Tuesday, September 22, 2020

পাগলামি - সুমিত হালদার

 পাগলামি

সুমিত হালদার

 

আজ তিনদিন হল ছেলেটা ঘরে ফেরেনি। ছেলেটা পাগল, কোথায় আছে, কী খাচ্ছে, কী করছে, ভেবে কূলকিনারা পায় না পাগলের মা। দিন পাঁচেক আগে গ্রামের একদল লোক এসেছিল ওর বাড়ি। ওকে সাবধান করে দিতে, "দেখ পাগলের মা, এসব খবর চাপা থাকে না....তবে এ অবস্থায় তোমার ছেলেকে অন্তত চোদ্দদিন যেন গ্রামের ত্রিসীমানায় বেরোতে না দেখি। দরকার হলে ঘরে খিল দিয়ে আটকে রাখবে।" পাগলের মা স্তম্ভিত হয়ে যায়। পাগলের কী এমন গোপন খবর, যেটা ও জানে না অথচ সারা পাড়া জানে?তবে কি...? না, ছেলের শরীর স্বাস্থ্যে তেমন তো কোনও লক্ষণ নেই। পরদিন গ্রামে কাজ করতে গেলেও প্রত্যেকটা বাড়ির লোক ওকে বলে দিয়েছে, "পাগলের মা, এখন কদিন তোমাকে আর আসতে হবে না। রোগটা তো ভালো নয়, সংক্রামক। ছেলেকে সামলে রেখো।" পাগলের মা যেহেতু পাগল না, তাই তার রোগের ভয় আছে এবং তার থেকেও বেশি করে আছে সমাজের ভয়, নিজের অজ্ঞানতা ও দারিদ্রের ভয়। কিন্তু পাগলকে বোঝাবে কী করে? সে নিজের খেয়ালে সারাদিন মাঠ, ঘাট, বাজার, গঞ্জ, যেখানেই মন আটকাবে, টো-টো করে ঘুরে বেড়াবে। ছেলেটার মনে এমন কোনও শঙ্কাবোধ কাজ করে না, যেখানে টান দিয়ে তাকে বন্দী করা যায়। শুধু একটা আতঙ্ক ছাড়া। তার মা পারতপক্ষে কখনই সেটা ছুঁয়ে কথা বলবে না। কিন্তু তিনদিন আগে, গ্রামের সেই দল আবার এসে ঠিক সেইখানে ঘা দিয়ে শাসিয়ে গেছে। পাগল তখন ঘরেই ছিল। সেই রাতেই ঘরের আগল খুলে পাগল যে কখন পালিয়ে গেল, এমনকি পাগলের মা-ও টের পায় নি।

                     *****

 

   'পুলিশ' শব্দটা শুনলেই পাগলের সারা শরীর থরথর করে কাঁপতে থাকে। হৃদপিণ্ডের গতি অত্যাধিক বেড়ে যায়। ওর বাপকে একদিন পেটাতে পেটাতে তুলে নিয়ে গেল পুলিশ, কয়েকদিন পর তার লাস ফেরত দিয়ে গেল। কী হল, কেন হল ভাবতে ভাবতে বাপ ন্যাওটা ছেলেটার মাথাটাই গেল বিগড়ে। তাই তিনদিন আগে সোমেশ সান্যাল, নিতাই সামন্ত, রথিন নিয়োগীরা দল বেঁধে এসে যখন পুলিশের কথা বলে শাসিয়ে গেল, তখন আর স্থির থাকতে পারেনি পাগল। মাঠের মাঝে পরিত্যক্ত পাম্প হাউসটাতে এসে আত্মগোপন করে ছিল।

   আজ যদিও সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে সব ভুলে, ভাত খাবার জন্য মনটা কেমন যেন আনচান করে উঠল ওর। তাই গ্রামে ঢুকে লুকিয়ে চুরিয়ে ও বাড়ির পথে এগোচ্ছিল। এমন সময়ই পাগলের নজরে পড়ে ঘটনাটা। রাস্তার এক পাড়ে বসে রথিন নিয়োগী খাবি খাওয়ার মতো হাঁপাচ্ছে। তার শীর্ণকায়া স্ত্রী মরিয়া চেষ্টা করছে সেই বিশালবপু মানুষটাকে তোলার। পারছে না। কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে একটা এ্যম্বুলেন্স। আশেপাশে একটা মানুষেরও দেখা নেই। এ্যম্বুলেন্স চালকটাই বা গেল কোথায়? হঠাৎ করে পাগলটাকে সেদিকেই ছুটে আসতে দেখে শঙ্কায় হাঁপটান যেন দ্বিগুণ বেড়ে যায় রথিন নিয়োগীর। পাগলামির ঘোরে পাগল কোন প্রতিহিংসার চরিতার্থ করে বসে, কে বলতে পারে? পাগল এসে বলে, "সড়ো, সড়ো খুড়ি মা.....এসব কি তোমার কম্ম? খুড়োকে আমি তুলছি।"


 

No comments:

Post a Comment