তুলির মনের মানুষ
মৌসুমী বন্দ্যোপাধ্যায়
‘ও শৌণকদা’
থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম আমি। কিন্তু এভাবে দাঁড়িয়ে গেলাম কেন আমি! এই ভরপুর বইমেলায় আমার নাম ধরে প্রায় সবাই না হোক, অনেকেই ডাকতে পারে। শৌণকদা, শৌণক, শৌণকবাবু... যে কোনো সম্বোধনে।
এদের মধ্যে খুব কম, হাতেগোনা বলা যায়, যাদের আমার কাছে কিছু চাইবার নেই। নাহলে তো বেশিরভাগ... “ও দাদা আমার লেখাটা দেখলেন?” “কী গো আর পাত্তাই দিচ্ছ না। সেদিন মেসেজ করলাম আনসার দিলে না।” “আপনার ফোন নম্বরটা পেতে পারি?” “দারুণ একটা গল্প লিখেছি। আপনার মেইল আইডিটা দেবেন? অবশ্য আপনি যদি বলেন আপনার হোয়াটস অ্যাপে দিয়ে দিতে পারি।” “দাদা, আমরা একটা খুব ছোট পত্রিকা চালাই। খুব কষ্ট করে পত্রিকা করি। না না, আপনাকে লেখা দিতে বলছি না। যদি একটা শুভেচ্ছা বার্তা লিখে দেন তাহলে আমাদের পত্রিকা একটা আলাদা জায়গা পেতো।”
আমি খুব অবাক হই। আমার কাছে অন্যদের এত চাহিদা কেন রে বাবা? আমি কারো সাতে-পাঁচে থাকতে চাই না। লেখার এত চাপ...ওহো! আপনাদের তো আমার পরিচয়টাই দেওয়া হয়নি। ধুস্, নিজের পরিচয় সর্বসমক্ষে দিতে আর ভাল লাগে না। সেই অধ্যায় অনেকদিন আগেই পেরিয়ে এসেছি। আচ্ছা, আপনারা দেখুন না আমার সঙ্গে চলতে গিয়ে পরিচয়টা খুঁজে পান কী না।
হ্যাঁ, যা বলছিলাম। এই ধরনের কথার মুখোমুখি হব জেনেও আমার থমকে দাঁড়িয়ে যাওয়া উচিত হলো কি? মনে হয় কাজটা ঠিক করিনি। পা বাড়াতে যাব, আর তখনি, ‘ও শৌণকদা? শুনতে পাননি? আপনার পিছনদিকে একবার দেখুন।’
পিছনদিকে আমি কখনো তাকাতে চাই না। মনে হয় নিজেকে আয়নার মুখোমুখি দাঁড় করাচ্ছি কত কী ভেসে সামনে এগিয়ে এসে আমাকে ঠেলে পিছিয়ে দিতে চাইছে। আপনারাই বলুন, সেটা কি কারোর ভাল লাগতে পারে? আপনার লাগতে পারে? অবশ্য আপনার মনের খবর আমার জানার কথা নয়। তাছাড়া মন ব্যাপারটাই বেজায় জটিল। আমি আবার ওসব ভীষণভাবে এড়িয়ে চলি। এই তো সেদিন তনিমা আমায় বলছিল... সেসব কথা এখন থাক।
এখন সপাটে পিছন না ফিরে বরং কিছুটা তেরচাভাবে তাকিয়ে দেখি কার খপ্পরে পড়তে চলেছি। আর এড়াতে পারব বলে মনে হচ্ছে না। তাকিয়েই মনটা কেমন ভাল হয়ে গেল। এ তো তুলি। মাঝেমধ্যে আমার অফিসে আসে। কোন দাবিদাওয়া নেই। ধূমকেতুর মত আসে, কথার ফুলঝুরি ছুটিয়ে হঠাৎ ধাঁ হয়ে যায়। তখন হাজার ডাকলেও আর দাঁড়ায় না।
‘কেমন আছ তুলি?’
‘সেসব পরে বলছি। আগে বলুন চা খাবেন কিনা।’
‘খেতে পারি। কিন্তু চিনি ছাড়া লিকার চা।’
‘ওফ্, আপনি আর পাল্টালেন না। চিনি না খেয়ে আপনার মধ্যেকার মিষ্টত্ব যেদিন এক্কেবারে পালাবে সেদিন মজা বুঝবেন।’
‘হা হা হা। তাহলে বলছ, এখনও মিষ্টত্ব কিছুটা হলেও অবশিষ্ট আছে?’
‘খালি বাজে কথা। নিন ধরুন। তবে একটা কথা। এই চায়ের দামটা কিন্তু আজ আপনাকে দিতে হবে।’
‘এটা কি ঠিক কথা হলো তুলি? আমি বাপু চা খাব বলিনি। তুমিই ডেকে আমাকে...’
‘এত কথা বলেন কেন বলুন তো? দাম দিতে বলেছি, দিয়ে দেবেন। ভারি তো কুড়ি টাকা। আর তাই নিয়ে আপনি বাগবিতণ্ডা করছেন।’
‘আরে না না, বাগবিতণ্ডা করছি না। কিন্তু তুমি দেবে নাই বা কেন?’
‘আচ্ছা নাছোড়বান্দা মানুষ তো আপনি! আমার সিক্রেট জেনেই ছাড়বেন।’
‘ও বাবা! এর পিছনে সিক্রেট আছে! তাহলে তো জানতেই হচ্ছে।’
‘কিন্তু বলব কেন আমি?’
‘অবশ্যই বলবে। কারণ এখন তুমি, আমি, চা আর সিক্রেট একে অপরের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে গেছি।’
‘এখনো কী দারুণ করে কথা বলেন আপনি!’
‘তাতেই বা কী লাভ হচ্ছে তুলি? বললে না তো তোমার সিক্রেট।’
‘আসলে মঙ্গলবার চায়ের দাম দিলে আমার মনের মানুষকে পাব না।’
‘অ্যাই তুলি, আমি তোমার মনের মানুষ হতে যাব কেন?’
‘এখনও হননি, কিন্তু কোন একদিন হতেও তো পারেন। আবার নাও পারেন। আসলে আমার নিজের খোঁজাটা সম্পূর্ণ নয়। যেদিন শেষ হবে সেদিন…’
আর দাঁড়ায়নি তুলি। আমিও না।
ভিড়ে হারিয়ে যেতে আমার ভাল লাগে। অনেক অচেনা মানুষের ভিড়ে, যেখানে সবাই সবার অপরিচিত। অন্যের দিকে তাকালে মেকি হাসতে হবে না। ভাল না থাকলে সেটা লুকোতে হবে না। আবার আমার সুখ দেখে অন্যে যেন ঈর্ষাণ্বিত না হয়ে পড়ে তার জন্য রেখে ঢেকে বলতে হবে না। বিপুল জনসমুদ্রে নিজের মতো করে ঢেউয়ের দোলায় ভেসে চলা, এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে।
তুলি আমার মন থেকে হারিয়ে গিয়েছিল। আসলে আমার ব্যস্ত লেখক জীবনে তুলির মতো সাধারণ মেয়েরা দাগ কেটে রেখে যেতে পারে না। এই যাহ্, বলেই ফেললাম আমি কী করি। অবশ্য আগে বলেছিলাম আপনাদের, আমার সঙ্গে চলতে গিয়ে জেনে যাবেন আমার সম্পর্কে।
সেদিনে অফিসে বসে একটা পেজ কারেকশন করছি, তন্ময় এলো আমার ঘরে।
‘শৌণকদা, তোমার তুলিকে মনে আছে?’
‘কোন তুলি?’
‘আরে বাপরে! ক-টা তুলির সঙ্গে তোমার চেনা জানা?’
‘খুব চাপে আছি তন্ময়। ফাজলামি না করে যদি কিছু বলার থাকে বল, নাহলে কেটে পড়।’
‘সেই তুলি গো। যাকে তুমি বকবকিয়া বলো। তবে বেশ অনেকদিন হয়ে গেল এখানে আসতে দেখিনি।’
তন্ময়ের মুখে “বকবকিয়া” শব্দটা শুনে তুলির মুখটা নিমেষে ভেসে উঠল আমার চোখের সামনে। বকবকিয়াই বটে। যখন কথা বলত তখন আশেপাশের কারোর কিছু বলার আছে বলে মনেই করত না। অদ্ভুতভাবে নিজেই কথা বলে যেত। বিপরীতের মানুষটা শুনছে কিনা সেটা নিয়েও সম্ভবত মাথা ঘামাত না। বলাতেই তার আনন্দ, সুখ, ইচ্ছা মিলেমিশে একাকার হয়ে যেত। মাঝেমাঝে আমার মনে হতো ওর বকবকানি শোনার কেউ নেই। তাই আমার কাছে এসে কথা বলে হাল্কা হয়ে যায়।
‘কী হয়েছে তুলির?’ জানতে চাই আমি।
‘সেদিন নিউমার্কেটে দেখা হলো। একটা ভ্যাবলা টাইপের ছেলের হাতটা জড়িয়ে হাঁটছে। চোখে যেন একটা ঘোর লেগে।’
‘তাই নাকি! এ তো ভাল কথা। মেয়েটা এতদিনে তাহলে মনের মানুষ পেলো।’
‘সেরেচে! তুমি এই মনের মানুষ এপিসোড জানো নাকি?’
‘এপিসোড!’
‘হ্যাঁ গো। জানতে চাইলাম, তুলি কে ইনি? উত্তর দিলো, কেউ না। মনের মানুষ খুঁজছি। দেখি পাই কিনা।’
নিমেষে আমার মনটা তুলির উদাসী চোখের কাছে পৌঁছে গেল। দেখেছেন তো, আগেই বলেছিলাম “মন” ব্যাপারটা বেজায় জটিল। আমি এড়াতে চাইলেও সবসময় পারি না। এই এখন যেমন পারলাম না। তুলির চোখ আমায় টানতে লাগল। মেয়েটাকে দেখতে ইচ্ছা করছিল। ওর বকবকানি আগে বহুবার শুনতে বিরক্ত লাগলেও এখন শোনার জন্য মন অস্থির করতে লাগল। ফিসফিস করে বললাম, বকবকিয়া তোমায় খুব দেখতে ইচ্ছা করছে। তোমার বকবকানিতে কান ভরে উঠতে চাইছে। “ধ্যুত তেরি” বলে কারেকশনের কাজটা তন্ময়ের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম।
ব্যস্ততা অনেক কিছু ভুলিয়ে দিতে পারে। তাই আমি আবার ভুলে গেলাম তুলির কথা। আমার ব্যস্ত জীবনে হাঁটা প্রায় হয় না বললেই চলে। কিন্তু সেদিন একটা বইপ্রকাশ অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। ইচ্ছা না থাকলেও যেতে হয়। প্রোগ্রামের মাঝেই বেরিয়ে এসেছিলাম। শরীরটা কেমন খারাপ লাগছিল। সুধন্য মানে আমার ড্রাইভারকে ফোন করে গাড়ি হলের সামনে আনতে বলে সিগারেটটা ধরাতে যাব, দেখি উল্টোদিক থেকে তুলি হেঁটে আসছে। এ কোন তুলিকে দেখছি! নতুন বিয়ের রেশ এখনো ছুঁয়ে আছে মেয়েটাকে। ভীষণ রকম ঝলমল করছে। চোরা কষ্টের স্রোত বয়ে যাচ্ছে আমার বুকের ভিতর। দেখেছেন তো, কেন বারবার বলি মন বড় জটিল।
‘কেমন আছেন শৌণকদা?’
‘এই তো চলে যাচ্ছে। তোমার খবর কী?’
‘মন্দ নয়।’
‘তাহলে মনের মানুষ পেলে?’
অদ্ভুতভাবে তুলি তাকাল আমার দিকে। তারপর ‘আসছি’ বলে ভিড়ে মিশে গেল।
মনটা ভীষণ তেতো হয়ে গেল। অপমান ছুঁয়ে গেল কি? একদিন যাকে পাত্তা দিইনি আজ সে পাত্তা দিলো না। জ্বালা ধরছে মনে। রাগটা পড়ল সুধন্যর ওপর। সুধন্য শান্ত, বুঝদার ছেলে। মুখ বন্ধ করে আমার রাগ হজম করে নিলো।
আগেই বলেছিলাম বহু অনুষ্ঠানে আমায় যেতে হয়। সেটা লেখালিখি সংক্রান্ত নাও হতে পারে। আসলে পরিচিতি বাড়লে এই বিড়ম্বনাগুলো সহ্য করে নিতে হয়। এটাও একধনের শিক্ষা।
কিন্তু আজ গিয়েছিলাম সম্পূর্ণ একটা অন্য জায়গায়। আমার বন্ধু প্রলয় নিয়ে গিয়েছিল। ছোট থেকে বরাবর আমার মতামতের ওপর নির্ভর করে প্রলয়। সবাই বলে থাকে আমরা অভিন্নহৃদয়। কিন্তু সত্যি কি তাই? সেই প্রলয় গত দুবছর ধরে ভাল নেই। আমি পারিনি আমার ছোটবেলার বন্ধুকে ভাল রাখতে। আমি নিজে কি প্রলয়ের মতো একইভাবে মানসিক কষ্টে আছি? নিশ্চয়ই নয়।
প্রলয় আজ আমাকে যেতে বলায় একবারের জন্যেও হেজিটেট না করে চলে গিয়েছিলাম। কোথায় যাচ্ছি প্রশ্ন করিনি। কিন্তু কেন যাচ্ছি জানতাম। প্রলয়ের একমাত্র মেয়ে সুলু জন্ম থেকেই ছিল একটু অন্যরকম। ঠোঁটদুটো কাটা। তাই নিয়ে প্রলয় আর তার বউ রঞ্জনার কষ্টের শেষ নেই। বিয়ের অনেকগুলো বছর পর মেয়েটা হয়েছে। অনেক সমস্যা ছিল রঞ্জনার। তারপর মেয়ের এই ব্যাপারটা প্রলয় মানতে পারেনি। টাকাপয়সার প্রাচুর্য নেই প্রলয়ের। তাও চেষ্টার ত্রুটি করেনি। কিন্তু কোনো ডক্টর অ্যাসিওরেন্স দিতে পারেননি সুলুর ভাল হওয়ার ব্যাপারে।
গেটে ঢোকার মুখেই থমকে গেলাম। সামনের সাইনবোর্ডে লেখা “একরাশ হাসি”। মনটা নিজের অজান্তেই ভাল হয়ে গেল। তাহলে কি এখানেই সুলু তার হাসি ফিরে পাবে? ভিতরে গিয়ে কথাবার্তা বলে ব্যবস্থা করে আমি আর প্রলয় ফিরে এসেছিলাম। পরেরদিন সুলুকে ডক্টর দেখবেন। তারপর অপারেশনের ডেট দেবেন। সবথেকে বড় কথা ওই ডক্টর সুলুকে সামনে না দেখে শুধু ছবি দেখেই হাসি ফিরিয়ে দেবার কথা দিয়েছেন। এটা প্রলয়ের কাছে তো বটেই, আমার কাছেও অনন্য প্রাপ্তি।
এর পরের একসপ্তাহ ভীষণ ব্যস্ত হয়ে যাওয়ার জন্য সুলুকে দেখতে যেতে পারিনি। তবে প্রলয়কে ফোন করে নিয়মিত খবর নিয়ে গেছি।
আজ সুলুকে ছেড়ে দেবে। আজকের দিনটা আমি মিস করতে চাইনি। সুলুর হাসিমুখ দেখতে খুব ইচ্ছা করছে। প্রলয় অফিশিয়াল ফর্মালিটিস মেটাতে গেল আর আমি সুলুর কেবিনের দিকে পা বাড়ালাম।
‘স্যরি।’ সুলুর কথা ভাবতে গিয়ে ওখানকার একজন সিস্টারের হাতের মধ্যে ধরা ফাইলে ধাক্কা দিয়ে ফেলেছি। কিন্তু এ কাকে দেখছি! এ তো “বকবকিয়া” তুলি!
‘তুলি, তুমি এখানে!’
‘এখানে চাকরি পেয়েছি শৌণকদা। কিন্তু আপনি এখানে?’
‘সুলু, আমার বন্ধুর মেয়ে। তার অপারেশন হয়েছে সাতদিন আগে। আজ ডিসচার্জ করবে।’
‘ও, তাই বলুন। হ্যাঁ ওর ছুটি হয়ে গেছে।’
‘একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?
‘হ্যাঁ, বলুন না।’
‘তোমার মনের মানুষ… না মানে, বলতে না চাইলে বলতে হবে না।’
‘আপনি তো লেখক। কত কি বোঝেন, আবার কত কী কল্পনা করে নেন। সেই বোঝা আর কল্পনা মিশিয়ে দেখুন না, যদি কিছু পান।’
সুলুকে কোলে করে তুলি বাইরে নিয়ে এসেছে। রঞ্জনার কোলে তুলে দিচ্ছে। আর সুলু? কী এক অবুঝ ভালবাসায় তুলির সারামুখে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আমি দূর থেকে দেখছি সুলুর হাসিতে তুলি মিশে যাচ্ছে। তুলির উদাসী চোখদুটো ক্রমশ উজ্জ্বল হয়ে উঠছে।
নাহ্, তুলি তাহলে…
No comments:
Post a Comment