Monday, September 28, 2020

আলোর দিশারী : পাই নাঘাকালিয়ানী - সৌরভকুমার ভূঞ্যা

আলোর দিশারী : পাই নাঘাকালিয়ানী

সৌরভকুমার ভূঞ্যা

 

‘বার্ধক্যের বিলাপ!’... মায়ের কথা শোনার পর প্রথমটা কি তার এমনটাই মনে হয়েছিল? জানা নেই তবে তিনি যে একটু অবাক হয়েছিলেন এটা অনুমান করা যায় অবাক হওয়াটাই স্বাভাবিক ৯৫ বছরের কোনো বৃদ্ধা যদি বলেন সারা দেশে যে ভয়াবহ যুদ্ধ চলছে তাতে তিনি অংশগ্রহন করতে চান, দেশের মানুষের জন্য কিছু করতে চান, তাহলে প্রথমেই মনে হবে এ-তার বার্ধক্যের বিলাপ ছাড়া কিছু নয় কিন্তু সদিচ্ছা আর মানসিক জোর থাকলে বয়সের বাধা এড়িয়েও যে কাজ করা যায় সেটা তিনি দেখিয়েছেন বিশ্বাত্রাস করোনা-যুদ্ধে নিজেকে সামিল করেছেন একজন করোনা যোদ্ধা হিসেবে তিনি পাই নাঘাকালিয়ানী

    পাই নাঘাকালিয়ানী কোনো বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব নন মিজোরামের এক অখ্যাত গ্রামে তার বাস তাঁর স্বামী পিউ লালরানলিয়ানা ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে কেন্দ্রশাসিত মিজোরামের বিধায়ক ছিলেন। ১৯৭৮-এ তিনি মারা যান তাদের সাত সন্তান বর্তমানে তিনি তার ছোটো ছেলে আইজল দরপিউয়ের কাছে থাকেন তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দেখেছেন যুদ্ধের ভয়াবহতা কি তার তার ভালোভাবেই জানা রাজ্যের অস্থিতিশীলতা, উপজাতি মানুষদের কষ্ট এসব তিনি দেখেছেন দীর্ঘ জীবনে বহু বেদনাদায়ক ঘটনার স্বাক্ষী তিনি কিন্তু বর্তমানে বিশ্বের পাশাপাশি আমাদের দেশও যে ভয়ংকর ভয়াবহ অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, এমনটা তিনি কোনোদিন দেখেননি যে অবস্থা দেখে তিনিও শিউরে উঠেছেন

    বিশ্ব কাঁপিয়ে আমাদের দেশেও তখন করোনা থাবা বসাতে শুরু করেছে একটু একটু করে তার প্রকোপ বাড়তে থাকে দিন দিন আক্রান্ত আর মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে থাকে এ-এক যুদ্ধ অদৃশ্য শক্তির বিরুদ্ধে অসম লড়াই সেই যুদ্ধে দেশের মানুষকে নিজের নিজের মতো করে সামিল হওয়ার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে রাজ্যের প্রধানরা আবেদন করেন দেশের এই সংকটময় পরিস্থিতিতে যে যার মতো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে চিকিৎসক, নার্স, পুলিশ প্রশাসন থেকে শুরু করে বহু মানুষ সামনে দাঁড়িয়ে এই যুদ্ধে লড়াই করে চলেছেন লক্ষ লক্ষ মানুষ সাযাহ্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন

    দেশের এমন সংকটময় পরিস্থিতিতে স্থির থাকতে পারেন না নাঘাকালিয়ানী মনের মধ্যে একটা তাগিদ অনুভব করেন কিছু করার জন্য দিনরাত সে ভাবনা তাকে অস্থির করে তোলে কিন্তু কী করতে পারেন তিনি এই বয়সে? ভাবতে থাকেন এবং অবশেষে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন বৌমা সাংপুইকে একদিন তার মনের ইচ্ছের কথা জানান বিরাট কিছু করা তার পক্ষে সম্ভব নয় নিজের ক্ষুদ্র সামর্থ নিয়ে তিনি এই যুদ্ধে সামিল হতে চান শুধুমাত্র নিজের ইচ্ছের কথা জানিয়ে ক্ষান্ত থাকেন না, পাশাপাশি জানান কী করতে চান তার কথা শুনে সাংপুইয়ের মনে হয়নি এ-কেবল বার্ধক্যের বিলাপ উল্টে তার ইচ্ছেকে মর্যাদা দিতে এগিয়ে আসেন তারা

    স্বামীর পেনশন হিসেবে মাসে ১৪,৫০০ করে টাকা পান পাই নাঘাকালিয়ানী এক মাসের পুরো পেনশন তিনি দান করেন মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে শুধু তা করেই ক্ষান্ত থাকেন না করোনার প্রথম দিকে আমরা দেখেছি মাস্কের হাহাকার নাঘাকালিয়ানীও সেটা দেখেছিলেন সাধারণ মাস্ক আট-দশ গুন, এমনকি তারও বেশি টাকায় বিক্রি হচ্ছিল মিজোরামে তিনি বুঝতে পারেন বহু গরিব মানুষ রয়েছেন যাদের পক্ষে বেশি টাকা খরচ করে মাস্ক কেনা সম্ভব নয় এদিকে মাস্কটাও দরকার। নঘিক্লিয়ানী একসময় দর্জির কাজ করতেনতিনি স্থির করলেন তিনি নিজের হাতে মাস্ক তৈরি করবেন। কিন্তু সেই লকডাউনের সময়ে দোকানপাট বন্ধ মাস্ক তৈরির জিনিসপত্র পাওয়া সহজলভ্য ছিল না।  কিন্তু সদিচ্ছা থাকলে কোনো কাজ বাধা হয় না। তিনি দিনে দশ থেকে কুড়িটি পুনর্ব্যবহারযোগ্য কাপড়ের মাস্ক তৈরি করতেন আর সেগুলো যাদের প্রয়োজন তাদের দান করে দিতেন। ৯৫ বছরের এক বৃদ্ধা টেলারিং মেশিনে বসে নিজে হাতে মাস্ক তৈরি করছেন, ছবিটা ভাবলেই শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। তার এই কাজে মুগ্ধ হন মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী জোরামাথাঙ্গা। টুইট করে তিনি লেখেন, “Here is an incredible story of Pi Nghakliani (95), w/o Pu Lalrinliana (L) Ex-MLA; who’s not just yet done with donating her 1-month pensioner’s salary to the Chief Minister’s RF, yet still sew face masks and handing them out to whoever needs it!

    স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, কখনো না বলো না, কখনো বলো না আমি করতে পারবো না তুমি অনন্ত এবং সব শক্তি তোমার ভিতরে আছে, তুমি সব কিছুই করতে পারো চাইলেই যে কাজ করা যায় সেটা করে দেখিয়েছেন পাই নাঘাকালিয়ানী। দেশের করোনা যুদ্ধে নিজের ক্ষুদ্র সামর্থ্য আর শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। বিশাল চাহিদার মাঝে তার অর্থটা হয়তো খুবই সামান্য, খুব বেশি মাস্ক হয়তো তিনি তৈরি করতে পারেননি কিন্তু এই বয়সে এসেও নিজেকে অথর্ব না ভেবে দেশের জন্য, সর্বোপরি সাধারণ মানুষের জন্য কিছু করার যে তাগিদ, সেই মহৎ ভাবনা তাকে মহত্তর করে তুলেছে।


 

No comments:

Post a Comment