থেকে নাহক অনেককথা শোনালেন শাশুড়িমা। এদিক ওদিকে আরও অনেক টিপ্পনী উড়ল।

   ক্যাটক্যাটে কথাগুলো শুনলেন অবধারিত প্রত্যাশায়! সিরিনকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর ঘরে ঢোকার প্রতিটি পদক্ষেপের নাটকীয় বর্ণনা যাত্রাপালার মত উচ্চকিত স্বরে চড়া রঙ মেখে ফিরতে লাগল বহুকালের পুরোনো নোনা-ধরা মিত্রবাড়ির জীর্ণ দেওয়ালের গায়ে।
   মেয়েটি কি ভাবল কেজানে! লজ্জার একশেষ! বড্ড কানে বাজে! সত্যি! কবে যে এরা ভদ্র-সভ্য হবে! ছেলের বাবাকে এইসব কথা বলে কখনও কোনো লাভ হয়নি! অতএব, ক্রমশ শুনতে শুনতে তিনিও অভ্যেস করে নিয়েছেন অতি উচ্চকীয়তার এই সুর। বরাবর কম কথা বলতেন তিনি, এখন আরোওই চুপ!
   দৃড়তার সঙ্গে কেবল নিজ লক্ষ্যে এগোনোর চেষ্টা করেন। ধীরে ধীরে। বোঝেন তিনি, তাঁর এই উত্তর কলকাতার শ্বশুরবাড়িটি থেকে পৃথিবীর বাকি সবকিছুই অনেক দূরের।
   কিছু একটা খাওয়ার মেয়েটার সামনে ধরতে তো হয়। কিন্তু রান্নাঘরে ঢোকার অনুমতি এখন নেই তাঁর। এই বাড়িতে নিয়মকানুনের বেড়াজাল ভয়ানক কঠিন। আপাতত তাঁর নিজের ভাঁড়ারেও তেমন কিছু মজুত নেই।
   আসার সময় বাইরে থেকে কিছু একটা কিনে আনলে ভালো হত।
   নিজের উপরেই বড্ড রাগ হয়! শাশুড়িমা যে তাঁর ওপরে রাগ করেন, অন্যায় নয়! এখনও বুদ্ধিশুদ্ধি পরিনত হয়েছে কই? বয়স তো অনেকখানি পেরোলেন, আজও সঠিক কাজটি সঠিক সময়ে ভেবে বা করে উঠতে পারেন না!
   সেজ-জায়ের ঘরে কিছু একটা পেতে পারেন। তাছাড়া মানুষটি ভালোই। অন্যদের মত কুচুটে নয়। এই আচমকা বিপদ হতে রক্ষা পেতে তারই শরণাপন্ন হন অবশেষে।
   সম্ভবত মিনিট সাতেক কিম্বা মিনিট দশেক গিয়েছে এইসব ব্যবস্থা করতে। ফিরে এসে দেখেন, ঘরে নেই সিরিন। আরে! কোথায় গেল মেয়েটা? এদিক ওদিক খোঁজেন। এইটুকু সময়ের মধ্যে উড়ে গেল নাকি সে মেয়ে?
   একী? শাশুড়িমায়ের ঘরে? অদ্ভুত!
   খাটে বসে সরবতের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে সিরিন! সামনের রেকাবিতে কয়েকটা নকুলদানা বাতাসা। বেশ তারিয়ে তারিয়ে মজা করে খাচ্ছে মেয়ে!
   এযে পুরোপুরি অসম্ভব! মনে হয় স্বপ্নই দেখছেন নম্রতা।

   বছর গড়িয়ে গেল, কাউকেই কথাটা বলা হয়নি! সেই কথাটি কেবল ছোটবাবুকেই জানাতে পারতেন! পূর্ণবিশ্বাস ছিল তাঁর উপর। ছোটবাবু ছিলেন সত্যিকারের শিক্ষিত উদার মনের মানুষ। একটাই দোষ, থেকে থেকে এ্যাডভেঞ্চারের নেশায় দৌড়ে বেড়ানো। বারোবছরের অনুপস্থিতি, থেকে থেকেই ভুলে যান নম্রতা। যেকোনো কঠিন পরিস্থিতিতে বারবার ছোটবাবুর সাহায্য দরকার অনুভব করেন। ছোটবাবুর সঙ্গে তাঁর কলেজের তিন বছরের বন্ধুত্ব। যদিও একটি মাত্র সাবজেক্ট কমন ছিল তাঁদের। বাংলাসাহিত্য।
   বিয়ে হয়ে এইবাড়িতে আসার পরেও তাঁদের বন্ধুত্ব ছিল বেশ। তিনি অবশ্য খুব আফশোস করতেন, পড়াশোনার পাট চুকিয়ে সংসারের খুঁটিনাটিতে নম্রতার ব্যস্ততা দেখলে। এই বিরাট পরিবারের ছড়ানো শেকড়বাকড় ডালপালার মধ্যে যখন শ্বাস নিতে খুব কষ্ট হোত নম্রতার, কখনও কখনও সামান্য সমস্যার সমাধান খুঁজতে গিয়েও দিশাহারা হয়ে যেতেন, সেই সেই সময়গুলোতে অক্লেশে বাড়িয়ে দেওয়া ছোটবাবুর বন্ধুত্বের হাত নম্রতা পেতেন ঈশ্বরের আশীর্বাদের মত।
   সেই ছোটবাবুও কোথায় চলে গেলেন!
   অবশ্য, ছোটবাবুর স্ত্রী সবিতাকে তিনি নতুন করে পেয়েছেন বন্ধুর মতো। এই জটিল জটাজাল সম্পর্কের অন্ধকারে যেন একটুকরো স্নিগ্ধ সত্য আলো সে। তিনি বিশ্বাস করেন, ছোটবাবুর সুযোগ্য সহধর্মিনী সবিতা। কিন্তু এই দুঃসহ পরিস্থিতির মধ্যে কেমন করে তাকেই বা বলবেন তিনি সব?
   সবিতার মা এসেছিলেন মেয়েকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন বলে। অন্তত কয়েকটা দিন হলেও তাঁর কাছে গিয়ে থেকে আসুক। মেয়ে রাজি নয় একেবারেই।
   যাইহোক না কেন এটা সবিতার শ্বশুরবাড়ি। এই শোক এখানে সবটুকু তার একার নয়। বারোটা বছর, এখানের ঘর-বাড়ি, সম্মান-অসম্মান, সুখ-দুঃখ, সবকিছুই সকলের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। ‘এমনই বক্তব্য’। অথচ কিনা সবিতা এই যুগেরই মেয়ে! সবিতার মা অবাক দৃষ্টিতে তাকান! এই মেয়েটি তাঁর নিজেরই সেই মেয়ে তো?’
   সবিতা জানে মায়ের কাছে গিয়ে পৌঁছোলে এইযে তার মাত্র কয়েক বছরের বিবাহিত জীবনের স্বামীর স্মৃতি আঁকড়ে বাঁচতে চাওয়া, বেঁচে থাকা, সবটাই অসম্ভব হবে। বুকের উপর পাথরটা আরোও বেশি করে চেপে বসবে সেখানে।
   সদ্য স্বামী হারানোর শোক তো নয়! দুর্বিসহ, ভয়ঙ্কর কঠিন পরিস্থিতির শিকার সে।
   ‘শুধুমাত্র ভবিষ্যতের একটু আশ্রয়ের আশায় সবিতার এই মাটি আঁকড়ে পড়ে থাকা?’ না! দশবছরের বিবাহিত জীবনে নিঃসন্তান সবিতা। কেবল স্বামীর স্মৃতি আঁকড়ে-থাকা জীবনে, মায়ের অতিরিক্ত খবরদারী সহ্য করা অসম্ভব। ওই সাংঘাতিক বাক্যবাণ হজম করা একেবারেই সম্ভব নয়! মায়ের কথাগুলো বড্ড কানে বাজে। মেলে না মায়ের ভাবনার সঙ্গে। অথচ এইবাড়িতেও তার অবস্থান খুব সুখকর নয়! তবুও!
   ‘আবার বিয়ে?’ অসম্ভব ভাবনা মায়ের। মন থেকে ছোটবাবুর স্মৃতি দূরে সরিয়ে ফেলা একেবারেই অসম্ভব সবিতার পক্ষে। সেই মানুষটির সংস্পর্শে যে কেউ একবার এলে, ভুলে যাওয়া কঠিন, তারপর স্বামী!
   ফিরে গিয়েছেন সবিতার মা। একগুঁয়ে মেয়েকে একটা শেষকামড় দেবেন না তাকি হয়? অতএব যথাসময়ে হাটে হাঁড়ি ভেঙেছেন, স্বভাব মত।
   ‘এত সতীপনা দেখাচ্ছ? তাও যদি আগের কান্ডটা সকলের অজানা হত’। সত্যি! যা জানা ছিল না কারও, সেটাই সকলের মুখে মুখে, কানে কানে। রটনা, আরও বেশি রঙ চড়ান।
   ‘কি কথা, কি কথা?’
   ‘আরে, আরে বল কী?’
   ‘এ মাগো, ছিঃ! ছিঃ!’ প্রথমের দিকে ফিস্-ফাস্, তারপর দুড়্দ্দাড়। ক্রমশ গল্পের গরু গাছে ওঠে তরতরিয়ে। প্রবল উৎসাহ শুভানুধ্যায়ী সকলেরই মধ্যে, সব্বাইকে জানাতে হবে না? কী কান্ড বাবা!
   সমস্তকিছুই... বিবাহপূর্ব অতিরঞ্জিত প্রেমকাহিনি। লোকে শুনবে না কেন? নিজের মায়ের শ্রীমুখনিঃসৃত, এবং স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয়, অতীব মুখরোচক।
   যৌথ পরিবারের লোকজন বেশ কয়েকদিন মত্ত ছিল সেইসব নিয়ে। সামান্য কিছুটা থিতিয়ে পড়ার আগেই সিরিনের আগমন। লোকে আবার দ্বিগুণ উৎসাহে মাতে। নম্রতার হাতের বাইরে চলে গিয়েছে এখন সবটাই!
   সবিতা ওই তরফের ছোটবৌ, নম্রতা এই তরফের মেজ। দুইপক্ষই সমান কৌতুহলী। বিনা পয়সার, বিনা পরিশ্রমে মজা লুটতে লোকে ছাড়বে কেন!
   কেউ জানত না! একবছর আগেই ‘সিরিনে’র সঙ্গে মাত্র একবছরের বিবাহিত জীবনও সমাপ্ত হয়ে গিয়েছিল ছেলের। নম্রতা ওইদেশে যখন ওদের কাছে গিয়েছিলেন, তখনও, লন্ডনে পৌঁছেও ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারছিলেন না! কারণ তখনও ওরা থাকে একই ছাদের নীচে, চার দেওয়ালের ঘেরাটোপে!
   কারণ ঠিকঠাক ঘর পাওয়া, দুজনেরই আলাদা আলাদা সংসার সামলানো, বিশেষ করে সেই খরচ সামলানোও হোত দুজনেরই মুশকিল্!
   তাই, তখন ছেলের বৌ না হলেও নম্রতার সঙ্গে পরিচয় হল সিরিনের। সিরিনের জন্য আলাদাভাবে একটা ভালোবাসার চোরাস্রোত অনুভব করলেন নম্রতা। ওইদিকে একই সঙ্গে পরবর্তী পর্যায়ের সম্ভাব্য পুত্রবধুর সঙ্গেও আলাপ করিয়ে দেয় ছেলে। হয়ত এইবছরের শেষে, লন্ডনেই তারা বিয়েটা সেরে নেবে।
   ততদিনে সিরিনকে তার নতুন আস্তানা খুঁজে নিতে হবে।
   অবাক হয়ে শোনেন নম্রতা, আজকালকার ছেলেমেয়েদের কথা। কতখানি স্বাভাবিক ওরা। সকলের সঙ্গে সকলের কত সহজ সম্পর্ক। এমন অভাবনীয় ঘটনা সত্বেও! হায় ভগবান! তাঁদের পুরোনো দিনের বাড়িতে, ছেলের জন্য সব রাস্তাই যে বন্ধ হয়ে গেল। দেখা করতে একাই লন্ডনে ছেলের কাছে গিয়েছিলেন নম্রতা, ভাগ্যিস্! তবে ফিরে এসে সেসব কথা এখনও কারও সঙ্গে শেয়ার করতে পারেননি। বলতে পারেননি কাউকেই। কাকেই বা বলবেন! ছেলের বাবাকে তো এক্কেবারে অসম্ভব!
   হয়ত, ছেলে এবং মা, দুজনের সঙ্গেই সম্পর্ক একেবারেই ঘুচিয়ে দেবেন। অথচ সেদিন থেকেই মনের ভেতরে অসম্ভব টানাপোড়েন চলছে।
   তিনি কী প্রচন্ড অন্যায় করছেন? একদিকে অপত্যস্নেহ, অন্যদিকে স্বামী শ্বশুরবাড়িতে অভ্যস্থ হয়ে যাওয়া একেবারে ছাপোষা সহজিয়া জীবনযাপন। কোনটি ছেড়ে, কোনটি রাখবেন? নিরুপায় ভীরু হরিণীর মত ত্রস্ত্য ভাবনায় তিনি এর বেশি কোনো ভাবনা এখনও ভেবে উঠতে পারেননি! একা সবটুকু সামলে উঠবেন কীভাবে? নিজেকেই বা সামলে চলবেন কেমন করে!
   ন্যায় অন্যায় বোধের অন্তর্লীন মানসিক অস্থিরতার সময় মনের মধ্যে হাজারও দ্বন্দ্ব চলে। মনে মনে সেইসব তর্ক-বিতর্কে একেবারে বিধ্বস্ত অবস্থা। নিজের সঙ্গে নিজে যুদ্ধ করে ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। নিজেই নিজের আক্রমনে কুঁকড়ে যাচ্ছেন ভেতরে ভেতরে। এই বিরাট পাষানপুরীতে তাই বড্ড প্রয়োজন হয়ে পড়েছে সেই ছোটবাবুর। কিন্তু কোথায় পাবেন তাঁকে? তিনি সবিতার স্বামী, ‘বোধিসত্ব মিত্র।’
   ও তরফের ছোটবাবু। আজ এইসময়ে কেবল তিনিই একমাত্র সামলাতে পারতেন এই ঝামেলার আদি-অন্ত। সমর্থন করতে পারতেন আজকের এবং আগের, সমস্ত রকমেরই পরিস্থিতি।
   বড় ভালো ছিলেন মানুষটি। সবিতার সঙ্গেও বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল। তবু কেন তিনি কোথায় হারালেন, তা অন্যকথা! বেশ কয়েকদিন থেকে ছোটবাবুর কথা খুব মনে পড়ছে নম্রতার। একমাত্র তিনিই পারতেন এমন বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা থেকে উদ্ধার করতে! কোনো একটা সমাধান খুঁজে বের করতে পারতেন!
   কিন্তু এখন? সবিতার মায়ের এইযে, হাটে হাঁড়ি ভাঙার কুচুটে স্বভাবের মজা নিতে, সমস্ত কথাই ফুলে-ফেঁপে চারদিকে বিকৃতরূপে প্রকাশিত।
   কোন যাদুবলে যে, সর্বপ্রকার খবর সংগ্রহে রাখেন ভদ্রমহিলারা! এইত! আবার একটা গল্প কেমন পেয়ে গেল। অতএব অচিরেই শুরু হবে, ঘোলাজলে মাছ ধরা, পাঁকঘাটা। এক একজনের স্বভাবই এমন!
   নম্রতা এখন কী করেন! বহু ভেবেও কূলকিনারা পান না!
   একটা অন্য প্রসঙ্গ নিয়ে অনেকদিন থেকে স্বামীর সঙ্গে নম্রতার বাক্যালাপ বন্ধ। সবিতার লড়াইটাও ঘরে-বাইরে। নিজের মায়ের সঙ্গেও লড়াই করেছে সবিতা। সম্ভব হয়েছে লড়াই চালানোর। কিন্তু নম্রতার পক্ষে কোনোমতেই তা সম্ভব নয়! কারণ তাঁর ঘরের লোকটিই যে অন্য ধারার!
   এইত, ছেলের পড়াশোনা, কেরিয়ার নিয়ে লড়াইটা সবে একটু থিতিয়েছে। কবে থেকে তাঁর লড়াই নিজের ঘরেই! দেখতে দেখতে জীবনীশক্তিও তলানীতে এসে ঠেকেছে। এর ভেতরে আবার এখন সিরিন এসে উপস্থিত! নতুন জট শুরু।
   শাশুড়ীমায়ের ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে বোকার মতই কতকিছুই ভেবে চলেছেন নম্রতা। নিদারুণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা! হঠাৎ কানে আসে সিরিনের সঙ্গে শাশুড়ীমায়ের কথপোকথন।
   চমকে ওঠেন ঠিক শুনছেন?
   এই বাড়ির অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘেরাটোপ থেকে বাইরের দুনিয়া চোখে পড়ে না। তবে কিছু কিছু শব্দ না চাইলেও ছিটকে এসে কানে ঢোকে। আশ্বিনমাস, চারদিকে সাজো সাজো রব। বারদালানে ঠাকুরের সাজ পরানো প্রায় শেষের দিকে। ওইসব থেকে কোনোরকমে টানতে টানতে সিরিনকে ঘরে ঢুকিয়ে নিয়েছিলেন নম্রতা। সবকিছুতেই কৌতুহলের শেষ নেই যেন এই মেয়ের।
   দেবীপক্ষ শুরু, বাবুদের খুশি করতে মাঝেমাঝেই ঢাকের কাঠিতে ‘দিদ্রিম দ্রিম, দিদ্রিম দ্রিম’ মিঠে বোল তুলছে ঢাকিরা। তা শুনেই সিরিন বেরিয়ে পড়েছিল শব্দের উৎস সন্ধানে।
   বারান্দার ছোট্ট খোপে ঝুঁকে সিরিনকে খুঁজতে গিয়ে একটুকরো আকাশ চোখে পড়ে নম্রতার। ঝকঝকে নীলাকাশে সাদা মেঘের দল ভেসে চলেছে অলস গতিতে। কানে এল, ‘ওই তরফের ছোটবউ ভুল করত যদি সে তার মায়ের সঙ্গে ফিরে যেত’। কান পাতেন নম্রতা অবাক হয়ে। ‘ঠিক কাজ করেছে সবিতা। সাহস করে সকলের বিরুদ্ধেই একা দাঁড়িয়েছে। গুরুদেবের বাক্যি সত্যি হবে, তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিলই। এতদিন পরে আজ বুঝি এই প্রথম একটা কাজ মেজবউ ঠিক করেছে। ঠিকই করেছে সিরিনকে ঘরে এনে। প্রথমে বুঝতে ভুল হয়েছিল তাই অনেক...’।
   এসব কী বলছেন শাশুড়ীমা?
   নিজেই হকচকিয়ে বিহ্বলদশায় পড়েন নম্রতা। ভুলে গিয়েছেন, কতক্ষণ এইভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছেন শাশুড়ীমায়ের দরজার বাইরে!
   কী বলছেন শাশুড়ী? বলছেন কিনা নিজমুখে? বলছেন সিরিনকেই?
   দরজার বাইরে স্থানুবৎ নম্রতা! এই কয়েকটা মিনিটে কীভাবে এমন ওলট-পালট ঘটে গেল? কোন যাদুমন্ত্রে? ভেবে নাকাল, কীভাবেই বা সম্ভব এইসব?
   ঠিক সেইমুহূর্তে সবিতাও ওদিকের বারান্দায় বেরিয়ে নম্রতাকে ওই অবস্থায় দেখে অবাক! কিছুকথা কানে আসে তারও, চমকে ওঠে সেও, ঠিক শুনছে?
   সিরিনের হাতে আঁকা ছিল একটা ‘ট্যাটু’।
   চমৎকারিত্ব সেই ট্যাটুটির।
   এই বংশের গুরুদেব দেহরক্ষার একবছর আগে বলে গিয়েছেন। একদিন কোনো এক বিদেশি আসবে এই বংশের আশীর্বাদ স্বরূপ। যার কাছ থেকে ও তরফের ছোটবাবুরও হদিশ মিলবে। বংশপরম্পরায় এই বাড়ির সকলেই গুরুবাক্যকেই একমাত্র সত্য মেনে এসেছে। সেকথা একটা ছোট্ট বাচ্চাও জানে এবং মানেও। একেবারে সূর্য চন্দ্রের মত অভ্রান্ত সত্য। বিশ্বাস করে সবাই।
   অথচ এই সংসারেই বারো বছর নিরুদ্দেশ থাকা মানুষটির অস্তিত্ব, স্বামীত্বের শেষচিহ্ণ শাঁখাসিঁদুর মুছে ফেলা হল সবিতার শরীর থেকে, জোর করেই। শ্রাদ্ধ পালন করানো হল সবিতাকে দিয়ে, এইতো হয়েছে সবে ছ’মাস।
   এই সংসারের নিয়মকানুনের চোরাবালিতে মাঝেমাঝে নম্রতাও বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। এখনও এই সংসারের বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তির নিদানই সবাইকে মেনে চলতে হয়। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মিত্রবাড়ির প্রায় তেত্রিশটি পরিবার এই ব্যাপারে সর্বদা একমত।
   অথচ হাজারও গন্ডগোল, হাজারও বিবাদ-বিসংবাদ, চলতে থাকা মামলা-মোকদ্দমাও হাজারটি। তবু সকলের জন্য শেষ রায় দেন যিনি বয়োজ্যেষ্ঠ প্রবীণ। সেইমত সকলেই মেনে চলতে অভ্যস্থ। কিন্তু আজ কী শুনছেন নম্রতা?

   ‘ছোটবাবু’- বারোবছর আগে হারিয়ে যাওয়া সেই মানুষটির খোঁজ দেবে এই মেয়ে? বিদেশি তো জানাই ছিল, কিন্তু পুঁচকে এই বিদেশিনী মেয়েটাই যে হতে পারে সেই আকাঙ্ক্ষিত বিদেশি, ভাবনাটি ভুলেও মাথায় আসেনি কখনও!
   দিলও তো! শাশুড়ীমা চেঁচিয়ে উঠলেন আনন্দে।
   অতীত-বর্তমান সব ভুলে দমকা হাওয়ার মত দৌড়ে ঘরে এসে ঢোকে সবিতা। কতবছর পরে, খুড়শাশুড়ীর ঘরে ভেতরে ঢুকল সবিতা!
   সেইসঙ্গে নম্রতাও ধীরে ধীরে প্রবেশ করলেন। মোহাবিষ্টের মত সবাই তখন সিরিনের হাতে আঁকা ‘মাকড়সা’ ট্যাটুটার দিকে তাকিয়ে!
   ছেলের কাছে লন্ডনে মাসছয়েক থাকার সময় তো দেখেছিলেন নম্রতা?
   শাশুড়ীমায়ের গুরুদেবের কথাটিও শোনা ছিল। তাহলে কেন মাথা ঘামাননি?
   কুসংস্কার ভেবে গল্পকথাটি বিশ্বাস করতেন না?
   কিন্তু ছোটবাবুর ব্যাপার তো ভাবতে পারতেন? এই কুসংস্কারগ্রস্ত জীবনে বেঁচে থাকার মতো পর্যাপ্ত অক্সিজেন একমাত্র সেই ছোটবাবুর কাছ থেকেই পাওয়া যেত। সেই কথাটাও ভুলেছিলেন?
   ‘সিরিনের বাংলা শেখার শিক্ষক ছিলেন ছোটবাবু?’
   কীভাবে?
   একসময় বাংলাদেশের জেলার ছিলেন সিরিনের বাবা।
   ‘সিরিনের বাবা বাঙালি’? কই, তিনি সেকথাটিও জানতেন না?
   ছোটবাবুর ছোটখাট কাজকর্মগুলো দেখেও বুঝতে পেরেছিলেন তিনি যে, মানুষটি অত্যন্ত ভালোমানুষ।
   তিনি ভারতবর্ষের ব্যাপারে জানতেন অনেক।
   মেয়েকে বাংলাও শিখিয়েছিলেন কিছুটা।
   ‘এই ভদ্রলোক ওই দেশে অনুপ্রবেশকারী একজন বন্দী।’ দুর্ভাগ্যবঃশত তিনি কোনো কারণে হারিয়ে ফেলেছিলেন পূর্বস্মৃতি। তবে জেলের মেয়াদ শেষের আগেই ছাড়া পেয়েছিলেন। সিরিনের বাবা খুব পছন্দ করতেন। এখন বাবার অবসর জীবনের একমাত্র সঙ্গী হিসেবে বাস করছেন।
   সিরিনের বাবা, এখনও বাংলাদেশের পাহাড় অঞ্চলে থাকেন। সিরিনের জন্মদাত্রী-মা ইউরোপীয়ন। অন্য সংসার পেতেছেন লন্ডনে গিয়ে। সিরিনের তিনবছর বয়সেই তারা বিচ্ছিন্ন হয়েছিলেন।
   সিরিনের বাবা আর বিয়ে করেননি। এবং বড় হয়ে সিরিনই বাবার সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করে। মাঝেমাঝে গিয়ে থাকেও সে বাবার কাছে।
   এখনও চাইলে সে যেতে পারে বৈকি সেখানে।
   ছবিসহ অনেকবার খবরটি বেরিয়েছিল সংবাদপত্রে।
   নম্রতা অবাক হন! তাঁর ছেলেও এইসব নিয়ে কখনও মাথা ঘামায়নি। সিরিনের বাংলাভাষা জানার ব্যাপারটি নিয়ে খোঁজখবর করলেই তো জানা যেত সব।
   আসলে এই যুগের ছেলেমেয়েরা এত ভাবনা ভাবেই না! বিশেষ ভাবে পারিবারিক কিছু হলেতো মাথায় কিচ্ছু প্রবেশ করায় না। কেমন যেন শেকড় বিহীন শ্যাওলার মতো এদিক ওদিক ভেসে বেড়াতে ভালোবাসে!
   নম্রতাও বা কেন এসব ভাবলেন না? তিনিও কি বিদেশে গিয়ে ছেলের কাছে বুদ্ধিহারা, ভাবনাহীন ছিলেন?
   তাছাড়াও আর কেউ খেয়াল করবে না? এমন অন্ধকারে ঢাকা চার দেওয়ালের গন্ডিতে বাস করার নেশায় নিমগ্ন ছিল এই পরিবারের এতগুলো মানুষ!
   একটা মাকড়সা এসে অবশেষে মুক্তি দিল সবাইকে।
   চারদিকে জাল বিছিয়ে শিকার ধরে মাকড়সা। অবশেষে ফাঁদে পড়া সেই প্রাণ, মাকড়সার খাদ্য হয়ে ছটপট করে মরে!
   ‘আর এই মাকড়সা?’
   যদিও অর্থহীন ভাবনা, তবুও নম্রতা না ভেবে পারলেন না! বুঝলেন, কখনও উল্টোটাও ঘটে। যেমন আজ দুর্ভেদ্য জালে আবদ্ধ কিছু প্রাণের উদ্ধারে দেখা দিল অন্য এক ‘মাকড়সা’! প্রাণহীন? নাকি অন্য প্রাণ!


পূর্ণপ্রভা ঘোষ

No comments:

Post a Comment