একটি জানালা ও সবুজ পৃথিবী
অরুণিমা
এই আমাদের পাহাড়তলীর গ্রামের সবুজ
এই আমাদের পাহাড়ি পাখির গানের আসর,
এই আমাদের 'হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা'
এই আমাদের রান্নাঘরের ছোট্ট জানালা।
হ্যাঁ, রান্নাঘরের ছোট্ট জানালা অথবা এই অসুখকালীন সময়ের বেড়াতে যাবার জায়গা। নাকি বলা ভালো হারিয়ে যাবার জায়গা। একফালি সবুজ ঘেরা জঙ্গল, যাকে ঘিরে রেখেছে ক্রমশ গ্রাস করতে থাকা ইঁট কাঠ পাথরের বাড়িঘর। তবু যতদিন আছে, এ ঘিরে রেখেছে আমাদের বাড়ি। সবুজ ঘেরা এই জঙ্গল, এর পাতায় ঝিলিক দেওয়া রোদ্দুর, অথবা এর বৃষ্টিভেজা পাতা সময় বিশেষে এই আমাদের চোখের আরাম, উষ্ণতার ভরসা, বর্ষার স্নিগ্ধতা। এসবের সাথে উপরি পাওনা হল নানারকম পাখিদের আনাগোনা। কাঠঠোকরা, বৌ কথা কউ, ছাতারে, ঘুঘু, কোকিল, টিয়া, পায়রা, বাঁশপাতি আরও কত কি। আরও আছে কাঠবেড়ালি দম্পতির খুনসুটি। ওরা থাকে বড় বাদাম গাছটাতে। অনেকটা মহিমা বিস্তার করে দাঁড়িয়ে থাকা গাছটার ঝোপঝাড়ে, উঁচু ডালে খুব স্পষ্ট দেখা যেত না ওদের। আমফানের প্রাকৃতিক দুর্যোগে গাছটা পড়ে যাওয়ার পর থেকে পাখি আর কাঠবেড়ালি এদের কার্য্যকলাপ বেশি ভাল করে চোখে পড়ে। এখন তো গাছটা আধশোয়া হয়ে আছে ডালপালা বিছিয়ে, তাই মাটির অনেকটা কাছাকাছি দিয়ে ওদের আনাগোনা চলতে থাকে। সাথে ওদের ছোটাছুটি আর খেলার জায়গাটাও অনেকটা প্রশস্ত হয়েছে।
অবশ্য ঝড়ের পরদিন সকালে যখন দেখলাম ওই অতবড় গাছটা ভেঙে গেছে, আর একটা কাঠবেড়ালী খানিকটা দিশাহারা হয়ে নাকি খুব ব্যস্ত হয়ে ঘুরছে, তখন মন ভাঙল আমাদেরও। এতবড় আশ্রয়টা কাল ছিল আজ নেই, ভাবতেই বুকে মোচড় দিয়ে কান্না পেয়েছিল। ভেঙে পড়ার পরও তো তখনও সবুজে সবুজ হয়ে ছিল ওর সারা শরীর। এদেরই একে একে ধূসর হয়ে যাওয়া দেখতে হবে আমাদের সেটা ভেবে আমরা খুঁজছিলাম একটা আড়াল। আড়াল - এই ধ্বংস থেকে বাঁচার, আড়াল এই বিবর্ণতা চোখে না দেখার, আড়াল এই শুকিয়ে যেতে থাকা প্রাণহীনতা থেকে বাঁচার।
কিন্তু না। ধীরে ধীরে যেন নতুন করে আশ্চর্য প্রাণসঞ্চার হল ওই গাছটার। কাঠবেড়ালী বৌকে দেখে ডেকে উঠল বউ কথা কউ পাখি। কাঠঠোকরাটা ঠুকরে ঠুকরে বানাতে শুরু করল ওর নতুন বাসা। একটু একটু বিবর্ণতার সাক্ষী হওয়া থেকে বেঁচে গেলাম আমরা, বেঁচে গেল বাদাম গাছটা। আধশোয়া অবস্থাতেই কি চমৎকার নতুন পাতা গজাল, নতুন করে বৃষ্টি এল, ধুয়ে গেল লেগে থাকা সব ধুলো আর মলিনতা।
আমফান পরবর্তী সময়ে আরও অন্য কত জায়গা থেকে এসে জুটল একদল চড়ুই, ছোপছোপওলা ঘুঘু দম্পতি। বসন্ত বৌরির ঘরে জন্ম নিল একটা ফুটফুটে মিষ্টি বাচ্ছা। ফিঙের ঘরে নতুন বাচ্চাদুটো তাদের বাবা মায়ের মতই কলহপ্রিয় ও সদাসতর্ক। এমনকি তাদের চাইতে বড় আকারের পাখির সাথে লড়াইয়ে নামতেও তারা মোটেও ভয় পায়না। বিনা যুদ্ধে তাদের আশেপাশে কাওকে ঘেঁষতে দেয় না তারা। ঝড় পরবর্তী সময়ে হয়ত অনেক জায়গায় বাসা হারানো পাখিরাই নতুন করে খুঁজে নিয়েছে এই আশ্রয়, তাই সংখ্যায় বেড়ে গেছে অনেক। ওদের কোলাহল, গান, ঝগড়া, অস্তিত্বের লড়াই আমাদের এই জায়গাটাকে মুখর করে রাখে। আমাদের থেমে থাকা অনুভূতি, থেমে থাকা জীবনের বিপরীতে মনে হয় এইতো প্রাণের স্পর্শ। তাই রান্নাঘরের কাজের ফাঁকেই হারিয়ে যাই ওদের জীবনে।
পৃথিবীর অসুখ এখনো সারেনি। সেই অসুখ প্রভাব ফেলছে মানুষের মনে, সম্পর্কে। দূরত্ব বাড়লে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আন্তরিকতা রাখতে মানুষ পারে না, পারে না সুখ দুঃখ ভাগ করে নিতেও। একটা বড় গাছে কত ছোট ছোট কুঠুরি বানিয়ে থাকে কতরকম পাখি। আমরাও তৈরী করি মনের ভেতর এমন এক একটা কুঠুরি আর রচনা করি অনেকগুলো বৃত্ত। কিন্তু সেসব আশ্রয় নয় , সেসব হল হিসেবে নিকেশের বৃত্ত। সেইসব বৃত্ত পথে কুঠুরিরা ঘুরতে থাকে অনেকটা সৌরমণ্ডলের মত। আর সময়ে সময়ে আমরা মেতে উঠি আকর্ষণ বিকর্ষণের খেলায়। আর জায়গা বদল করতে থাকি বৃত্তের, ভিতর থেকে বাইরে, বাইরে থেকে ভিতরে।
এইসব মনে হওয়ার ভারাক্রান্ত দিনে চোখ চলে যায় ওদের পৃথিবীতে। এই তো এক ফালি জমি, এক টুকরো সবুজ পৃথিবী, আজও সুন্দর ওদের কাছে, অসুখ স্পর্শ করে না ওদের। হারানো আর নতুন করে পাওয়ার লড়াই শুরু করাকেই ওরা একমাত্র নিশ্চিত বলে জানে। চিরস্থায়ী নিরাপত্তা হারানোর আশংকা গ্রাস করে থাকেনা ওদের প্রতিদিনের জীবনধারণকে। হারানোকে ওরা নতুন করে শুরু করার সময় বলেই হয়ত জানে। তাই ওদের সাথে হারিয়ে যাই এই টুকরো পৃথিবীটাতে, ফিরে আসি নিয়ে ব্যাথার মলম, মাটির ঘ্রান আর আমাদের পৃথিবীকে নতুন করে ফিরে পাবার এক টুকরো আশা নিয়ে চোখ রাখি আকাশে।
No comments:
Post a Comment