কর্তব্য
সুমনা মন্ডল
কাল রাত থেকেই সিমন্তীর মাথাটা খুব ভারি হয়ে আছে। গত পাঁচদিন এত চাপ যাচ্ছে যে ঠিকমতো ঘুমানোর সময়টুকুও পাচ্ছে না ও। গতকাল তো প্রায় সারারাত জেগেই ডিউটি করেছে। তাই শরীরটা সকাল থেকেই খুব ম্যাজম্যাজ করছে। ছেলেটারও গত চারদিন ধরে বড্ড সর্দি-কাশি, ঘুষঘুষে জ্বরও রয়েছে। পেশেন্টের চাপে নিজের ছেলেটাকেই ঠিকমতো সময়ও দিতে পারছে না সিমন্তী। ভাগ্যিস রনিতার মতো একজনকে ছেলের দেখাশোনার জন্য পেয়েছিল, নাহলে কি যে হতো...। আগে তবুও অনেকটা সময় দিতে পারত ছেলেকে কিন্তু এই মুহূর্তে একজন ডাক্তার হিসাবে পেশেন্টদের সুস্থ করে তোলাই ওর প্রধান দায়িত্ব। তাই ছেলেটা অসুস্থ জেনেও বাড়িতে থাকতে পারছেনা ও। চেন্নাইতে একটা মেডিক্যাল কনফারেন্সে গিয়ে লকডাউনে আটকে পড়ায় এই সময় স্বামীকেও পাশে পাচ্ছে না। তবে রনিতা থাকায় ওর ভরসায় চার বছরের ছেলে ঋজুকে রেখে নিশ্চিতে ডিউটি করতে পারছে সিমন্তী। কিন্তু আজ সকাল থেকে ঋজু একদম মাকে ছাড়তে চাইছে না।
'মা আজকে আমার কাছে থাকোনা মা' এই বলে সিমন্তীর কোলে মাথা গুঁজে দেয় ঋজু। সিমন্তীরও আজ যাওয়ার একদম ইচ্ছে নেই। ছেলেটা এত অসুস্থ। কি করে ওকে রেখে যাবে! কিন্তু হসপিটাল থেকে বারবার ফোন আসছে। পেশেন্টের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। কাল রাতে দুজন পেশেন্ট প্রবল শ্বাসকষ্টে মারা গেছে। নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে সিমন্তীর।
'বাবু তুমি একটু রনিতা আন্টির কাছে থাকো আমি দুপুরের মধ্যে ফিরে আসব সোনা' এই বলে ছেলেকে আশ্বস্ত করে ডিউটি বেরোয় সিমন্তী কিন্তু মনটা ঋজুর কাছেই পরে থাকে। সকাল এগারোটা নাগাদ হসপিটালে ঢুকেই আঁতকে ওঠে ও। প্রায় একশোজন পেশেন্ট অ্যাডমিট হয়েছে কাল রাত থেকে আজ পর্যন্ত। তার মধ্যে একটা পাঁচ বছরের বাচ্চাও আছে তার অবস্থা খুব সিরিয়াস। পিপিই পরেই সিমন্তী প্রথমেই তার কাছে যায়। কাশি আর ভীষণ শ্বাসকষ্টে ছটফট করছে ছেলেটা। মুহূর্তে হৃৎস্পদন বেড়ে যায় সিমন্তীর। ওদিকে ঋজুরও তো জ্বর জ্বর ভাব তাহলে কি ঋজুরও পসিটিভ...না না আর কিচ্ছু ভাবতে পারছে না সিমন্তী। হসপিটালের বাচ্চাটির সাময়িক চিকিৎসা করে বাড়ি ফিরে যায় সিমন্তী। আজই ঋজুর টেস্টের ব্যবস্থা করতে হবে। যথারীতি টেস্টের ব্যবস্থা হয় কিন্তু রিপোর্ট আসতে অন্তত দুটো দিন তো লাগবেই। ভারাক্রান্ত মন নিয়েও নিরূপায় হয়ে রনিতার ভরসাতেই ছেলেকে রেখে পেশেন্টদের চিকিৎসা চালিয়ে যায় সিমন্তী কারণ ও না গেলে যে অ্যাডমিট হওয়া বাচ্চাটাকে বাঁচানো যাবে না। ও প্রাণপনে চেষ্টা করছে বাচ্চাটাকে বাঁচানোর। তিনদিন পর, ঠিক রাত দশটা ঋজুকে খাবার খাওয়াচ্ছে সিমন্তী এমন সময় হসপিটাল থেকে ফোন আসে। ডা. সুজিত জানান বাচ্চাটি আউট অফ ডেঞ্জার। কিছুটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে সিমন্তী। পরেরদিন সকালে যথারীতি হসপিটালে পৌঁছেই ঋজুর রিপোর্টটা দেখতে যায় ও। রিপোর্ট পসিটিভ কিন্তু সিমন্তী একদম উতলা হয়নি কারণ ও ছেলে ঋজুকে অবহেলা করতে পারে কিন্তু পেসেন্ট ঋজুকে নয়।
No comments:
Post a Comment