Tuesday, September 22, 2020

এক টাকার ম্যাজিক - অমৃতা দেবনাথ

 এক টাকার ম্যাজিক

অমৃতা দেবনাথ

 

পাড়ার মোড়ে রবিবার বিকেল চারটের হইহুল্লোড়ের স্বাদটাই একেবারে ভিন্ন। বিল্টু, টুবলু, বোঁচা, গনেশ, পাঁচু সকল কচিকাঁচাদের দল রবিবারের মাংসভাতের পর এই বিকেলটা সহজে হাতছাড়া করে না। সপ্তাহের ব্যস্ততার ভিড়েও চাতকপাখির মতো চেয়ে থাকে তারা এইসময়ের জন্য। বয়সসীমা এই হবে এগারো বারো, নিতান্তই নাবালক, দুষ্টুমি ভর্তি মস্তিষ্ক আর দুরন্ত চোখ।

    রবিবার ছাড়া তাদের সময় কোথায়? দশটা-পাঁচটার ডিউটি তো তাদেরও থাকে স্কুলে। এরপর হাজারো অতিরিক্ত পার্শ্বশিক্ষা এই যেমন সাঁতার-কবিতা-গান-মার্শাল আর্টস-ক্যারাটে আরো সব কত কি...

    রবিবারটা তাদের কাছে শান্তি। নিজের মতো খেলে হাসে ছুটে বেড়ায় মুক্ত আকাশের নীচে উন্মুক্ত ঘাসের শিশিরের ওপর, পাড়ায় যেন বসন্তের বিরাজ।

    বিগত মাস তিনেক ধরে ঋতুরাজের কোলাহল আর শোনা যায়। প্রকৃত বসন্তেও তারা ঘুমন্ত। গোটা পৃথিবীটা একটা ঘরে পরিনত যার মধ্যে আছে শুধু একটি জানালা। সময়ের অবসরে জানালা দিয়ে হাত নাড়িয়ে কথা বলা, ব্যাস এই টুকুতেই পরিনত হয়েছিল তাদের রবিবারগুলি। সম্পূর্ণ পাড়াটাকে যেন আবৃত করেছে একটা অতিকায় মাস্ক, যার ভিতরে বন্দি থাকা নাক না পারে নিশ্বাস নিতে না পারে ছাড়তে। আবার তার অনুপস্থিতিতেও ভয় সন্দেহ বাসা বাঁধে মনে এই বুঝি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শরীর গুলি গ্রাস করল সারা শরীর।

    কঠোর বেড়াজাল একটু শিথিল হওয়ায় কচিকাঁচাদের দল বসল কিছু গুরুতর আলোচনায়। টিমে রয়েছে মোট ছয় জন। একটা নতুন মিশন, উদ্যোগ, যার ফলে উপকার হবে সমাজেরর নিম্নবর্তী মানুষগুলির, সেই মানুষগুলি যারা রেইলস্টেশন থাকত, যারা মানসিক ভাবে ভারসাম্যহীন। দরকার শুধুমাত্র 'এক টাকা' র। হ্যাঁ মাত্র এক টাকা।

    ওইটুকু মাথাতেও এত নিখুঁতভাবে কাজের বুদ্ধি এসেছে তা দেখে তাজ্জব বনে যেতেই হয়। তারা সকলে দিনের ঘন্টাখানেক ব্যায় করত আর বেরোতে সাইকেলে, যেত দোকানে আর বসতবাড়িগুলিতে, জমা করতে শুরু করল মাত্র এক টাকা করে। টিমের এক-দুজনের বাড়ি থেকে সম্মতি দেওয়া হয়নি এ-কাজে কিন্তু তবুও তারা দমে যায়নি। চালিয়ে গেল এই মহান উদ্যোগ।

টিনের একটা কৌটো নিয়ে বেরিয়ে পড়ত।

    এই মহান উদ্যোগ দেখে অনেকেই বড়ো কিছু সাহায্যের হাত বাড়িয়ে ছিল কিন্তু তাদের দরকার ছিল শুধু একটাকা করেই। কারণ তারা জানত শহরের বুকে থাকা মধ্যবিত্ত এই সমাজগুলির মাত্র এই টাকা দানে কোনো অসুবিধা হবার কথা নয়। আবার এই একই সাথে যাদের দরকার তাদেরও খানিক উপকার করা যাবে।

     সপ্তাখানেক পর টাকা গুলি গুনতে সময় লেগেছে পাক্কা পাঁচ ঘন্টা। আর টাকার পরিমাণ ছিল সত্তর হাজারের একটু বেশি। আর যেটা সবথেকে বেশি ছিল তা হল মানুষের সম্মতি।

    সেটাকা দিয়ে সাহায্য হল দুঃস্থ, আর্তদের। পাড়ার এক জ্যেঠীমা ছিলেন যিনি এই সময়ে টাকার জন্য হাতে মাস্ক বানিয়ে তা বিক্রি করতি শুরু করেছিল। তার থেকেই বানিয়েছিল অনেক পরিমান মাস্ক এবং তুলে দিয়েছিল মোটা অঙ্কের টাকা পারিশ্রমিক হিসেবে। তারা লক্ষ করেছিল এই দুঃসময়ে অনেক চা-ওয়ালাল সংখ্যা বেড়েছে। জানি না আমরা কজন লক্ষ করেছি, তাদের কয়েকজনকে খাবার কেনার দায়িত্বে রেখে তাদির কেউ আর্থিক সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে সেই ক্ষদ্র ঋতুরাজ বসন্তের দল।

    যাদের মাস্ক ছিল না তারা মাস্ক পেল, অভুক্তরা পেল খাবার, আর্তরা পেল ওষুধ।

    হয়তো তা দুয়েকদিনের জন্য কিন্তু তবুও তাদের মানবিকতাকে আমরা সেলাম জানাই। এক টাকার মতো একটা তুচ্ছ দান ও যে হাজার মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে পেরেছে, হতে পেরেছে তাদের একটুকরো শান্তির নিঃশ্বাস...সমাজের নতুন প্রজন্মের থেকে এটাই আমাদের সবথেকে বড়ো পাওনা হওয়া উচিত।

    আমরা কতজন ভাবতে পেরেছি এভাবে হাত তোলো তো ?

No comments:

Post a Comment