Thursday, June 25, 2020

সুনন্দর জার্নালের হাস্যরস - সৌরভকুমার ভূঞ্যা


সুনন্দর জার্নালের হাস্যরস
সৌরভকুমার ভূঞ্যা

বাংলা সাহিত্যের বহুবিধ উপাদানের মধ্যে একটি হল হাস্যরস সাহিত্যে হাস্যরসের ব্যবহার অতি প্রাচীন তবে সময়ের ক্রমবিকাশে সাহিত্যে হাস্যরসের ব্যবহার অনেক মার্জিত হয়েছে এই হাসির ব্যবহারের আবার বিভিন্ন দিক রয়েছে কখনও তার উদ্দেশ্য নির্মল হাস্যরসের জোগান দেওয়া, কখনওবা তার মাধ্যমে সমাজের নানান নেতিবাচক দিক তুলে ধরা একজন দায়িত্বশীল সাহিত্যিক সমাজের প্রতি তার দায়বদ্ধতার কথা মাথায় রেখে এভাবে সমাজের দোষত্রুটিগুলিকে সকলের সামনে তুলে ধরেন, যাতে করে এগুলো সংশোধন হয়
    বাংলা সাহিত্যে হাস্যরসের কথা আলোচনা করতে গেলে অসংখ্য উজ্জ্বল নাম আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়, সুকুমার রায়, শিবরাম চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব বসু প্রমুখ আর এই তালিকায় আর একটি উল্লেখযোগ্য নাম হল নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় সাহিত্যের প্রায় সমস্ত শাখায় তাঁর অনায়াস বিচরণ হাস্যরস তার মধ্যে অন্যতম তাঁর সৃষ্ট টেনিদা পাঠক মনে এক বিশেষ জায়গা করে আছে তাঁর সাহিত্যকীর্তির আলোচনায় অবশ্যই করে এসে যায় রম্যরচনার কথা তাঁর লেখা 'সুনন্দর জার্নাল' এক অনবদ্য রম্য সংকলন
    সুনন্দর জার্নালের রম্যরচনাগুলিতে জড়িয়ে রেয়েছে এক নির্মল, শান্ত কিন্তু তীক্ষ্ণ হাস্যরস সুনন্দর জার্নালের বিষয় সম্পর্কে সবিতেন্দ্র রায় বলেছেন, “সুনন্দর জার্নালে এই সময়ের অন্তর্বর্তী বাংলা ও বাঙালির এক সুন্দর ছবি ধরা পড়েছে বাঙালির সুখ দুঃখ, আনন্দ বেদনা, তার সংস্কৃতিপ্রিয়তা এবং কর্মবিমুখতা, বাহাদুরি নেবার সস্তা মানসিকতা, শিক্ষার অব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক ঘটনাবলীর সঙ্গে বাঙালির সংযোগ ও তার জীবনের ওঠা-পড়া, তার আশা হতাশা নৈরাশ্য, দেশি বিদেশী লেখকদের শতবার্ষিকী, খ্যাতনামা লেখক এবং বিখ্যাত মানুষদের তিরোধানে জাতির বেদনা এবং সুনন্দর মর্মবেদনা সমস্তই ধরা আছে এই জার্নালে
    সুনন্দর জার্নালের রম্যরচনা নিয়ে বিশদ আলোচনা করা এই ক্ষুদ্র নিবন্ধে সম্ভব নয় সামাজিক অবক্ষয়ের কিছু টুকরো ছবি এখানে তুলে ধরার মাধ্যমে চেষ্টা করব কীভাবে তিনি হাস্য-পরিহাসের মাধ্যমে সেগুলিকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন
    বর্তমান সময়ের আলোচিত বিষয়ের অন্যতম হল রাজনীতি কথায় বলে রাজনীতি এখন সাধারণ মানুষের রান্নাঘরেও ঢুকে গেছে সত্যি বলতে কী আজকের সময়ে প্রায়শই আমরা রাজনীতির যে রূপ দেখি, রাজনীতিকদের যে চেহারা দেখি তা মোটেও রাজনীতিসুলভ নয় (যদি না এটাকে রাজনৈতিক মতাদর্শের বৈপ্লবিক পরিবর্তন বলে ধরা না হয়) নীতি আদর্শ বিসর্জন দিয়ে রাজনীতি অনেক সময় বেশ কদর্য চেহারা নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয় সচেতন নাগরিক চেষ্টা করেন সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে সরে থাকার কিন্তু পুরোপুরি দূরে সরিয়ে রাখা যায় না গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে আমরা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে এর অংশ হয়ে যাই কেননা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রতিনিধি স্থির করতে নির্বাচন পক্রিয়ায় আমাদের অংশ নিতে হয় আর এই নির্বাচন নিয়ে অনেক নোংরামি ঘটে ভোট এলে দেখা যায় নেতারা কল্পতরু হয়ে ওঠেন প্রতিশ্রুতির বন্যায় মানুষের মাথা ঘুরে যাওয়ার জোগাড় কিন্তু নির্বাচন পরবর্তী সময়ে তাদের জোটে একরাশ আপশোশ আর হতাশা অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় প্রতিশ্রুতির পরিপ্রেক্ষিতে মানুষ রাজনৈতিক নেতাদের দ্বারা প্রতারিত হন মানুষকে যাতে মিথ্যা প্রতিশ্রুতিতে প্রতারিত না হতে হয় তার জন্য সুনন্দ একটি প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি বলেছেন, “আমি ভবিষ্যৎ নির্বাচনের জন্য একটি কার্যকরী প্রস্তাব দিতে চাইছি ভবিষ্যতে যাঁরা কাউন্সিলর পদপ্রার্থী হবেন; তাঁদের ফাঁপা কন্ঠবদনে প্রসেশনের চিৎকারে অথবা প্রচারপত্রের চটকে আমরা আর ভুলব না এইসব ভদ্রমহোদয়রা হাফপ্যান্ট পরে এবং বালতি হাতে নিয়ে একটি আন্ডারগ্রাউন্ড গর্তের ড্রেনে নেমে যাবেন অন্তত একমাস ধরে তাঁরা নিয়মিতভাবে কাদা তুলবেন এবং প্রতি ওয়ার্ডে যিনি যত বেশি কাদা তুলতে পারবেন, তিনি নির্বাচিত বলে ঘোষিত হবেন   
    এতে দুদিক থেকে লাভ হবে প্রথমত, ড্রেনের কাদা তুলতে তুলতে মুখে কাদা ছিটোবার সময় মিলবে না; দ্বিতীয়ত, কলকাতার ড্রেনগুলো সাফ হবে
    বক্তব্যটির মধ্যে একটি হাস্যরস রয়েছে ঠিকই কিন্তু এর মধ্য দিয়ে তিনি তথাকথিত বাকসর্বস্ব, নির্লজ্জ রাজনীতিবিদদের কী ভীষণভাবেই না আক্রমণ করেছেন। নীতির রাজা কিংবা রাজার নীতি; রাজনীতি যাই হোক না কেন, তাকে নিয়ে যে কদর্যতা এখন আমরা দেখতে পাই তা দূর করার এর থেকে বোধহয় ভালো দাওয়াই হয় না।
    আজকাল রাজনৈতিক নেতাদের মুখে অশ্লীল কথাবার্তা, একে অপরকে উদ্দেশ্য করে কাঁদা ছোঁড়াছুঁড়ি একটা রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনীতিতে সৌজন্য কথাটা এখন অনেকটাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে যত অপরের নিন্দা করতে পারবে, কাদা ছিটোতে পারবে, মুখে অশ্লীল কথা বলতে পারবে সেই যেন যোগ্য নেতা। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের এমন ছবি দেখে সাধারণ মানুষ হতাশ হন। আসলে নেতাদের ভালোমানুষির মুখোশটা তারা ধরতে পারেন না তাই তাদের প্রতারিত হতে হয়। কিন্তু যদি জেনেবুঝেই এমন কাউকে মানুষ নির্বাচিত করত তাহলে বোধহয় তাকে এতটা প্রতারিত হতে হত নাসে কারণে নেতা নির্বাচন প্রসঙ্গে সুনন্দ আরও একটি প্রস্তাব দিয়েছেন“সুতরাং ভোটারদের পক্ষ থেকে আমি একটি সুস্পষ্ট প্রস্তাব উপস্থিত করছি। যে কাঁচিওয়ালা, যে আমলা, যে মালসী---দোলের উত্সবে যত বেশি কাদা-আলকাতরা মেখে নাচতে পারবেন, উল্টো গাধায় চেপে হোলির রাজা সাজতে পারবেন, বাঁজাখাই গলায় চা-রা-রা-রা ধ্বনিতে দিগদিগন্ত কাঁপিয়ে দিতে পারবেন, আগামী নির্বাচনে দল-মত নির্বিশেষে একবাক্যে তাঁকেই আমরা ভোট দেব।”
    জনগন গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করে নেতানেত্রী নির্বাচন করে বিধানসভা, লোকসভায় পাঠান। তাঁদের কাজ হল মানুষের সমস্যা সেখানে তুলে ধরা, তাদের কাজ করা। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায় তারা তা ভুলে যান। এর পাশাপাশি আর একটা ব্যাপার খুব খারাপ লাগে। মানুষ যাকে নির্বাচন করেছেন অর্থাৎ যিনি নেতা বা নেত্রী, তিনি দায়িত্বশীল হবেন, তার মধ্যে নেতৃত্বসুলভ গুণ থাকবে এমনটাই কাম্য। কিন্তু দেখা যায় বিধানসভা কিংবা লোকসভার মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় বসে তারা একে-অপরের সঙ্গে কদর্য ভাষায় গালাগালি করেন, মারামারি করেন। অনেক সময় নিজেদের বাহুবল প্রদর্শনের নিমিত্ত তারা লোকসভা কিংবা বিধানসভার জিনিসপত্র ভাঙচুর করেন। তাদের এরকম কাজকর্ম দেখে অবাক হতে হয়। তখন তাদের আর ঠিক নেতা মনে হয় না। খেলার মাঠে মাঝে মাঝে এমন দৃশ্য দেখা যায় সমর্থকদের মধ্যে। এইসব রাজনীতিকদের দেখে সুনন্দর সেই সব খেলার মাঠের সমর্থকদের কথা মনে পড়ে, “কিন্তু অ্যাসেম্বলির প্রসঙ্গটা চিন্তায় ফিরে এল আবার। অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের আশায় আমি দু-একবার সেখানে দর্শকদের গ্যালারিতে হানা দিয়েছি। পরিস্কার মনে হয়েছে সেখানকার অধিকাংশ ভদ্রমেহাদয়ই আসলে খেলার মাঠের সমর্থক; অকথ্য গালাগাল, জুতো ছোঁড়া, ইট-পাটকেল, হাতাহাতি, গ্যালারীতে আগুন দেওয়া ইত্যাদি পুণ্য কর্মেই তাদের নৈপুণ্য সমধিক। তর্ক-বিতর্ক, দেশের ভালো করা ইত্যাদি অনাবশ্যক ব্যাপার ছেড়ে দিয়ে দুদলের বাইশ জনে বরং তারা ফুটবল (নাকি ‘সকার?’) খেলুন---বাকিরা সমর্থকের ভূমিকায় নেমে পড়ুন---দেখে চোখ আমাদের সার্থক হোক।”
    আর রাজনৈতিক নেতাদের দাদাগিরির ব্যাপারটা আমরা হামেশাই দেখে থাকি। বড়ো থেকে চুনোপুঁটি কেউ বাদ যান না। আসলে কে আর এমন সুখ হারাতে চায়? সুখই বটে! নাহলে কেন তারা এমন করে? সুনন্দর কথায়, “কিন্তু রাজনৈতিক দাদাগিরি? তার মতো সুখের জিনিস সংসারে আর কী আছে?”
    রাজনীতি ছেড়ে এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে আসা যাক। ঘুষ নামক বস্তুটির সঙ্গে আমাদের প্রায় সবার পরিচয় আছে। এই ঘুষ প্রথা কেবল আজকর নয়। বোধহয় যুগ যুগ ধরে এটি চলে আসছে। বর্তমানে এই ঘুষ ব্যাপারটা অনেকক্ষেত্রে ওপেন-সিক্রেট হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে কাজ এমনিতে হয় না ঘুষ দিলে তা অনায়াসেই হয়ে যায়। এমনকি যে কাজ কোনোভাবেই হওয়ার নয়, তাও সম্ভবপর হয়ে যায় ঘুষের কল্যাণে। এমনকি স্কুল কলেজের পরীক্ষার ক্ষেত্রেও আজকাল ঘুষ তার স্থান করে নিয়েছে। পরীক্ষা নামক ব্যাপারে অনেক সময় কিছু কিছু সাফল্য বেশ রহস্যময় হয়ে ওঠে। কখনও কখনও তাকে ভৌতিক কিংবা অলৌকিক বলেও মনে হয়। সুনন্দ তাঁর জার্নালে নকড়িবাবুর কথা বলেছেন। নকড়িবাবুর ছেলে পাঁচকড়ি, যার পাশই করার ক্ষমতা নেই, নকড়িবাবু নীচতলা থেকে ওপরতলা পর্যন্ত টাকা খাইয়ে তাকে ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করিয়ে নিয়েছেন। যা নিয়ে সুনন্দ মন্তব্য করেছেন, “পাঁচকড়ি ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করল! এর চাইতে অলৌকিক ঘটনা পৃথিবীর কোন ভৌতিক লেখক লিখতে পেরেছেন?.....এর পরেও ভূত মানব না? বলেন কী মশাই?
    সত্যি সমাজের মধ্যে এরকম অনেক ভূত ছেয়ে গেছে আজকাল। আর তার ফলে সমাজে অপসংস্কৃতি বাড়ছে। ঘুষ না দিলে অফিসের ফাইল নড়ে না। এক টেবিলের ফাইল পাশের টেবিলে যেত যে মাত্রাতিরিক্ত সময় লাগে তা দেখে মাঝে মাঝে অবাক হতে হয় সত্যিই আমরা গতির যুগে বাস করছি তো! নাকি সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সমাজের কিছুকিছু ক্ষেত্র পাল্লা দিতে পারেনি। নিদারুন গতি মন্থরতার শিকার হয়ে পড়েছে তারা? কিন্তু তারা যে গতি মন্থরতায় ভুগছে না, এই মন্থর গতি যে তাদের নিজেদেরই সৃষ্টি তা সহজেই অনুমেয় হয় যখন দেখা যায় ঘুষ নামক পরশমণির ছোঁওয়া পেলে তাদের গতি অসম্ভব দ্রুত বেড়ে যায়। তবে শুধু ঘুষ নয়, এর সঙ্গে যোগ হয় খুঁটির জোর। অনেক সময় শুধু ঘুষেই কাজ হয় না খুঁটির জোরও থাকতে হয়। এর ব্যাখ্যা বোধহয় নিস্প্রয়োজন। কর্মসংস্কৃতির এমন নিদারুণ চেহারা ফুটে উঠেছে সুনন্দর জার্নালে। ব্যক্তিজীবনের এমন এক নিদারুণ কাহিনি ব্যক্ত করেছেন তিনি বলেছেন, এ টেবিলের ফাইল ও টেবিলে যেতে পনেরো দিন গড়িয়ে যায়।” যে কাজ চার মাসের আগে সম্ভব নয় বলে তাকে বলা হযেছিল, অদ্ভুতভাবে দেখা যায় সেই অফিসের কোনো বড়োকর্তা তাঁর পরিচিত হওয়ায় চল্লিশ মিনিটে হয়ে গেছে।
    ঘুষের পাশাপাশি এসে যায় কালোবাজারির প্রসঙ্গ। তিনি কৌতুকের ভাষায় এর তীব্র নিন্দা করেছেন। “আজ ভারতের গণেশ দিকে দিকে তাঁর করাল হাত মেলে বসে আছেন। সে হাতে যা পড়ছে, তাই লোপাট; লক্ষ লক্ষ লিটার কেরোসিন তিনি উদরস্থ করছেন, চাল-ডাল-নুন যা পাচ্ছেন পাচার করছেন যদিও তিনি ‘বেবি’ নন---কিন্তু টিন টিন ‘বেবিফুডে’ তাঁর অরুচি হচ্ছে না, এমনকি সেই ‘মাইনিকুল’ নয়া পয়সাযা ভিখারীকে দিলেও ফেরত দিত---তাতে কয়েক গ্রেন তামা আছে বলেও তা-ও তিনি সযত্নে আত্মসাৎ করছেন।”
    এতো গেল সমাজের একটি দিক। এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে আসা যাক। বর্তমান সময়ে আমাদের রাজ্যে পুজো পার্বন, উত্সব, মেলা প্রভৃতি ক্রমবর্ধমান হারে বেড়ে চলেছে। বাংলায় একটা বহুল প্রচলিত কথা আছে, ‘বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বন।’ কিন্তু এখন বাঙালির বারো মাসে কত যে পার্বন তা ঠিকঠাক হিসেব করা যাবে না। দেবদেবীর পুজো ছিল। এখন তাদের বাহনের পুজো শুরু হয়েছে। ব্যাপারটা মন্দ নয়। যারা এতকাল বাহনের কাজ করেছে তারাই বা পুজো পাবে না কেন? সুতরাং শুরু হয়েছে বাহনদের নিয়ে মাতামাতি। পাশাপাশি কত যে নতুন দেবদেবীর পুজো শুরু হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। আর মেলা কিংবা উৎসবের কথা তো বলার নয়। তার জন্য বিশেষ কোনো পরবের দরকার হয় না। যা কিছু একটা ব্যাপার নিয়ে শুরু করে দিলেই হল বাঙালি উৎসবপ্রিয়। উৎসবের প্রতি তার ভালোবাসা দিনদিন বাড়ছে। উৎসব মানেই আনন্দ। মেলা মানেই মিলন। সুতরাং মেলা কিংবা উৎসব বাড়লে আপত্তির প্রশ্ন ওঠার কথা নয়। কিন্তু উৎসব যখন যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, মেলা যখন জীবনে ঝামেলা নিয়ে আসে, তখন তা নিয়ে চুপ করে থাকা যায় না।
    একটা উৎসব কিংবা মেলা করতে গেলে টাকার প্রয়োজন। এখন এইসব ক্ষেত্রে নানা জায়গা থেকে ডোনেশন আসে। তা সত্ত্বেও মানুষকেও এর জন্য টাকাপয়সা দিতে হয়, যার নাম চাঁদা আগে বছরে হাতে গোনা কিছু উৎসব হত। তাই মানুষ খুশি মনে নিজের সামর্থ অনুযায়ী চাঁদা দিত। কিন্তু এখন বছরভর এত উৎসব যে চাঁদার চাপে মানুষের নাভিশ্বাস ওঠে। তার ওপর, এক-একটি এলাকায় অসংখ্য বড়ো-মেজো-সেজো-ছোটো সংগঠন উৎসব নিয়ে উৎসাহী হওয়ার সাইড এফেক্ট হিসেবে মানুষের ওপর চাঁদার চাপ বাড়ে যা মানুষের উৎসবের আনন্দটাকে দূরে সরিয়ে দেয়। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে চাঁদা নামক ‘সাহায্য’ অনেকটা ‘তোলা’ আদায়ের পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়ায়। মানুষকে ভয় দেখিয়ে, শাসিয়ে বাধ্য করা হয় দাবি মতো চাঁদা দিতে। নাহলে তার কপালে অনেক দুর্ভোগ লেখা থাকে। তখন সেই আক্রান্ত ব্যক্তির কাছে উৎসব আর উৎসব থাকে না। এ-প্রসঙ্গে সুনন্দ বলেছেন, “চাঁদার সঙ্গে যখন ছোরা বেরোতে আরম্ভ করেছে, তখন থেকেই আমাদের উৎসবেও বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে গেছে।” সত্যিই বৈপ্লবিক পরিবর্তন বটে! বর্তমান সময়ে পুজো-পার্বন বা উৎসবের চেহেরা দেখলে বোঝা যায়, শুধু বৈপ্লবিক নয় তার থেকেও আরও মারাত্মক পরিবর্তন ঘটে গেছে।
    পুজো মানেই শব্দ দানবের আক্রমণ, কান ফাটানো বাজির অত্যাচার। বর্তমান সময়ে সরকার নিয়ম করে শব্দের সর্বোচ্চ মাত্রা বেঁধে দিয়েছে। পাশাপাশি রাতে কত সময় পর্যন্ত মাইক বাজানো যাবে তাও নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। তাসত্ত্বেও দেখা যায় শব্দ-যন্ত্রের তাণ্ডব আর বাজির ভয়ংকর আর্তনাদ। রাত গড়িয়ে মধ্যরাত, আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে সবকিছুই চলতে থাকে অবলীলায়। প্রশাসন যে সবকিছু জানতে পারে না এমন নয় কিন্তু অনেকক্ষেত্রে দেখা যায় কোনো এক রহস্যময় কারণে তারা উদাসীন থাকে। জনসাধারণের অসুবিধার কথা মাথায় থাকে না। উল্টে যদি কেউ এর প্রতিবাদ করতে যায়, তাহলে সে হয়ে যায় টার্গেট। সমাজের এই অবক্ষয়ের কথা ফুটে ওঠে সুনন্দের কথায়, আরো বেশি অ্যামপ্লিফায়ার চালান, প্যান্ডেলে অন্তত একমাস করে প্রতিমা রেখে দিন। উৎসবের দিন আরো বেশি শব্দময় বোম-পটকা ফাটাতে থাকুনত্রিকোণ-ট্রিকোণে কাজ যাই হোক, এই অব্যর্থ ফল অচিরাৎ পাওয়া যাবে। লোকক্ষয় ঘটাবার জন্য এমন আমোঘ উপায় আর নেই। এখন পুজোর নামে মাতামাতি আর হুল্লোড় বেশি চোখে পড়ে পুজোটা উপলক্ষ্য মাত্র হয়ে যায় এই কঠিন সত্যকে সুনন্দ তীব্রভাবে আক্রমণ করেছেন, “একদিনের পুজোয় পাঁচদিন ধরে হৃদস্পন্দনরোধকারী এই পৈশাচিকপ্রায় উৎসব, এই সঙ্গীতের বিভীষিকা, এক পাড়া-কাঁপানো, কান ফাটানো হার্ট অ্যাটাক জাগানো বোম-ফটকা, এই মূর্তি ভাঙার বিপ্লব---একটু তলিয়ে দেখলে সব একটাই কর্মনীতির অংশ---সমস্তই একসূত্রে গাঁথা বাঙালীর নাভিশ্বাস ঘনিয়ে আসছে
    মূর্তি ভাঙার প্রসঙ্গ যখন এল তখন এ-প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা না বললে নয় বর্তমান সময়ে দেখা যায় বিভিন্ন কারণে মূর্তিভাঙার একটা রেওয়াজ শুরু হয়েছে সে শুধু আমাদের রাজ্য বা দেশ নয়, বিদেশেও মূর্তি ভাঙার মধ্যে, তা সে যে কারণেই হোক, কী বীরত্ব আছে জানি না, এর মধ্যে যে শ্রদ্ধা এতটুকু নেই তা পরিস্কার শুধু মূর্তি ভাঙায় অশ্রদ্ধা প্রকাশ পায় এমন নয় দেখা যায় মনীষীদের মূর্তির প্রতি ঠিকঠাক দেখভাল করা হয় না জন্মদিন, মৃত্যুদিন কিংবা কোনো বিশেষ দিনে মূর্তিগুলো হয়ত কিছুটা পুজো পায় কিন্তু বছরের বাকি সময় মূর্তিগুলো চরম অবহেলায় পড়ে থাকে তাদের আশেপাশে জঞ্জাল জমে, দূর্গন্ধ ছড়ায়, সাধারণ মানুষ নাক বাঁচিয়ে, চোখ বন্ধ করে তাদের পাশ কাটিয়ে চলে যায় মূর্তির প্রতি অবহেলাকে তীব্রভাবে আক্রমণ করেছেন সুনন্দ, “মালাটি শুকিয়ে কদাকার হয়ে ঝুলতে থাকে---মহামানবকে তখন গলায় বেড়ি পরা একটি পাগলের মতো দেখায়। শ্রদ্ধার নমুনা তো এই” মহামানবকে শ্রদ্ধা জানিয়ে তার মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে এরকম অবমাননা করা কখনওই কাঙ্ক্ষিত নয় তার চেয়ে ওই মূর্তি প্রতিষ্ঠা না করাই ভালো
    শুধু মূর্তি নয়, দেখা যায় মনীষীদের বাসস্থান কিংবা উল্লেখযোগ্য জায়গাগুলো এরকম অবহেলার শিকার হয় কখনও সেগুলো জঞ্জালে ঢাকা পড়ে যায়, আবার কখনও দেখা যায় অসাধু লোকেরা সেগুলোকে গ্রাস করে অপসংস্কৃতির এমন নমুনা দেখেও মানুষ চুপ করে থাকে সুনন্দর কথায়, “তারপর---কার মস্তিস্ক-তরঙ্গের ফলে জানি না, আবর্জনার বিকেন্দ্রীকরণ ঘটল তখন বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ল তারা রামমোহন রায়ের বাড়ির দেওয়াল ঘেঁষে তারা নব ভারতের স্রষ্টাকে বন্দনা করতে লাগল, সুরেন্দ্রনাথ কলেজকে সুরভিত করে বাণীপুজোর ধূপাধারে পরিণত হল, মধ্য এবং উত্তর কলকাতার অসংখ্য গলি এবং রাজপথকে অধিকার করে বিদেশী টিভিকে সাদর আমন্ত্রণ জানাতে লাগল শহরময় আবর্জনার এমন উপদ্রব দেখে সুনন্দরও ইচ্ছে করে প্রতিবাদ করতে তিনি বলেছেন, ...এই ঘেরাওয়ের যুগে সবাই মিলে গুটিকয়েক বাঘা বাঘা পৌরপিতাকে তাড়া করে আনি, তারপর সুরেন্দ্রনাথ কলেজের আবর্জনার স্তূপের ওপরে ঘন্টা আষ্টেক বসিয়ে রাখি কিন্তু মানুষের প্রতিবাদ করার ভাষা হারিয়ে গেছে পূর্বেই বলেছি প্রতিবাদ করতে গেলে টার্গেট হয়ে যাওয়ার ভয় আছে তাই চোখের সামনে আবর্জনার স্তূপ দেখে, তাদের দূর্গন্ধে অসহ্য হয়েও মানুষ চুপচাপ সব মেনে নেয় আসলে মানুষের সহ্যের ইমিউনিটি’ পাওয়ার বেড়ে গেছে তা বাড়াতেই হবে প্রতিবাদ করার সুযোগ আর সাহস না থাকলে নিজের অভিযোজন ঘটানোই বুদ্ধিমানের কাজ
    মনীষীদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের প্রশ্নে আরও একটা ব্যাপার এসে যায় আমরা দেখি বিভিন্ন মনীষীদের বাড়ি সরকার হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করে তার দেখভালের দায়িত্ব নেয় আবার দেখা যায় এমনই অনেক বাসস্থান অবহেলায় পড়ে থাকে কিংবা অসাধু ব্যক্তিদের খপ্পরে চলে যায় বিশেষ দিনে সেইসব বাসস্থানের ওপর হয়তো বা একটু সুনজর পড়ে তারপর আবার যেই কে সেই অবস্থা এরকম অবমাননা দেখে চুপ করে থাকতে পারেননি সুনন্দ রামমোহন রায়ের স্মৃতি সম্বলিত একটি বাড়ির এরকম অবহেলা দেখে তিনি প্রতিবাদ করে উঠেছেন আমার একটি স্পষ্ট সাজেসশন আছে, আপনারা দয়া করে অবধান করুন কী হবে এতসব বাজে খরচে? ১৯৭২ বা ৭৪---যখনই হোক, রামমোহন রায়ের জন্মদিনে দু-একটি কামান অথবা ক’টা ডিনামাইট আনা হোক বাড়িটি উড়িয়ে দেওয়া যাক, মালিটারী ব্যান্ডে জনগনমন বাজতে থাকুক এবং সেই শুভলগ্নে রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী বা যে কোনো ভি-আই-পি, ওই ধ্বংসস্তূপটি লোহাওয়ালাদের করমণ্ডলে অর্পণ করুক শিবমস্তু থুড়ি, ওঁ তৎ সৎ। এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন তার তীব্র প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে, অন্যদিকে মনীষীদের বাসস্থান নিয়ে যে অসাধু কার্যকলাপ সেগুলো তীব্রভাবে প্রকাশ পেয়ছে
    যে আলোচনা থেকে সরে এসে এই প্রসঙ্গে ঢুকে পড়া এবার সেখানে ফিরে যাওয়া যাক, অর্থাৎ উৎসব উৎসবকে কেন্দ্র করে তারস্বরে মাইক বাজানো, বোম্-ফটকা ফাটানো তো আছেই সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জলসা কিংবা অর্কেষ্ট্রা মানুষের অসুবিধার কথা মাথায় না রেখে রাত গভীর পর্যন্ত এসব চলতে থাকে। সে সমস্যা তো আছে, তার থেকেও বড়ো কথা জলসার নামে অপসংস্কৃতি সেখানে কখনও কখনও গান-বাজনার যে ছবি ফুটে ওঠে তা অত্যন্ত নিন্দনীয় কিছু কিছু ক্ষেত্রে আবার দেখা যায় সিনেমা কিংবা সিরিয়ালের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে মাতামাতি তাদের বেসুরো গলায় বিকৃত গানের মধ্যে জনতার উন্মাদনা, আবেগের অতিমাত্রিক বহিঃপ্রকাশ আমাদের সংস্কৃতির অধোগতিকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় আর সেইসব তথাকথিত অভিনেতা-অভিনেত্রী যারা সিনেমায় লিপ দিয়ে দর্শকদের বাহবা কুড়োন, বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে জনতার সম্মুখে দাঁড়িয়ে বেসুরো গলায় গানের পিণ্ডি চটকে দর্শক কিংবা শ্রোতাদের বাহবা আর হাততালি কুড়িয়ে অদ্ভুত আত্মতৃপ্তি লাভ করেন। এরমধ্যে তাদের কতখানি সংস্কৃতিবোধ বা চেতনা আছে সে নিয়ে প্রশ্ন উঠে যায় যা আমার কাজ নয়, যা আমার দ্বারা হবে না, মিথ্যে প্রশংসার লোভে তা করার প্রয়াস দেখলে তাদের ভেতরাকার দুর্বলতা প্রকট হয়ে ওঠে এই নিয়ে সুনন্দ বলেছেন, “চিত্রতারকা যদি ‘তাড়কা’র মতো গাইতে থাকেন---কী আসে যায়, চর্মচক্ষে তাঁকে দেখলেই তো মনে হয় ‘আমার জীবন পাত্র উচ্ছালিয়া’ (উঁহু, ও চলবে না---এ-সব আসরে রবীন্দ্রনাথ অচল) --- মানে হৃদয় একেবারে টইটুম্বুর!”
    চিত্রতারকার প্রসঙ্গ যখন উঠল তখন আর একটা কথা বলাই যায়। সেটা হল ফ্যাশান বাঙালী ফ্যাশান ভালোবাসে এক্ষেত্রে অনুকরণীয় হল চিত্রতারকা তারা যেটাই করে সেটাই ঠিকতাদেরকে অনুকরণ ও অনুসরণ করাটাই হচ্ছে জীবনের অন্যতম প্রধান কাজ সেটা নিজের ক্ষেত্রে কতখানি প্রযোজ্য কিংবা শোভন তা নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই সুনন্দর কথায়, “এখন চিত্রতারকাই শেষ কথা! তাঁরা যদি বাতাবি নেবু দিয়ে আন্ডার হ্যান্ড বল করেন এবং ব্যাটের মাথা পাকড়ে হাতল দিয়ে সেই নেবুর কুঁড়িটি পেটাবার চেষ্টা করেন তাহলে সেইটেই আদর্শ ক্রিকেট তাঁরা হাঁ করলেই গান---হাসলেই পুষ্পবৃষ্টি, কাশলেই মিউজিক, হাঁচলেই সেক্স
    সুনন্দ যতই রাগ করুন কিংবা প্রতিবাদ করুন, চিত্রতারকাকে নিয়ে মাতামাতি বেড়েছে বই কমেনি এখন আবার যোগ হয়েছে টেলি তারকা এখন পুজোর ফিতেকাটা থেকে পাড়ার জলসা, অতিথির আসনে এইসব টেলি অভিনেতা-অভিনেত্রীদের বেশ কদর তাঁরা মঞ্চ আলো করে বসেন কখনও কিছু বলেন, কখনও বা কেবল দর্শনের সুযোগ দিয়েই দর্শকদের ধন্য হওয়ার সুযোগ করে দেন গান-বাজনার অনুষ্ঠান হলে একটু-আধটু নাচ-গানের চেষ্টা করেন এককথায় এরকম অনুষ্ঠানে এসে তাঁরা নিজেরা ধন্য হওয়ার তৃপ্তি প্রকাশ করেন আর তাঁদের ধন্য হওয়াতে আমরাও ধন্য হই একেবারে ধন্য ধন্য ব্যাপার পড়ে যায় চারিদিকে
    বলতে গেলে অনেক কথা বলাই যায় কিন্তু সে সুযোগ এখানে নেই সামাজিক অবক্ষয় নিয়ে কথা হচ্ছিল তারই আর একটি দৃষ্টান্ত দিয়ে এই লেখা শেষ করব বেশ কয়েক বছর ধরে আমাদের দেশে একটা অভিযান চলছে, স্বচ্ছতা অভিযান সবকিছু পরিস্কারের মধ্যে আমাদের ঘরবাড়ি, কর্মক্ষেত্র, আশপাশের পরিবেশ যেমন পড়ে তেমনি করে যানবাহনকেও বাদ দেওয়া যায় না যাদের লোকাল ট্রেনে ভ্রমণ করার অভিজ্ঞতা আছে তাদের ট্রেনের কামকার অপরিচ্ছন্নতা সম্বন্ধে ভালোই অভিজ্ঞতা আছে মাসখানিক আগের একটি অভিজ্ঞতার কথা এখানে বলি বিকেলের হলদিয়া-হাওড়া লোকালে করে হাওড়া যাচ্ছি। জানালার ধারে বসেছি আমার উল্টোদিকে এক কমবয়সী দম্পতি তাদের কথার পাশাপাশি মুখও চলছিল যাই হোক, একটু পরে চা আসে আমি এককাপ চা নিই সেই ছেলেটিও নেয় চা খাওয়া শেষ হওয়ার পর আমি জানালা গলিয়ে কাপটি বাইরে ফেলে দিই ছেলেটি চা খাওয়ার পর সেটি তার পায়ের কাছে ফেলে দেয় তা দেখে তার স্ত্রী বোধহয় একটু চক্ষুলজ্জার খাতিয়ে তাকে বলে, তুমি কাপটা এখানে ফেললে কেন? জানালা দিয়ে বাইরে ফেলতে পারতে?” শুনে ছেলেটি একটু গম্ভীর হয়ে বলল, “বাইরে ফেললে নোংরা হবে কে পরিস্কার করবে? কিন্তু ট্রেনের কামরা পরিস্কার করার লোক আছে তাই এখানে ফেললে তা পরিস্কার হবে” শুনে আমি ভেতরে ভেতরে চমকে উঠলাম অস্বস্তিও করতে লাগল বাইরে কাপ ফেলে পরিবেশ নোংরা করার জন্য নিজেরই কেমন অপরাধবোধ হতে লাগল যাই হোক, সে প্রসঙ্গ একসময় ভুলে যাই হঠাৎ সুনন্দর জার্নাল পড়তে পড়তে চমকে উঠলাম ভাবলাম সেই ছেলেটিও কি সুনন্দর জার্নাল পড়েছে নাকি? ট্রেনের কামরা নোংরা করা অনেকের অভ্যাস চিপসের প্যাকেট, বাদামের খোসা, মুড়ির ঠোঙা কিংবা চায়ের কাপ এসব তারা কামরার মধ্যে জমা করে রাখে এই অভিজ্ঞতা সুনন্দর অনেক রয়েছে তাঁর মনে হয়েছে এইসব নোংরা কামরার মধ্যে জমা করার মাধ্যমে ওইসব তথাকথিত অভিযুক্ত ব্যক্তিরা আসলে একটা সামাজিক দায়িত্ব পালন করছে কেননা কামরা যদি অপরিচ্ছন্ন না হয়, তাহলে তা পরিস্কার করার প্রশ্ন ওঠে না তাহলে এই পেশায় যারা যুক্ত আছে তাদের কী হবে? কিছুটা ব্যাঙ্গের ছলে তিনি বলেছেন, “এইবারে আমার জ্ঞানোদয় হল গাড়িটা যদি আমরা পরিস্কার তকতকে রাখি, বাদামের খোসা, মুড়ি, শসার বাকল ছড়িয়ে না দিই, যদি খানিকটা জল না ঢালি, এক-আধটু পানের পিক না ফেলি, তাহলে রেলের লোকজনের করণীয় কী থাকে?”
    তাহলে একটা ব্যাপার এসে যাচ্ছে রেলের কামরা নোংরা করে লোকের কাজের নৈতিক দায়িত্ব পালন না হয় করা হল, কিন্তু কামরা অপিরচ্ছন্ন করে তা অস্বাস্থ্যকর করা নিশ্চয়ই ঠিক নয় আবার সেই ছেলেটির কথায়ও যুক্তি আছে জানালা দিয়ে বাইরে ফেললে তো পরিবেশ অপরিচ্ছন্ন হবে সেটাও করা উচিত নয় তাহলে কি এমন আইন করা উচিত, ট্রেনের কামরায় কোনো খাদ্য-পানীয় চলবে না? সেটা সম্ভব নয় এইসবের ওপর নির্ভর করে কত মানুষের সংসার চলছে তাদের কাজ কেড়ে নেওয়াটা অনৈতিক তাহলে কি এমন হওয়া উচিত, রেলের প্রতিটি কামরায় এক বা একাধিক ডাস্টবিন থাকবে মানুষ নোংরা তাতে ফেলবে জানিনা সেরকম কোনো প্রস্তাব সুনন্দর জার্নালে আছে কিনা তবে তা যদি চালুও হয় তাহলেও কি কামরাগুলি পরিস্কার থাকবে? কেননা আবর্জনা পরিস্কারকারী লোকেদের সেক্ষেত্রে পরিশ্রম অনেক কমে যাবে কেউ কম খেটে পারিশ্রমিক নেবে, এমন অনৈতিক কাজকে আমরা নিশ্চয়ই প্রশ্রয় দিতে পারি না তাই তেমন কিছু চালু হলেও যে সমস্যার সমাধান হবে বলে আমার মনে হয় না সুনন্দর তাঁর জার্নালে মানুষের এই নৈতিক দায়িত্ব প্রসঙ্গে বলেছেন, “বসে বসে তারা মাইনে নেবে, একবারমাত্র বুরুশ বুলিয়ে ডিউটি শেষ করবে---কোনো মানে হয় এর? .....তহলে সামাজিক মানুষ হিসেবে আমাদের প্রত্যেকেরই একটা নৈতিক দায়িত্ব দাঁড়িয়ে যাচ্ছে আমরা পরস্পরকে কাজ দিতে, তার কাজ বাড়িয়ে দিতে ন্যায়ত বাধ্য
    এইভাবে সুনন্দ তাঁর জার্নালে সামাজের নানান নেতিবাচক দিক তুলে ধরেছেন কঠোরভাবে আঘাত করেছেন তাঁর জার্নাল পড়তে পড়তে একটা ব্যাপার ভেবে আমাদের আশ্চর্য হতে হয়, কতখানি সমাজ সচেতন তিনি ছিলেন। বড়ো বড়ো সমস্যার পাশাপাশি তিনি অনেক সাধারণ সমস্যার সম্পর্কেও অবিহিত ছিলেন এখানেই তাঁর কৃতিত্ব পাশাপাশি কলমের সূক্ষ আঁচড়ে যেভাবে তিনি সেগুলোকে তুলে ধরেছেন তা এককথায় অসাধারণ এই করতে গিয়ে তার জার্নালের যাত্রাপথ যে সবসময় মসৃণ হয়নি এটাও বোঝা যায় কিন্তু থেমে থাকেননি তিনি প্রতিবাদ করে গেছেন আর এই প্রতিবাদের মাধ্যমে তিনি কেবল একজন লেখক নয়, একজন সমাজ সচেতন নাগরিক হিসেবে তাঁর দায়িত্ব পালন করে গেছেন এই জায়গায় তিনি অনন্য
  
(লেখাটি প্রাণনাথ শেঠ সম্পাদিত মেঘবল্লরী পত্রিকায় পূর্বে প্রকাশিত)

No comments:

Post a Comment