Tuesday, September 22, 2020

আলো - সুজিত বসাক

 আলো

সুজিত বসাক

 

বাপরে, বাপের জন্মে এমন ভয়ঙ্কর ঝড় দেখিনি! মনে হচ্ছে যেন সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবে। আমার একতলা বাড়ির  সুরক্ষিত ঘরে বসেও আমার বুক বারবার কেঁপে উঠছিল। জানালার ছোট্ট ফাঁক দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখে মনে হল, অনেক অনর্থ ঘটবে আজ। গাছগুলোকে মনে হল যেন সৈনিক, যারা প্রাণপণে লড়াই করে চলেছে এক ভয়ঙ্কর দানবের সাথে।

    ওই ওই রে উপরে গেল আমাদের কাঁচা মিঠে আম গাছটা।

    পিছন থেকে আর্তনাদ করে উঠল দেবী, আমার স্ত্রী। ওই গাছটাকে খুব ভালোবাসতো। সন্তানের মতো। এই বাড়িতে বউ হয়ে আসার বছরেই আব্দুল চাচাকে ম্যানেজ করে জোগাড় করেছিল ওই শিশু চারাটি। ওর আদরে তর তর করে বেড়েও উঠেছিল ধিঙ্গি মেয়ের মতো। কেমন করে জানি আমিও একদিন ভালোবাসতে শুরু করেছিলাম দেবীর ধিঙ্গি মেয়েকে।

    আমি নলিনীকান্ত বিদ্যাপীঠের হেডমাষ্টার। প্রত্যন্ত গ্রামের স্কুল। বেশির ভাগ ছাত্র ছাত্রী হতদরিদ্র পরিবারের। পাকা বাড়ি তো দুরস্থান, টিনের চাল অব্দি নেই অনেকের। এই ঝড়ে একটাও কি আস্ত থাকবে? সে কথা ভাবতেই মন আরও খারাপ হয়ে গেল। জানালা বন্ধ করে ভেতরে এসে চুপচাপ বসে রইলাম। বিশেষ করে মনে পড়তে লাগল কাইফের কথা। ছেলেটা যাকে বলে গোবরে ফোটা পদ্মফুল। আমার স্কুলে দশম শ্রেণিতে পড়ে। দুর্দান্ত মেধা। ঈশ্বর মাঝে মাঝে ভুল জায়গায় মেধা দিয়ে বসেন। আমি ও আমার সহকর্মীদের অনেকেই এই আশ্বর্য প্রদীপটি যাতে অকালে নিভে না যায় তার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছি। কিন্তু এবার?

    দেড় দু-ঘন্টা তান্ডব চালিয়ে দস্যু বিদেয় হল। কিন্তু রেখে গেল অজস্র ক্ষতচিহ্ন। বীর যোদ্ধার মতো শহীদ হওয়া গাছেদের জন্য মন ভারাক্রান্ত হল, আর যারা এখনো দাঁড়িয়ে আছে তাদের জন্য শ্রদ্ধায় মাথা নত হল। একটু আগে কি লড়াইটাই না লড়ল ওরা! ভাঙা ডালপালা, জঞ্জাল সরিয়ে উঠোনটা চলাফেরার যোগ্য করে তুলতেই লেগে গেল বহু সময়।

    পরের দিন সকালে ছুটলাম ওদের খবর নিতে। পথে পেয়ে গেলাম মনোজকে। মনোজ আমার স্কুলের প্যারাটিচার।

    ওখানে গিয়ে দেখলাম যা ভেবেছিলাম তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি হয়েছে। লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছে ঘরবাড়ি। দুজন গাছ চাপা পড়ে মারা গিয়েছে শুনে বুক কেঁপে উঠল। নদীর দুই পাড়ের বিস্তীর্ণ এলাকায় জল ঢুকে পড়েছে। অসহায় মানুষ জন প্রাণ বাঁচাতে বড় বাঁধের উপর আশ্রয় নিয়েছে।

    একটু সন্ধান করতেই কাইফের বাবার দেখা পেয়ে গেলাম। আমাকে দেখেই ওর ঝর করে কেঁদে ফেললেন, সব শেষ হয়ে গেল মাষ্টারমশাই। এখন আমরা কি করবো, কোথায় যাব?”

    আমি সান্তনা দিয়ে বললাম, ভয় পাবেন না। ঘরবাড়ি ভেঙেছে, আবার হবে। ভাগ্য ভালো সবাই ঠিক মতো আছেন। সরকারি সাহায্য নিয়ে কটা দিন চালান, ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে।

    একটু বাদে কাইফ সামনে এসে দাঁড়ালো। শুকনো মুখ, বিষন্ন চাহনি। আমি কিছু শুকনো খাবার সাথে করে এনেছিলাম ঘর থেকে। ওর হাতে দিয়ে বললাম, তুই আর তোর বোন খাস।

    প্যাকটটা হাতে নিয়ে কাইফ বলল, একটা উপকার করবেন স্যার? একটা বড় ডাল পড়েছিল মায়ের পায়ে, ব্যথায় খুব কষ্ট পাচ্ছেএকটু ওষুধের ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন?”

 

    একে করোনা নামক অতিমারি, দোসর এই ঝড়। নাভিশ্বাস ওঠা হতদরিদ্র পরিবারগুলির ছেলেমেয়েরা ধীরে ধীরে পড়াশুনা বিমুখ হচ্ছে বেশ বুঝতে পারছি। অথচ করারও কিছু নেই। অনেক স্কুলে অনলাইন ক্লাস হচ্ছে। কিন্তু আমার স্কুলে সে চেষ্টা করতে গিয়ে শুধুই ব্যর্থতা পেলাম। বেশির ভাগেরই অ্যানড্রয়েড ফোন নেই। থাকলেও নেট খরচা চালানোর সামর্থ্য নেই। লকডাউনের জেরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে যে খোঁজখবর নেব তারও উপায় নেই। পরিবার, বন্ধু বান্ধব সবাই বাঁধা দিয়ে বলল, তুমি যেসব জায়গায় যেতে চাইছ সেখানে মিনিমাম সামাজিক দূরত্ব বিধি মানা হচ্ছে না, নিজেও মরবে সাথে আর পাঁচজনকে মারবে। সুতরাং ঘরবন্দি হয়ে সবকিছু ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়ে চুপচাপ বসে থাকতে বাধ্য হলাম।

    কয়েক দিন পর মিড ডে মিলের সামগ্রী ডিসট্রিবিউশনের সময় স্কুলে কাইফের বাবার সাথে দেখা। জিজ্ঞেস করলাম, বাড়ি ঘরের কী খবর?”

    পানি তো নামছে মাস্টারমশাই। কিন্তু ঘরদোর না সারালেই নয়। ধারদেনা করেছি কিছুএবার বাপ ব্যাটায় মিলে একটা দাঁড় করাবো। আপাতত ত্রিপলের ছাউনি দিয়ে আছি। ঝড়ে ফসল সব নষ্ট হয়ে গেলনইলে এই দুর্দশা হতো না।

    এই চিত্র প্রায় সকলেরই। ভীষণ হতাশ লাগল। আমার স্কুলের ছাত্র ছাত্রীদের একটা বড় অংশ প্রথম জেনারেশনের পড়ুয়া। এরা কি এই সব ধাক্কা সামলে আবার স্কুলমুখী হতে পারবে? অভিভাবকদেরও কি সেই উৎসাহ থাকবে? অথচ কাইফ, সনাতন, মিনতি, সুলতানাএরকম বেশ কিছু ছেলেমেয়ে দারুন সম্ভবনা নিয়ে ধীরে ধীরে উঠে আসছিল। এই অন্ধকার সময়ের ঘূর্ণি হয়তো ওদের আরও বড় ঘূর্ণির মধ্যে ফেলে দেবে যেখান থেকে ওরা কোনদিনই বেরিয়ে আসতে পারবে না।

    আমার ছেলে গুবলু বাড়ির কাছের একটা বড় স্কুলে পড়ছে। ওদের স্কুলও বন্ধ। তবে নিয়মিত অনলাইন ক্লাস করছে বাড়িতে বসেই। আমার স্মার্টফোন এখন ওর কাজেই লাগছে বেশি। ফাঁকে ফাঁকে আমিও পড়াচ্ছি ওকে। কারণ হাতে অফুরন্ত সময়। টিভি দেখে আর মোবাইল ঘেঁটে কত আর সময় কাটানো যায় !

    এভাবেই চলছিল।

    দিন পনেরো পরে হঠাৎ এক দুপুরে মনোরঞ্জনের ফোন, খবরটা শুনেছেন দাদা?”

    কোন খবর?” আমি জিজ্ঞেস করি।

    কাইফের মাকে সাপ কামড়েছিল। কী বিপদ দেখুন।

    তুমি কোথায় শুনলে? এখন ঠিক আছে তো? ”

    আমাকে সনাতন বলল। ওর বাড়ি ওদিকেই। বাজারে দেখা হয়েছিল। সনাতন বাজারে বাবার সাথে মাছ বিক্রি করে এখন। এটা পরশুর ঘটনা। সাথে সাথে হসপিটাল নিয়ে যাওয়ায় এযাত্রায় বেঁচে গিয়েছে।

    আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। তবে কাইফের মায়ের খবর যতটা না বিচলিত করল তার চেয়ে অনেক বেশি বিচলিত হলাম সনাতনের খবর শুনে। সনাতন মাছ বিক্রি করছে! কী সুন্দর আঁকার হাত ছেলেটার! মনে হল, কোনো এক অশুভ শক্তি যেন গ্যালন গ্যালন অন্ধকার ঢেলে দিচ্ছে পৃথিবীর উপর। মাছের আঁশটে গন্ধ লাগা ওই হাত দিয়ে ছেলেটা কী আর পেন্সিল তুলি ধরতে পারবে? কোন কাজই ছোট নয়। কিন্তু একটা সম্ভবনা চোখের সামনে বিনষ্ট হতে দেখলে খারাপ লাগে বইকী।

    কাউকে না জানিয়ে সেদিন সন্ধ্যাবেলায় বেরিয়ে পড়লাম বাইক নিয়ে। কাইফদের বাড়ি আমি চিনি। ঝুপ করে অন্ধকার নেমে পড়লেও পথ খুঁজে নিতে কোন অসুবিধা হল না। সামনের উঠোনে বসে ঝিমোচ্ছিলেন কাইফের বাবা। বাঁশ আর ত্রিপল দিয়ে পুরানো ঘরগুলিকে জোরাতাপ্পি দিয়ে কোনোরকমে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমাকে দেখে কাইফের বাবা শশব্যস্তে  এগিয়ে এলেন, আসেনআসেনমাস্টারমশাই….

    দাওয়ায় একটা লম্ফ জ্বলছে। তার অনুজ্জ্বল আলো দেখে মনে হল, সভ্যতা যেন থমকে আছে এখানে। দূরত্ব বজায় রেখে আমি বললাম, আপনাদের বিপদের কথা শুনলাম। ভাবলাম একটু দেখা করে যাই। কাইফ, সুলতানা ওরা সব কোথায়?”

    ওর কথা আর বলেন না মাস্টারমশাই। এক্কেবারে কথা শোনে না। সারাটা দিন আমার সাথে গাধার খাটুনি খাটেসন্ধ্যা হলেই আবার চলে যায় মসজিদে। ওখানে বিজলি বাতি আছেতার আলোতে পড়বে বলে। কিন্তু এরকম করলে শরীরডা শেষ হয়ে যাবে সেডা বোঝে না। আমার কথা শুনে না। বলি কোন বিদ্যাসাগর হবি তুই? খাওয়া তো লাগবে সেই গতর খাটিয়েইআপনি একটু বুঝাবেন তো মাস্টারমশাইআপনার কথা খুব মানে।

    কাইফকে খবর দিয়ে ডেকে আনল ওর বোন সুলতানা।  কাইফ খুব খুশি হয়েছে ওর মুখ দেখেই বোঝা গেল। আমাকে সামনে পেয়ে ওর বাবা ওকে অনেক বকাঝকা করল। আমিও শরীরের দিকে খেয়াল রাখার কথা বললাম।  ফেরার পথে আমাকে এগিয়ে দিতে এসে কাইফ বলল, বাবার কথায় কিছু মনে করবেন না স্যার।

    আমি বললাম, সে ঠিক আছে। কিন্তু উনি তো ঠিকই বলেছেন। আগে শরীর তারপরে অন্যকিছু। এভাবে চললে তোর শরীর খারাপ হয়ে যাবে।

    হবে না স্যার। আমি ঠিক পারব। আমাকে পারতেই হবে। ঝড় তো আসবেই স্যারকিন্তু সময় তো আর সুযোগ দেবে না।

    ওর শেষের কথাগুলো তিরের মতো এসে বিঁধল আমার বুকে। কিন্তু কোন মত যন্ত্রনা হল না। বরং এক অনাস্বাদিত স্বর্গীয় আনন্দে ভরে গেল মন। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, যে মেঘের দল ঢেকে রেখেছিল চাঁদটাকে, তারা আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে। এখন সামনের রাস্তাটা পরিস্কার দেখা যাচ্ছে।


 

No comments:

Post a Comment