দুঃসময়ের পদ্মকুঁড়ি
শুভ্রাশ্রী মাইতি
‘পুরোনো পেঁচারা সব কোটরের থেকে
এসেছে বাহির হয়ে অন্ধকার দেখে
মাঠের মুখের 'পরে--'
---জীবনানন্দ দাশ।
অ্যাম্বুলেন্সের লাল আলো আর সাইরেনের শব্দ সবসময়ই আমাদের মনের কোথায় যেন একটা ভয়ের ছায়া ফেলে যায়। তবে বর্তমানে এই ভয়ের ছায়া তার চেহারাটা দীর্ঘ করতে করতে ক্রমশ গ্রাস করে নিচ্ছে আমাদের অস্তিত্ব, আমাদের এত দিনের চেনা জীবনকে। কখন যে কার সময় আসবে, লাল আলো সাইরেন বাজিয়ে কাকে যে কখন তুলে নিয়ে যাবে অচেনা এক দেশে, যেখান থেকে সবাই ফিরতে পারে না---এই এক ভয় ক্রমশঃ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরছে আমাদের। একটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভাইরাস আজ প্রায় আট মাস যাবৎ তাবৎ পৃথিবীকে তার সমস্ত সভ্যতা আর বিজ্ঞানের অহংকার আর অগ্রগতি সমেত এমন ভাবে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে যে, আমরা বুঝতে পেরেছি প্রকৃতির কাছে মানুষ কত অসহায়। দিন প্রতিদিন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকা মৃত্যুতালিকা আমাদের ক্রমশ দুর্বল করে তুলছে মানসিকভাবে। মেঘনাদের মতো আড়ালে থেকে যুদ্ধ করা এই ভয়ংকর ভাইরাসটির সাথে অসম যুদ্ধে আমরা আজ প্রায় অসহায় কারণ এখনও হাতে আসেনি কোনো প্রতিষেধক। তাই আমাদের মানতে হচ্ছে এই গৃহবন্দী দশা। ভেঙে পড়েছে অর্থনীতি ব্যবস্হা। মেনে চলতে হচ্ছে হাজার রকম প্রতিরোধক নিয়ম। সুস্হও হচ্ছে অনেকে। তবু মৃত্যুমিছিলের বিরাট বহর আর জানা অজানা তথ্য আর বিধিনিষেধের বেড়াজালে মানুষ আজ বিভ্রান্ত।
দীর্ঘ গৃহবন্দীত্বে অবসাদগ্রস্ত,ভীত,বিভ্রান্ত আমরা এই দুঃসময়কে চিহ্নিত করছি বিভিন্ন তকমায়--বিপন্ন সময়, অসময়, বৈরী সময়, নষ্ট সময় ইত্যাদি। কিন্তু ভালো করে ভেবে দেখুন তো, এই সময় কি শুধুই বৈরীতা বা নষ্ট মানসিকতা সঞ্চার করছে আমাদের মনে, নাকি পাঁকের মধ্যেও যেমন পদ্ম ফোটে আপন সৌন্দর্যে, আপন গরিমায়, ঠিক তেমনই এই বৈরী সময়ের পঙ্কিল আবর্তের মাঝেও কোথাও না কোথাও, কোনো না কোনো সময়ে ফুটে চলেছে পদ্মকুঁড়ি হৃদসরোবর আলো করে। অন্য কিছু করার যখন কোনো উপায় নেই, তখন আসুন না সেই সুরভিত পদ্মকুঁড়ির আঘ্রাণ করি নিভৃতে, নিজস্ব অন্ধকারে---
“পথের বাঁকে কী ভয় বা বরাভয় অপেক্ষায়
তা অজানিত বলে
আলোক সন্ধানে বেরোনোর আগে
নিজস্ব অন্ধকারের কাছে নতজানু হই।” (কবি তাপস বৈদ্য।)
পদ্মকুঁড়ি (১)---মোবাইল বা ল্যাপটপের এলইডি স্ক্রিন ছেড়ে একটু চলে যান ছাদ বা বারান্দায়। সব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে খোলা আকাশের দিকে তাকান দুচোখ মেলে। এমন নয়নাভিরাম নীলিমা আপনি কতদিন আগে, কোথায় দেখেছেন, মনে করতে পারবেন কি চেষ্টা করে! লকডাউনের কারণে সারা পৃথিবীব্যাপী কলকারখানা বা পরিবহন বন্ধের প্রত্যক্ষ ফল হল এই এক পৃথিবী সুনীল আকাশ। শুধু কি তাই, বাতাস এখন অনেক কার্বন-ডাই-অক্সাইড মুক্ত, নদীর জলও অনেক আবর্জনা মুক্ত হয়ে বেগবতী স্রোতস্বিনী। যন্ত্রনির্ভর সভ্যতার প্রত্যক্ষ ফল হিসাবে যেভাবে দূষণ থাবা গেড়ে বসেছিল বহাল তবিয়তে, তাতে এমন নীল আকাশ, এমন টলটলে নদী দেখার সৌভাগ্য হত কি আমাদের লকডাউন ছাড়া! কারণ---
“একটা বড়ো মাঠ
একটা বিশাল সমুদ্র
এক আকাশ ভালোবাসা,অনেক উঁচুতে নিয়ে যায়।" (কবি শিশিরকুমার বাগ।)
পদ্মকুঁড়ি (২)---মানুষের গৃহবন্দী অবস্হা প্রকৃতির বুকে নতুন করে ফিরিয়ে এনেছে অরণ্যের শান্ত নির্জনতা। তাই পথ ভুলে কখনও কখনও প্রকাশ্য রাজপথেই নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে হরিণ, বানর, ময়ূর প্রভৃতি নিরীহ বন্যপ্রাণীগুলি। অভিমানী বিলুপ্তপ্রায় অলিভ রিডলে আবার এসে ডিম পেড়ে যাচ্ছে নির্জন বেলাভূমিতে। ফিরে আসছে আরও অনেক পশুপাখি যারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল এই আধুনিক সভ্য পৃথিবী থেকে। ফিরে আসছে আবার সেই আদি অকৃত্রিম স্নেহময়ী মাতৃরূপা পৃথিবী। এও তো লকডাউনেরই দান। কবি শ্যামলকান্তি দাশের কথায় বলা যায়---
“ছোট ছোট মাতৃহারা মানুষ রাস্তায় হাঁটছে
গায়ে পড়ছে ছোট ছোট ধান দুব্বার আলো
মাথায় খসে পড়ছে ছোট ছোট সুপুরি,আধময়লা হরিতকী
ছোট ছোট অক্ষরে সম্পূর্ণ হল কথা ও কাহিনী।”
পদ্মকুঁড়ি (৩)---এই করোনা ভাইরাসের ভয় মানুষকে আবার সচেতন করে তুলেছে স্বাস্হ্যবিধি সম্বন্ধে।বহু প্রাচীন কাল থেকেই আমাদের শাস্ত্রগুলিতে এমন অনেক অবশ্যপালনীয় আচারবিধি ধর্মের মোড়কে উপস্হিত ছিল মানুষকে সুস্হ, সুন্দর জীবনযাপনে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে। পরবর্তীকালে আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত মানুষ হিসাবে তার বহুলাংশই নস্যাৎ করেছি আমরা। কিন্তু বর্তমান পরিস্হিতি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল তার উপযোগিতা। নিজেদের সভ্যতা, সংস্কৃতির প্রতি এই বিশ্বাস কিন্তু কম পাওয়া নয়। এর ফলস্বরূপ মানুষ স্বেচ্ছায় ঝুঁকেছে যোগাভ্যাসের মাধ্যমে শরীরে রোগ প্রতিষেধক ক্ষমতা বাড়াতে, স্বাস্হ্য পুনরুদ্ধারে। এটা এই অসময়ের বিরাট প্রাপ্তি।
তাছাড়া গৃহকাজে সাহায্যকারীর অনুপস্হিতি মানুষকে শিখিয়েছে নিজের পায়ে দাঁড়াতে, আত্মনির্ভর হতে। এ-হল লকডাউনের সব থেকে বড় প্রাপ্তি। কবি সৌরভকুমার ভূঞ্যার কবিতার দুটি পংক্তি এখানে উল্লেখযোগ্য---
“জীবনের খন্ড খন্ড অধ্যায়কে ঘিরে রাখে সার্থকতার আলো।
এভাবে প্রতিটি ঈশ্বর-প্রহর পেরিয়ে
সৃষ্টি হয় নবজন্মের কাহিনী।"
পদ্মকুঁড়ি (৪)---তিন্নি এখন মহাখুশি। রোজগেরে বাবা মায়ের তুমুল ব্যস্ততায় তার ছোট্ট জীবনটা আয়ামাসির শাসনগণ্ডীতে কেমন ফিকে আর বেরঙিন হয়ে উঠছিল দিন দিন। আর এখন লকডাউনের জন্য মা আর বাবাকে সবসময় পাশে পেয়ে তার আনন্দ আর ধরে না।
বড় একাকীত্বে ভুগত সুজাতা ইদানীং। স্বামীর বাড়তে থাকা ব্যস্ততার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল তার চোরা অভিমানের পাহাড়টিও। লকডাউনের এই অক্লান্ত অবসর কখন যেন ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে সেই চোরা পাহাড়টাকে।সুজাতার মুখে আজ ঝলমলে হাসি।
এরকম আরও অনেক টুকরো, টুকরো ঘটনা সাজালে একটা ব্যাপার পরিস্কার হয়ে যায় যে, ক্রমাগত সিঁড়ি ভাঙার খেলায় ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, বিচ্ছিন্ন ‘আমি' দ্বীপগুলোর ভেতর তৈরি হচ্ছে স্নেহ, ভালবাসার অজস্র প্রণালী যার ভেতর দিয়ে কলকল করে বয়ে চলেছে সম্পর্ক-স্রোতের স্বচ্ছ স্রোতধারা। এই আশ্চর্য উত্তরণ কিন্তু লকডাউনেরই উপহার। কারণ---
“প্রতিটি সম্পর্ক কবিতা,বুঝতে পারলে জেগে ওঠে
ছন্দ-তাল-লয়,না পারলে দুর্বোধ্য, দহন বলয়!
(কবি শুভঙ্কর দাস।)
পদ্মকুঁড়ি (৫)---করোনাকালীন কঠিন পরিস্হিতি আমাদের সামনে তুলে ধরেছে কিছু মানবিক মুখ--যে মুখের ছায়ায় সময় অসময়ে মানুষের মুখোশ ছিঁড়ে উঁকি দিয়েছে ঈশ্বরের আপন মুখ। কোভিড শত্রুর বিরূদ্ধে প্রথম সারিতে লড়াই করতে নামা অসংখ্য ডাক্তার, নার্স বা স্বাস্হ্যকর্মী, উর্দিধারী সিভিক ভলানটিয়ার বা পুলিশ প্রশাসন, ভ্যাকসিন প্রস্তুতির গবেষণায় ব্যাপৃত থাকা গবেষক ও বিজ্ঞানীমহল, ভ্যাকসিন প্রয়োগের পরীক্ষামূলক স্তরে নিজের জীবন বিপন্ন করে নাম লেখানো নিবেদিত প্রাণ মানুষজন, জরুরি পরিষেবায় রত কর্মীরা, অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে বন্ধ হওয়া স্কুল আর ছাত্রছাত্রীদের সুকুমার মনগুলির সাথে সংযোগ রক্ষাকারী শিক্ষকমহল--এঁরা সবাই সেই ঈশ্বরের আপন মুখ। না, এই মুখগুলির মাথার পেছনে নেই কোন আলোর বলয়, শরীরের কোথাও আঁকা নেই কোন ধর্মচিহ্ন, হাতে ধরা নেই কোন রঙের নিশান, তাও স্বার্থসর্বস্বতার অন্ধকার গন্ডী ছাড়িয়ে তাঁরা পৌছে গেছেন এক আলোকিত আশ্চর্য বৃত্তে। ভাবুন তো, মানবতার এহেন উত্তরণ যে সময়ের প্রেক্ষাপটে, তাকে বৈরীসময় বলা যায় কিনা!
“দিন রাতের যুদ্ধ শেষে
অবশেষে পাই উত্তর
ঈশ্বরের বাগানে ফুল ফোটে না
ফুলের বাগানে ফোটে ঈশ্বর।" (কবি প্রাণনাথ শেঠ।)
পদ্মকুঁড়ি (৬)---লকডাউন আমাদের দেখিয়েছে অনেক অচেনা ছবি--রেশনের দোকানে দীর্ঘ লাইন, পরিযায়ী শ্রমিকের ঘামে ভেজা ঘরমুখী মিছিল, ক্লান্ত পা আর ঘর্মাক্ত মুখের প্রতিটি ভাঁজে বাড়ি ফেরার অনন্ত আকুতি, চাকরি ছাঁটাই, কর্মহীনতা আরও কত কি! কিন্তু এত বেদন, এত অন্ধকার পেরিয়েও মানুষ মৃত্যুকে উপেক্ষা করে হেঁটে চলেছে জীবনের দিকে। আসন্নপ্রসবা মা নবজাতককে পথেই জন্ম দিয়ে আবার শুরু করেছে পথ চলা, কোলের শিশুকে টানা সুটকেসের ওপর বসিয়ে টেনে নিয়ে চলেছে অসহায় মা, কর্মহীন পঙ্গু সংসারকে নিজের পায়ে দাঁড় করাতে আঁশবটি আর মাছের ঝুড়ি মাথায় বেরিয়ে পড়েছে এমএ পাশ বেকার যুবক, রোজগারহীন কন্ঠী গায়িকা কেক-বিস্কুটের দোকান সাজিয়ে বসে পড়েছে ফুটপাতের সীমানায়, চাকরি হারানো বাবাকে ভরসা দিতে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে ডটপেনের হকারি করতে বেরিয়েছে বারো ক্লাসের ছেলে--এমন কত উদাহরণ। দুঃসময়ের কাছে হার না মেনে ছাইয়ের ভেতর থেকে আবার আগুন হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার এই উত্তরণ শিক্ষাই তো দুঃসময়ের মহাদান। কবি মোহিনীমোহন গঙ্গোপাধ্যায়ের অবিস্মরণীয় উক্তি এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়---
“স্বক্ষেত্রে স্বরাট আমি কবিতার সুখী যুবরাজ
মৃত্যুকে দুপায় পিষে আগুনে আগুনে হাঁটি আজ।"
পদ্মকুঁড়ি (৭)---লকডাউন দেখিয়েছে অনেক অন্ধকার স্বার্থের গলিঘুঁজি পেরিয়েও একটা গোটা দেশ, একটা গোটা জাতি কিভাবে এক হয়ে উঠতে পারে দুঃসময়ে, কিভাবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে গড়ে তুলতে পারে সচেতন প্রতিরোধ। ডাক্তারদের নিঃস্বার্থ সেবাকে অভিবাদন জানাতে একসাথে করতালিতে মুখরিত হয়ে ওঠা, প্রদীপের আলোয় আলোকসজ্জা রচনা করা, মাইক্রোফোন হাতে চৌরাস্তার মোড়ে পুলিশ কর্মীর ‘উই শ্যাল ওভারকাম' গান, অন্নহীন মানুষদের কাছে খাবার পৌছানো, নিজের ঘরের আরামের বিছানা ছেড়ে রাস্তাকে বিছানা করে কঠোর দায়িত্বপালন, পরিবার পরিজন ছেড়ে দিনের পর দিন ভালবাসার কর্তব্যপালন---এরকম বহু নিদর্শন আবার একবার প্রমাণ করেছে মানুষ এখনও মান আর হুঁশ হারায়নি। এই অন্ধকার সময় আমাদের আবার দেখিয়ে দিল, আমরাও পারি বিপদের দিনে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে। এটা কি কম বড় পাওয়া! পাশে থাকার এই আশ্বাসটুকু চোখে জল আনে আনন্দে,মনে বল আনে ভরসায়।
“মানুষের মধ্যে জেগে উঠে চেতনা
আগুনের ভিতর দিয়ে হাঁটছে
রক্তিম-মানুষ জাপটে ধরছে বিপন্ন সময়
একমাত্র নীল আকাশ অপার মন..." (গোবিন্দ বারিক।)
পদ্মকুঁড়ি (৮)---এই গৃহবন্দী দশার আর একটি আলোর দিক হল সৃজনশীলতার দিক। অবসরের সময় বেশি পাওয়ায় এবং বাইরের জানালাগুলো বন্ধ হওয়ায় মানুষ স্বেচ্ছায় খুলতে শুরু করেছে ভেতরের জানালাগুলো। সৃজনশীলতা আর নান্দনিকতার খোলা হাওয়ায় শ্বাস নিতে পেরে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে মানুষ। এগজিকিউটিভ রজতবাবু ওয়ার্ক ফ্রম হোমের পাশাপাশি পড়ে শেষ করেছেন দু দুটো উপন্যাস। কৈশোর যৌবনের হারানো নেশাটা আবার ফিরে পেয়ে তাঁর পঞ্চাশোর্ধ গম্ভীর মুখে আজ জ্বলজ্বলে আলোর হাসি। ওপাড়ার মিনুবৌদি যে এত সুন্দর গান গাইতে জানেন তা জানাই হত না, লকডাউন না হলে, কেমন সুন্দর গান গাইলেন বাইশে শ্রাবণের ফেসবুক পোস্টে। সত্তরোর্ধ প্রভাদেবী নাতনির পাল্লায় পড়ে গল্প লিখে পোস্ট করতে শুরু করেছেন সোসাল মিডিয়ায়। তাঁর ফলোয়ারের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। এমনই নানান রঙ-বেরঙের আলোর কাজে ভরে উঠছে মুখবই-এর দেওয়াল। কার কতটা আলো, বা কার আঁধার কতটা বেশি, এ-নিয়ে তর্কে না গিয়ে এই বাড়তি আসা আলো হাওয়াটুকুকেই যদি এমন বদ্ধ দিনের ঘরে খেলতে দেই অবাধে, তাহলে ক্ষতি কি! নিজেকে ভাল রাখতে শেখা, এ বোধহয় লকডাউনের আগে তেমন করে আমরা শিখিনি কখনো। এই প্রসঙ্গে কবি আশিস মিশ্রের ভাষায় বলা যায়---
“ডেকে যায়,দেখে যায়,ফিরবে কিভাবে?
ওসব ভেবো না তুমি,মনের বিভাবে---
যে লেখা হয়েছে আজ, তার কথা বলো,
যে লেখা হয়নি কিছু,তার কাছে চলো।"
আমাদের বর্তমান গৃহবন্দী দশা মনে করিয়ে দেয় রবিঠাকুরের সেই বিখ্যাত ‘ডাকঘর' নাটকের কথা। আজ এই বৃহৎ নাট্যমঞ্চে আমরা সবাই যেন সেই ডাকঘরের অমল--যার কাছে তার খোলা জানালাটাই বাইরের রোদ-জল-হাওয়ার মুক্ত পৃথিবী। আমরা সবাই সেই খোলা জানালার গরাদ ধরে তাকিয়ে আছি পথের দিকে---কবে আসবে রাজার চিঠি। এই চিঠিটুকুর অমল প্রতীক্ষা মুছে দিয়েছিল অমলের বেরঙিন জীবনের সবটুকু একঘেয়েমি বিবর্ণতা। প্রজাপতির পাতলা ডানার অমল আলোয় মুড়ে দিয়েছিল জীবনের সমস্ত অন্ধকার বিষণ্নতা। আজকের এই আঁধার সময়টুকুতেও যেন আমরা আমাদের মধ্যে জ্বেলে দিতে পারি সেই প্রতীক্ষার অমল আলো---যে আলোয় সহস্র পদ্মকুঁড়ি ফুল হয়ে জেগে ওঠে ভোরে, যে আলোয় প্রতীক্ষার শেষে আঁকা থাকে একটা সবুজ ঘাসের মাঠ,একটা নরম জলের নদী আর একটা রামধনু রঙা আকাশ। পূব দিগন্ত লালে লাল---নতুন আশার সূর্য এবার উঠবেই সেখানে,নতুন দিনের আলো মেখে, জীবনকে ভালোবেসে---
চারিদিকে এখন সকাল---
রোদের নরম রং শিশুর গালের মতো লাল;
মাঠের ঘাসের 'পরে শৈশবের ঘ্রাণ---
(জীবনানন্দ দাশ)
No comments:
Post a Comment