Tuesday, September 22, 2020

ভালোবাসার অরণ্যে - ডা: শুভায়ু দে

 ভালোবাসার অরণ্যে

ডা: শুভায়ু দে

 

অরণ্যে যেতে চাইছে এবার রুমা। ওর কথায়, একটা সুন্দর সিম্ফোনি আছে পাহাড়, নদী, বন...আর বন, নদী পাহাড়ে। দু'বছর ধরে শুধু আমরা শুধু ওর লেখার তাড়নায় ঘুরে গেছি পাহাড় আর নদী। তাতে বিস্তর লাভ হয়েছে বটে। রুমার দুটো বই বেরিয়েছে, উপন্যাসে এসেছে মকাইবাড়ির চা থেকে পুরীর সমুদ্র। মানে যা যা দেখে রুমা, তাই রুমার লেখনী তে থাকে। সেই গল্প প্রথম শুনে রিভিউ দেওয়ার প্রথম হকটি আমার। বিয়ের মাত্র ২ টো বছর, আর তাতেই ওর গল্প শোনার আর রিভিউ দেওয়ার সবচাইতে কাছের মানুষটা হয়েছি আমি। মাঝে মাঝে ভাবি, আমি বড়োই ভাগ্যবান আবার ভাবি আমি কি সত্যিই এতটা যোগ্য। তখনই এলো চুলে বিলি কেটে বলে, "কেন? গল্প শুনতে গেলে যোগ্যতা লাগে বুঝি?" আর আমি হারিয়ে যাই ওর সাহিত্যে।

    আমাদের ফ্ল্যাটের বারান্দায় একটা সুন্দর দোলনা আছে। রুমা নিজেরই লেখা গল্প ওখানে বসে পড়ে। বারান্দার কার্নিশে রুমার শখের বাগান। একবার একটা পাখি ডিম পেড়ে গেছিল,তাই দেখে রুমা একটা কবিতাই লিখে ফেলল,

"আমি তো অল্প ছিলাম,ভরলে সুখের ভাষায়।

নতুন সৃষ্টিদেশ,নতুন পাখির বাসায়।"

    আমি দেখি দূর থেকে স্রষ্টা আর সৃষ্টি কে। স্রষ্টা যখন একান্ত আমার,তাহলে তার সৃষ্টিও তো আমারই। একজনের লেখায় আরেক জনের আবেগে ঈশ্বরকে খুঁজি আমরা। অবশ্য এই সাহিত্যের মধ্যে বেমানান একটি জিনিষের সাথেও নিবিড় যোগ রুমার, সেটা হল বাড়ির ডাস্টবিন। ও যখনই লিখতে বসে ওই ডাস্টবিনটা সাথে নিয়ে বসে। সৃষ্টি আর সৃষ্টির প্রতি স্রষ্টার নিবিড় প্রেমের মধ্যে যে লেখনী বাধা হয়ে আসবে তার জায়গা হবে ওই ডাস্টবিনে। আমি একবার সেই সব কাগজের স্তুপ কুড়িয়ে দেখেছিলাম কি ফেলে দিয়েছে ও। তাতে যা দেখলাম, সেইসব কবিতা বা গল্পের  কাগজগুলো জড়ো করলে দিব্যি একটা বেস্টসেলার হয়ে উঠতে পারে। আমি নবান্নের সরকারী কর্মচারী, আমার দৌড় ও সীমিত। রুমাকে বলেছিলাম, এসব তো অমূল্য, তবে কেন?

    ও বলেছিল, "ভালবাসতে পারিনি যে, কিভাবে আপন করে নেব।"

    রুমা পাহাড়, নদী খুব ভালোবাসত তবে অরণ্য ভ্রমণের সুযোগ সেভাবে করে উঠতে পারেনি। তবে একদিন ও বলল, "অরণ্য, আমার লেখাগুলো সবই হটকেক হয়ে যাচ্ছে ঠিকই কিন্তু নিজের লেখাগুলোকে নিজে ভালবাসতে পারছি না।"

    আমি তো এই সুযোগের অপেক্ষাতেই হয়েছিলাম চাতক পাখী, "দেখো,লেখার পরিধি বাড়াতে গেলে মনের পরিধিটাকেও ব্যাপ্ত করতে হবে। না হলে তো মনের ম্যাপে শব্দরা খাবি খাবে। আমাদের শব্দ খুঁজে নিতে হবে। দেখি না চলো কি বলছে অরণ্য।" বলতে ভুলে গেছি আমার নাম ও অরণ্য, অরণ্য সমাদ্দার।

    "এক অরণ্য কে ভালোবেসে আরেক অরণ্যে যেতে বলছ। পরকীয়া হয়ে যাচ্ছে না ব্যাপারটা।"

    "হাহাহা।তোমার সাথে কথায় পারা আমার মুশকিল লেখিকা। আসলে বন-উপবন আমাদের আদিম করে দেয়। সৃষ্টির সেই আদিম যুগ থেকে যদি কিছু ধার করে আনতে পারি। আপাতত বাজারের থলে0টা দাও। এরপর বাজারে গেলে শুধু ছাঁটা মাল পাওয়া যাবে।"

 

(২)

 

পরশু রাতে এখানে এসেছি। এই জায়গা টার ব্যাপারে বেশি জানতাম না। জায়গাটার নাম সাতকোসিয়া, এটা একটা টাইগার্স রিজার্ভ। ভুবনেশ্বরে আগে গেছি অনেক বার। পুরী ছাড়াও ওখান থেকে অনেক জায়গায় ঘুরতেও গেছি। তবেএখানে আসা হয়নি। বাঙালি ওড়িশা বললে আগে পুরীই বুঝত এখন সে ধারণায় বিস্তর পরিবর্তন এসেছে। সেই "দী.পু.দা"-এর ছক ভেঙে এগিয়েছে সে অনেক দূর। এখন বাঙালী মানেই কিন্তু "হম পানি খাতা হ্যায়" নয়। এই জায়গাটার ব্যাপারে অবশ্য প্রথম আমাকে বলে অফিসের সুমনাদি, টিফিনের সময়। অফিসের টিফিন-টাইম হল এমন একটা সময় যেখানে কার বাড়িতে কাজের লোক আসেনি থেকে কার বাড়ীর জানলা দিয়ে কাকে দেখা যায় -এ সবেরই আলোচনা হয়। টিফিনে কথায় কথায় ঘোরার কথা উঠলে সুমনাদিই বলে ওরা নাকি এসেছিল আগের মাসে, ভালো লেগেছে। ওদের কথাতেই আসা। ফ্লাইটে ভুবনেশ্বর, তারপর ওখান থেকে আমাদের এক পরিচিতের সহযোগিতায় বুক  করা গাড়ি নিয়ে চলে এলাম। একটা সুন্দর স্যান্ড রিসর্ট আছে। বেশ ভালো বাঙালি বা উড়িয়া কুসিন পাওয়া যায় এখানে। এছাড়াও এখানে এসে শুনলাম নাকি শীতের সময় বিভিন্ন পরিযায়ী পাখিরা ওয়াল্ডলাইফ ফোটোগ্রাফারদের জীবিকা আর উপার্জন বৃদ্ধি করে। ভেবেছিলাম মধ্যপ্রদেশ যাব, তবে এবার বেশি ছুটি নেই। ছোটখাটোর মধ্যে এই ট্রিপ খারাপ লাগছে না।

    "চা খাবে?" রুমার প্রশ্ন।

    আসলে এই "চা খাবে?" ডাকটা বাঙালী নারীদের একটা ভালবাসার ডাক বলা যায়। "ও গো শুনছ" ডাকের মতই বিবাহিত পুরুষরা এই নামের মধ্যে দিয়েও ভালবাসার গন্ধ পায়। আজ সকালে সাইটসিনে নিয়ে গিয়েছিল, বাঘমামার দর্শন ও পেয়েছি। মন আজ ফ্রন্টফুটে খেলছে।

    এখন বিকেল সাড়ে পাঁচটা। বিকেলের দিকে জঙ্গলের বড় বড় গাছের ফাঁকে একটা সুন্দর পড়ন্ত গোধূলির আলো এসে পৌঁছায়। কেন যেন মনে হয় যে আলো আগেও এসেছে এভাবে তো আসেনি। উঁকি দেওয়া আলোয় সে জানান দেয়, "আমি আছি, আছি তো।" মনে হয় যেন সব আলো নিঃশেষিত হয়ে আমাকে দীপ্ত করেছে। সবটুকু আলো ভোগ করছি আমি, এ-আর কারো হতে পারে না।

    রুমার এই চা খাবে ডাকটা শুনে আর ধরে রাখা গেল না নিজেকে।সত্যিই প্রকৃতি কে ভোগ করতে হলে তো এনার্জি চাই ভীষণরকম।

    "কিছু পেলে লেখার মতো।" এই প্রশ্ন টাই বড্ড খচখচ করছিল, ঘোরার ব্যাস্ততায় জিজ্ঞেস করা হয়নি।

    "পেলাম....পেলাম অনেক কিছুই।আমার ঘুমকাতুরে বর, এই ভালবাসার গহীন, পাখিদের ঠোঁটের বসন্ত...আছে আরও অনেক কিছুই।"

    "তো হামারা ট্যুর সার্থক হুয়া।" আমি একটু ইয়ারকি মারলাম।

    "একটা জিনিষ বাদে।"

    "কি? আবার কি চাই" কৌতুহলী আমি।

    "তোমাকে।"

    "যা বাব্বা, আমি তো আছিই। ছিলামই।এখানে এসে আবার আমার মধ্যে এক্সট্রা কি পেলে।"

    "পেলাম। কিছু তো পেয়েছি। একটা জিনিষ আবিষ্কার করেছি অরণ্য। তুমি ভীষণ ভালো সাহিত্যিক।"

    "রুমা, চায়ে কি নেশাটেশার কিছু মিশিয়েছ নাকি?" আমি আতঙ্কিত।

    "না অরণ্য। আজ তুমি সাইট সিনে গিয়ে ছবি তুলতে তুলতে এমন এমন কথা বলছিলে যে আমার মনে হচ্ছিল, আমি তোমাকে এভাবে আগে পাইনি কেন। অরণ্য, তোমার মধ্যেই তো অনেক শব্দ ভিড় করেছিল, আমি দেখতে পাইনি কেন আগে? এই অরণ্যে এসে আমি আমার অরণ্য কে নতুন করে পাচ্ছি মনে হয়।"

    "না,দেখ..."আমি কথা শেষ করতে পারি না। আমাদের রিসর্টের টেন্টে সন্ধ্যা নামে। আমাদের ঠোঁটে তখন এক অপরের সদ্য খাওয়া চা এর স্বাদ বিনিময় হচ্ছে।

    মহানদীর পাশে পাহাড়ে থেক চাঁদের আলো এসে পুঞ্জিভূত হয় বালির মধ্যে। পড়ন্ত বিকেলের সেই আলো না চাঁদের উৎসব নাকি আমাদের নিজেদের কে নতুন করে খুঁজে পাওয়া কোনটা বেশী দামী, ঠিক করতে পারি না। সন্ধ্যার অবগুণ্ঠনে তখন ঢাকা পড়ে যায় আমাদের "ভালবাসার অরণ্য।"


 

No comments:

Post a Comment