Monday, September 28, 2020

রাত্রি পেরোনো রিপোর্টার - সুজিত ভৌমিক

রাত্রি পেরোনো রিপোর্টার

সুজিত ভৌমিক

 

মর্তে আসবেন মা দূর্গা। সে তো জানা কথা। সবাইই জানেন মা আসছেন। কিন্তু মা আসার আগেই অসুরের আগমন ঘটবে, এমন বিপদ যে সাড়া ফেলে চলে আসবে, সে কথা কি কেউ জানতো? না, জানতো না। মায়ের আগমনের আগে এভাবে করোনাসুরের চলে আসা, সবার প্রাণই ওষ্ঠাগত করে তুলেছে।

    সঙ্গে একের পর এক প্রাকৃতিক দূর্যোগ সমস্যা বাড়িয়েছে মানুষের। বিধ্বংসী ঝড়, আমফান তাণ্ডব করোনার ওই কঠিন সময়কালেই প্রবলভাবে বয়ে গেছে রাজ্যের অনান্য জায়গার মতো জেলা পূর্ব মেদিনীপুরের উপকূল অঞ্চলের উপর দিয়ে। ঝড়ের দাপটে ঘরবাড়ি, বড়ো বড়ো গাছ, বিদ্যুতের খুঁটি...সবই লণ্ডভণ্ড চেহারায়। বিপদগ্রস্ত মানুষ আরও বিপদে। কারণ আমফান ঝড়। সংকটে পড়া মানুষজন প্রকৃত অর্থেই দিশেহারা।

    কঠিন এই সময়কালে একজন সংবাদকর্মী হিসেবে আমাদের ব্যস্ততা রীতিমতো চরমে। সংবাদ সংগ্রহই সব নয়, নিজে থেকে চোখের সামনে উঠে আসা ঘটনা, ঘটনার পর আরও ঘটনা এক এক করে ঝড়ের গতিতেই উঠে আসছে, যা সংবাদ হয়ে প্রকাশিত হচ্ছে। যদিও সংবাদ হিসেবে যা বা যতটুকু সামনে আসছে, তা কিন্তু যথেষ্ট নয়। সংবাদ না হওয়া ঘটনার সংখ্যাই বরং অনেক বেশি। যে ঘটনা মানুষের মনকে নাড়া দেয়, কষ্ট দেয়, হতাশ করে তোলে সেসবের সংখ্যা বর্তমানের কঠিন সময়ে অনেক বেশি। কষ্টের মাঝে এমন অনেক দৃষ্টান্ত, মানুষের ভালো ভূমিকাও দেখা মিলছে এই সংকটকালে। আসলে ভালো-মন্দ নানা ঘটনা ছেদহীন ভাবেই উঠে আসছে আমাদের সামনে।

    এমনই এক ঘটনা আমফানের দুদিন পর একটা ফোনেই আমার সামনে চলে এসেছিল। যা শুনে আমি মনে মনে বলতে শুরু করেছিলাম, প্রাণ আছে, প্রাণ আছে। হ্যাঁ, প্রাণ ছিল। বিধ্বংসী ঝড় ঘরবাড়ির সঙ্গেই নন্দীগ্রামের রেয়াপাড়ার এক পরিবারের পান বরোজ উড়িয়ে দিলেও ছোট্ট তিনটি চড়ুই পাখিকে ওড়াতে পারেনি। কয়েকটা পান পাতার মাঝে মা পাখির চেষ্টায় গড়ে ওঠা বাসায় তখনও রয়ে গেছে তিনটি সদ্যোজাত পাখির ছানা। ঝড়ের দাপটে মা পাখিও কোথাও যেন চলে গেছে। মা-হারা তিন-তিনটি পাখির ছানাদের সেসময় খাওয়ার তুলে দিয়ে বরোজ মালিকের গৃহবধূ স্ত্রী ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন তাদের পরিচর্যায়। তিন খুদে পাখির ছানাদের বাঁচাতে মায়ের ভূমিকা নেওয়া গৃহবধূর ভূমিকা, এমন প্রকাণ্ড ঝড় না এলে দেখাই যেত না।

    প্রকাণ্ড ঝড় মানবিকতা যেমন দেখায় তেমনি আমফান আর করোনার কঠিন সময় দেখিয়েছে অনেক অমানবিকতার বাস্তব ছবিও। রেয়াপাড়া থেকে নন্দীগ্রামেরই সোনাচূড়া খুব বেশি দূর নয়। একদিকে করোনার দাপট, অন্যদিকে আমফান। দুইয়ের মাঝে কেমন আছে নন্দীগ্রাম, কেমন আছে খেজুরি জানতে একদিন সকালে মুখে মাস্ক লাগিয়ে রওনা দিয়েছিলাম পূর্ব মেদিনীপুরের প্রতিবেশী এই দুই বিধানসভা অঞ্চল এলাকা ঘুরে দেখার উদ্দেশ্যে। ২০০৭ সালের জমি অধিগ্রহন বিরোধী আন্দোলনকে ঘিরে এক সময়ের উত্তপ্ত নন্দীগ্রাম, সেখানে অদ্ভুত ফারাক দেখেছিলাম। করোনা যেখানে কারণ, সেখানে স্বাভাবিক বৈপরিত্য দেখেছিলাম ভুতামোড়, গড়চক্রবেড়িয়া পেরিয়ে সোনাচুড়ার দিকে দ্রুত গতিতে গাড়ি ছুটিয়ে যাচ্ছিলাম। চলন্ত গাড়ি থেকে দু-দিকে চোখ রেখে দেখেছিলাম কাছে দূরের অনেক কিছু। সোনাচুড়ার কিছুটা আগে, রাস্তার ডানদিকে অনেকটা দূরে, জমির মাঝে চোখ পড়তেই সঞ্জয়কে বললাম, গাড়ি থামাও। ব্রেক কষে চালক সঞ্জয় থামিয়ে দেয় গাড়ি। গাড়ির দরজা খুলে অনেক দূরে চোখ রেখে দেখলাম, একটা মাটির কুঁড়েঘর মাটিতে মিশে গিয়েছে। কাছাকাছি কেউ নেই, থাকার মধ্যে ভাঙা বাড়ির সামনে গাছের তলায় মাথা ঝুঁকিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে রয়েছেন এক বৃদ্ধা। জানতে পারলাম ঝড়ে মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়া কুঁড়ে ঘরটির মতোই মাটিতে ঝুঁকে পড়েছেন তিনি, প্রায় ৮০ বছরের বৃদ্ধা মোক্ষদাদেবী। আমফানের পর প্রায় সাতদিন কেটে গেছে। যেন ভাঙা বাড়ি নিজে জেগে পাহারা দিচ্ছিলেন ওই বৃদ্ধা। সেই সাতদিনে কারোর কোনো নজরে পড়ল না, কেন এভাবে এতো কষ্টে থাকতে হবে ওই বৃদ্ধাকে, নানা প্রশ্ন আমার মনে উঁকি দিতেই, মোক্ষদাদেবীকে নিয়ে খবর করেছিলাম। খবর সামনে আসার সঙ্গে সঙ্গেই এলাকার বিধায়ক, মন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী তাঁর প্রতিনিধি পাঠিয়ে মোক্ষদাদেবীকে বিভিন্ন সাহায্য করেছিলেন। জেলাশাসক পার্থ ঘোষ খবর দেখে আমায় ফোন করে সরকারি সাহায্য পৌঁছে দিয়েছিলেন। সঙ্গে আরও অনেকেই তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। খারাপ লাগা আর ভালোলাগার সেই গল্প আসলে বাস্তবই। সবটাই করোনা ভয়, দায়িত্বহীনতা এবং দায়িত্ববোধেরই ছবি তুলে ধরেছিল।

    আরও ছবি, আরও অনেক ছবিই সামনে এসেছে এই কঠিন সময়কালে। যেখানে দেখা গিয়েছে বাসুলিয়ার অজ গাঁয়ের সুধাময় নামের একজন মানুষ, ঔষধ দোকানে থাকতে থাকতেই করোনা আক্রান্ত হয়ে চরম বিপদে নিজে পড়েছেন, সঙ্গে নিজের পরিবারকেও সেই কঠিন বিপদে ফেলেছেন। অথচ কোনো দোষই ছিল না সুষময়বাবুর। তবু, করোনা হওয়ার কারণে তাঁর পরিবারের ওপর দূর থেকে দৃষ্টি ফেলাই বন্ধ করে পাড়া প্রতিবেশী থেকে আত্মীয় পরিজন। কঠিন সেই সময়ে বাড়ির ভেতরে বসে স্ত্রী সন্ধ্যাদেবীকে সঙ্গে নিয়ে চোখের জল ফেলেছেন। তবু পাশে পাননি কাউকেই। শুধু কি সুষময়? এরকম আরও কত সুষময় সন্ধ্যাকে প্রায় একঘরে হতে হয়েছে এই করোনাকালে তার ইয়ত্তা নেই। কোলাঘেটে করোনা আক্রান্ত মায়ের জন্য এম্বুলেন্স না পেয়ে নিজের বাইকের পেছনে বসিয়ে প্রায় সজ্ঞাহীন মাকে গামছা দিয়ে নিজের পিঠে বেঁধে কোভিড হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছিল যে হতভাগ্য সন্তান তাঁরই বা কি দোষ ছিল? দোষ বা অপরাধ কোনোকিছুই তো ছিল না তাঁর মায়েরও। তবু, যে প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে তাদের লড়াই চালাতে হয়েছে, তাদের মতো আরও মানুষকে লড়াই চালাতে হচ্ছে, তার জন্য কাকে দুষবেন মানুষ?

    আসলে কঠিন এই সময়কাল, আরও কঠিন হয়ে উঠেছে আমাদের সমাজের একশ্রেণির মনুষের জন্যই। যারা আবার সংখ্যার হিসেবে অনেক বেশিই। সেই বেশি সংখ্যক অর্বাচীন মানুষের মাঝে অবশ্য ভালো মানুষের সংখ্যা কম হলেও রয়েছে। তাইতো অতিমারীর মাঝে আজও বেঁচে আছে কষ্টে থাকা মানুষজন। মানবতা বেঁচে আছে বলেই আজও সাহায্যের হাত প্রসারিত হয়ে বিপদগ্রস্তদের ছায়া দিয়ে আসছে। যারা নিঃস্বার্থ ভালোবাসা দানের মাধ্যমে সহযোগিতার কর্মযজ্ঞে যুক্ত আছেন, তাদের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে পরিচয় ঘটেছে। ভালোও লেগেছে এই সৎকার্যের মধ্যিখানে। সেরকমই একটি গল্প (আসলে বাস্তব) বলতে চাইছি।

    একদিন নয়, সেসময় পরপর বেশ কয়েকদিনই আমাকে ফোন করে যাচ্ছিলেন শিল্পী মানুষ শশাংক মাইতি। তিনি বলেছিলেন কজন বয়স্ক মানুষের ইচ্ছার কথা।

    হ্যালো, সুজিত তো? আমি শশাংকদা বলছি।

    বলুন।

    তোমাকে একটা কথা বলার ছিল। দেখা হবে?’

    খুব খুউব ব্যস্ত আছি, কী বলবেন ফোনে বলুন।

    আমার ব্যস্ততা অনুধাবন করেই শশাংকদা সেদিন টেলিফোনেই যা বলেছিলেন আমাকে, সেটা হল অবসরপ্রাপ্ত এক বয়স্ক মানুষের কথা। বলেছিলেন, বয়স্ক মানুষটি গরিব মানুষদের জন্য চাল দিতে চান। কষ্টে থাকা দুঃস্থ মানুষদের তাঁর দেওয়া চাল কাকে দেওয়া উচিত, কাকে বন্টন করা উচিত সেটা সাংবাদিক সুজিত ভৌমিক অর্থাৎ আমার হাত দিয়েই করতে চান। আমি ভদ্রলোকের দেওয়া চাল বিলি বন্টন করার দায়িত্ব নিই। দায়িত্ব পালনও করি। সংকটের মাঝে এইসব টুকরো টুকরো উদ্যোগে বেশ খুশি লেগেছে। এক্ষেত্রেও ভালোলাগা বাড়িয়ে দিয়েছিল। ভালোলাগার কারণ, একজন বয়স্ক মানুষের ওভাবে তাঁর মতো করে এগিয়ে আসা। যা শুধু সহযোগিতার মধ্যে আবদ্ধ থাকেনি, শিক্ষাও দেয় সমাজকে।

    মহিষাদলের বয়স্ক মানুষটির এগিয়ে আসা আনন্দ দেয় যেমন, তেমনি হলদিয়ার বাসিন্দা অল্প বয়সি সুব্রত মাইতির কথা সামনে এলে মন খারাপ হয়ে ওঠে। হলদিয়ার সুব্রতর বয়স মাত্র ১৪ বছর। টোটো-চালক বাবা ভগীরথ মাইতির একমাত্র ছেলে সুব্রত চেয়েছিলো জীবনে অনেক বড়ো হতে। ছোটো বয়স থেকে ক্যান্সারে আক্রান্ত সুব্রত হলদিয়ার ১৯ নম্বর ওয়ার্ডে নিজের বাড়িতে বসে বাবাকে শোনাতো, ক্যান্সারকে হারিয়ে আমি সুস্থ হবো, বড়ও হবো। চেয়েচিন্তেই নিজের অসুস্থ পুত্রের চিকিৎসা চালাতেন টোটোচালক বাবা। কিন্তু ক্যান্সার জয় করার স্বপ্ন নিয়ে লড়াই চালানো ১৪ বছরের সুব্রতকে আঁকড়ে ধরে করোনা ভাইরাস। করোনা আক্রান্ত কিশোর সুব্রতর চিকিৎসা চলছিল কলকাতার হাসপাতালে। শেষপর্যন্ত সেখানেই তার মৃত্যু হয়। বাবা চেয়েছিলেন হলদিয়ায় নিজের বাড়িতে ফিরিয়ে আনবেন একমাত্র সন্তানের মৃতদেহ। করোনার কারণে হলদিয়ায় আনা যায়নি মৃতদেহ। কলকাতার শ্মশানে নিজের মৃত ছেলের দেহ দাহ করে ফিরে আসে টোটোচালক ভগীরথ। ভেঙে পড়েছে মৃত সন্তানের বাবা ভগীরথ। তাঁকে সান্ত্বনা দিতে পারনিনি। তাইতো কখনো কখনো মন ভালো হয়ে উঠলেও স্থায়ী হয় না কিছুতেই। তবু আশা রাখি একদিন আবার সুস্থ কোনোও ভোরে, নতুন সূর্য উঠবেই....


 

No comments:

Post a Comment