Tuesday, September 22, 2020

রবির সুধা - কেকা সেন

 রবির  সুধা 

কেকা   সেন 

 

'ধুত্তোর! আবার আজকে অটোটা বিগড়ালো!' মনে মনে বিড়বিড় করতে থাকলো রবি। সন্ধ্যা থেকেই ঝিরঝিরে বৃষ্টি। নির্জন রাস্তায় অটো ঠেলতে দেখে কুকুরগুলো তারস্বরে চিৎকার জুড়েছে। বড়োরাস্তা থেকে গলির মুখে পৌঁছিয়ে দম নেয় রবি। পকেট থেকে বিড়ির প্যাকেট বের করে ধরিয়ে নেয়। বিড়ির গন্ধ পেলেই সুধা আবার অশান্তি শুরু করবে, তাও ইচ্ছেটাকে দমন করতে পারে না সে। গলির দুপাশের বাড়িগুলোকে কেমন যেন বিষাদের কালো ছায়া ঢেকে রেখেছে। ঝপ করে রাস্তার আলো নিভে গেল। তাড়াতাড়ি আধ খাওয়া বিড়িটা ছুঁড়ে ফেলে অটোটা টানতে থাকে সে। শ্যাওলা পরা উঠোনে অটোটা রেখে বারান্দায় উঠে আসে

    এতক্ষণে সময় হল তোমার?

    তুমি, বারান্দায় বসে কী করছ?

    মশার কামড় খাচ্ছি, আর কি? ঝাঁঝিয়ে ওঠে সুধা

    বাস গড়িয়া গিয়েছিলাম, বিজনবাবুকে নিয়ে

    পয়সা কড়ি কিছু পেলে?

    তুমি যে কি বল না! এমনিতেই কিডনির অসুখে জেরবার উনি!

    তবে আর কি! এখন এই অসময়ে তোমার যে কোন রোজগারপাতি নেই,  আমাদের কিভাবে চলবে শুনি!

    চলে তো যাচ্ছে ঠিক

    হ্যাঁ, সেইতো। চালিয়ে দিচ্ছি তো যাহোক করে...

    বাকী কথাগুলো কানে না নিয়েই কলতলায় চলে যায় রবি। কলতলার ওপরের পলিথিনের প্রচণ্ড নাচানাচি দেখে গতকালের রেডিওর খবরের কথা মনে পড়ে যায় তার'প্রবল বেগে ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়তে চলেছে কোলকাতা তার আশেপাশের এলাকায়....'

    সকালে উঠে দরজা খুলে দাঁড়িয়েই হতবাক হয়ে যায় রবি। সামনের উঠোনটা যেন শ্মশানপুরী। তার এতকালের যত্নের সব গাছগুলোর মৃতদেহ তার চোখে জল এনে দেয়।  অনেক অভাব অনটনের মধ্যেও এই গাছপালা ঘেরা পৈতৃক বাড়িটাই ছিল রবির অলংকারের অহংকার। প্রোমোটারের রক্তচক্ষুও তাকে দমাতে পারেনি। শূন্যবুকে উঠোন পেরিয়ে এগোতে থাকে সে রাস্তায়। চারিদিকেই সেই হিংস্র দানবের তাণ্ডবের প্রতিচ্ছবি

    শুকনো মুখে বাড়ি ফিরতেই দেখে, সুধা লাউ-কুমড়ো-পুঁইশাখের কচি ডগাগুলো কোলে নিয়ে বসে আছে

    একি!  এভাবে বসে আছো কেন তুমি?

    এবার কী হবে গো! এরাও তো আর আমাদের সংগে রইল না!

    সব আবার ঠিক হবে। ধৈর্য্য ধর। কোনমতে কথাগুলো বলে পালিয়ে যায় রবি

    বাইরের চিৎকার শুনে রবি জামাটা কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে আসে। সামনের জটলায় পাড়ার অনেককেই চোখে পড়ে তার। হারুকে টেনে এনে বলে, কী হয়েছে রে হারু? 

    তিনদিন ধরে এলাকার অনেক বাড়িতে কারেন্ট নেই জল নেই। তাই সকলে মিলে ঠিক করেছে এবার রাস্তা অবরোধ করবে

    মনে মনে প্রমাদ গোনে রবি। একটানা লকডাউনের পর এইতো সবে আস্তে আস্তে খুলছিল সব। আবার সব...

     তুমি জানো না?  ওই যে কনক পিসি গো, সুগারের ইঞ্জেকশন না দিতে পেরে প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়েছে আর মিত্তির বাড়ির দাদুরও তো অবস্থা ভালো নয়। তার আবার বাড়িতেই সব হসপিটালের ব্যবস্থা

    এসব কথা শুনতে শুনতেই  রবির মাথায় এক আইডিয়া চলে আসে

    এই হারু  তোর দাদার দোকান থেকে কিছু ইলেক্ট্রিক তার আমায় ধার দিবি?

    কী করবে সেটা দিয়ে?

    তুই নিয়েই আয় না! সংগে তোর দাদাকেও আনবি

    বলে ছুট লাগায় রবি

    বাড়িতে গিয়ে সুধাকে নিজের আইডিয়া বলতেই সে তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে

    বলি কারেন এর বিলটা কে দেবে? দু-বেলা খাবার জোগাড় করতেই হিমসিম হচ্ছ!

    সুধার কথায় কান না দিয়েই  রবি ঘর থেকে বেরিয়ে যায়, কিসের একটা জেদ চেপে গেছে তার মাথায়

    সারাদিন নিরলসভাবে পরিশ্রমের পর সন্ধ্যাবেলা যখন বাড়ি ফেরে রবি, তখন সুধা মোমবাতির আলোয় বসে

    কি হল অন্ধকার করে রেখেছ কেন বাড়ি?

    তুমি যে আজ পাশের বাড়িগুলোতে কারেন দিয়ে তাদের ট্যাঙ্কিতে জল তুলে দিলে, সবাই তোমার কত্ত পেশংসা করল! কারেনের বিলটা না হয় আমরাই দেব গো! তার জন্য আমাদের তো এটুকু অন্ধকারে থাকতেই হবে। কি বল?

    মোমের আলোয় সুধাকে কেমন অন্য মানুষ লাগে রবির। কাছে এসে সুধাকে নিজের বুকে টেনে নেয় সে। বাইরের স্যাঁতসেঁতে উঠোন জুড়ে তখন চাঁদের মায়া খেলা করে চলেছে


 

No comments:

Post a Comment