Tuesday, September 22, 2020

জীবনের জন্য জীবন - শিশিরবিন্দু দত্ত

 পরিবার কি মোহ, প্রেম, ভালোবাসার ভৈরব-সেতু?

জীবনের জন্য জীবন 

শিশিরবিন্দু দত্ত 

 

১০ সেপ্টেম্বর। ক্যালেন্ডার অনুযায়ী -দিনটিকে পালন করা হয় বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস হিসেবে। কিন্তু একদিন ঘটা করে কোনো দিবস পালন করলেই চিরকালীন সমস্যা মিটে যায় কি? আসুন, একটু আলোচনা করি।

     পরিসংখ্যান বলছে,  বছরে প্রায়  ১০ লক্ষ মানুষ আত্মহত্যা করেন আর আত্মহত্যার চেষ্টা করেন প্রায়  দেড় কোটি মানুষ আত্মহত্যার ক্ষেত্রে চীন ভারত  সবথেকে বেশি এগিয়ে আছে বিশ্বে যতজন আত্মঘাতী হয় তাদের অর্ধেকই এই দুই দেশের অধিবাসী। 

   সমীক্ষায় দেখা গেছে, আত্মঘাতীদের  প্রায় ১.৪ শতাংশ এই বহুল ব্যবহৃত ইন্টারনেটের কারণে মারা যাচ্ছেন। আবার দেখা যাচ্ছে,  মহিলাদের তুলনায় পুরুষ আত্মঘাতী সংখ্যা তিন থেকে চার গুণ বেশি। তাহলে তো বলাই যায়, মহিলাদের থেকে পুরুষরাই বেশি আত্মহত্যাপ্রবণ। তারাই তীব্র মানসিক অশান্তিতে ভোগেন অপ্রত্যাশিত মনোমালিন্য, মতবিরোধ, সম্পত্তির অধিকার, সম্পর্কের টানাপোড়েন  ইত্যাদি হল এই আত্মহত্যার সারফেস কজ। এগুলো পুরুষ-সমাজকে  আত্মহত্যার দিকে ধাবিত করছে  ভীষণভাবে।  While one in 7 men suffers from depression, the concurrent figure for women is one in 5. Mental health experts said that in addition to depression, 10% of the people battling with schizophrenia have the tendency to commit suicide.

According to 2018 National Crime Record Bureau data, West Bengal is among the five states with high number of suicides, the figure crossing 10,000 in West Bengal where 13,255 cases of suicide were recorded in 2018.(TIMES OF INDIA reports) 

    একটা মানুষ একটাই জীবন পায়। তবুও সেই প্রিয় জীবনকে মানুষ নির্মমভাবে নিজের হাতে বলি দেয়। মৃত্যুটাকে জীবনের থেকে মহার্ঘ বলে মনে হয়! কিন্তু জীবনের থেকে মৃত্যু কখনোই মহার্ঘ হতে পারে না। জীবন মানেই কাটাছেঁড়া যোগ বিয়োগ গুন ভাগ। এখানে নেগেটিভ ঘটনা ঘটবে, এ-আর এমন কি। মানসিক হতাশা, চূড়ান্ত পরাজয়, না পাওয়া বা হারিয়ে ফেলা সব মিলিয়ে বেঁচে থাকার নাম জীবন; টিকে থাকার টিকিয়ে রাখার নামই তো জীবন। সেই জীবনকে লড়াইয়ের ময়দানে থেকে সরিয়ে ফেলা কি আরেকটা দুর্বলতা নয়? আরেকটা পরাজয় নয়? এটা কি আর একটা হতাশা সৃষ্টি করা নয়? 

   প্রতিটি সমস্যার সমাধান আছে। প্রত্যেক রোগের ঔষধ আছে। তেমনি এই আত্মহত্যাপ্রবণতা নামক অদৃশ্য ব্যাধির অবশ্যই চিকিৎসা আছে কিন্তু এমনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে থাকে যে, সময় বা সুযোগ কোনোটাই থাকেনা চিকিৎসার এটা অবশ্যই সত্য যে, কখন কাকে মানসিক হতাশা বা  চূড়ান্ত অবসাদ ঘিরে ফেলবে তা বোঝাই যায় না। আত্মহত্যার সাথে আকস্মিকতার সম্পর্ক কাছাকাছি। আবার কারো কারো ক্ষেত্রে দেখা যায়, স্বভাবতই আত্মহত্যাপ্রবণ। আত্মহত্যাপ্রবণতাও স্বভাব  বা অভ্যাস হয়ে থাকে। রাস্তায় যেমন দুর্ঘটনা প্রবণ এলাকা থাকে, ঠিক তেমন কিছু কিছু মানুষের জীবন  আত্মহননপ্রবণ। যেমন আমরা কবি সিলভিয়া প্লাথ তার ছেলের ক্ষেত্রে এই ধরনের ঘটনা দেখেছি 

   দার্শনিক মনঃস্তত্ববিদ থমাস জাস্জ  বলেছেন যে, আত্মহত্যার অধিকার মানুষের মৌলিক অধিকারগুলোর একটি। যদি স্বাধীনতার মানে হয় নিজস্বতার মালিকানা, নিজের জীবন শরীরের উপর মালিকানা, তবে একজন মানুষের নিজের জীবন ত্যাগ করার অধিকার তার সবচেয়ে বড় মৌলিক অধিকারগুলোর একটি। যদি অন্য কেউ একজন মানুষকে বেঁচে থাকার জন্য বাধ্য করে, তবে মানুষটি তার নিজের জীবনের মালিক নয়, তার জীবন অন্যের কাছে বন্দী। একথা, আমার মনে হয়, অনেক ফিল্যানথ্রপিস্টরা মানবেন না। 

   জীবনের জন্য জীবনের যত লড়াই। জীবনের জন্য জীবন সৃষ্টি। জীবনের সঙ্গে জীবনকে যোগ করাই তো আমাদের কাজ কিন্তু কোনও কোনও সময় এই জীবন বড় দুর্বহ আর দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। জীবন যুদ্ধে হেরে যাওয়ার গ্লানি, সাফল্য না পাওয়ার অবসাদ, চূড়ান্ত হতাশা মানসিক অস্থিরতা সব মিলিয়ে জীবনকে ভুলে জীবনকে দাঁড় করায় মৃত্যুর বেদি তলে। আত্মহত্যাই হয়ে ওঠে মোক্ষম মোক্ষলাভ। 

   এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে, কারা আত্মহত্যা করে? কেউ কেউ মনে করেন যে এটা জিনগত প্রভাব। এটি একটি বংশগত রোগ। আবার কেউ বলেন যে, অত্যধিক সংবেদনশীল মানুষই আত্মহত্যা করেন। আবার কেউ বলেন, অনেক আমুদে মানুষও অকস্মাৎ আত্মহননের পথ বেছে নেয়। আর আত্মহত্যার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে ভাবাবেগ। আত্মহত্যার সময়ে মানুষ তার সমস্ত বিবেচনা শক্তি বুদ্ধি মেধা হারিয়ে ফেলে। হারিয়ে ফেলে মানসিক ভারসাম্য। তবে এটা অবাক হওয়ার বিষয় যে, খুব উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তি যখন আত্মহত্যা করেন, তার কাছ থেকে কি শিখবে সমাজ? 

   এখন বর্ধিষ্ণু পরিবার ভেঙ্গে অণু হয়ে গেছে।  ফলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অণুপরিবারগুলি নিঃসঙ্গ বিচ্ছিন্ন। তার ফলে আত্মহত্যাকারী বা আত্মহত্যাকারিণীর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই সিদ্ধান্তটা সাফল্যমন্ডিত হয় ঘরে বেশি লোক না থাকায়। তেমনই এই তুরন্ত সিদ্ধান্তটা কার্যকরী করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে যদি বেশি লোকজন সংসারে থাকে। আবার কেউ কেউ বলেন যে, ছোট পরিবারে  দু-তিনজন থাকার ফলে  বাইরে অন্যের সঙ্গে মানিয়ে চলার অভ্যাস টা প্রায় গড়ে ওঠে না। নিজেদের চেনা পারিবারিক জীবনের গণ্ডিতে বাইরের কোনো মানুষ এসে গেলেই  তখনো এক ধরনের  অস্বাভাবিকতা এসে যায় যে অনেকে কাটিয়ে উঠতে পারে না। বাড়ির ব্যক্তিদের বাদ দিয়ে বাকিদের মনে হয় তৃতীয় ব্যক্তি। আরেকটা ব্যাপার, আমরা সবাই একটা অধরা মাধুরী দিকে হাত প্রসারিত করছি। ধূমকেতু বা উল্কার মতো আকস্মিক স্বপ্ন আমাদেরকে তাড়িয়ে বেড়ায় এবং যদি আমরা সেই দৌড়ে কোনও ভাবে বাধাপ্রাপ্ত হই, তাহলে আমরা আত্মবিশ্বাস, আস্থা বা আত্মশক্তি হারিয়ে ফেলি এবং চটজলদি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি জীবন শেষ করার। জীবনটাই তো একটি প্রতিযোগিতা। খেলতে হয়। খেলার মাঠে নামতে হয়। অন্যদের সাথে মিশতে হয়। খোলাখুলিভাবে কথা বলতে হয়। নিজের দুঃখ কষ্ট অভাব-অভিযোগ আলো আঁধার হারানো প্রেম বিচ্ছেদ এগুলো সর্বসাকুল্যে পুরো জীবনের সংজ্ঞা। কোনটা বেশি, কোনটা কম, হাসি-কান্নার ভেতরেই নিজেকে একটা ভারসাম্য রচনা করতে হয়। আরাম প্রাচুর্য সুখের মধ্যেও দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণাকে উপভোগ করতে শিখতে হবে। অনুভব করতে হবে জীবনের অপরিহার্য অংশ হিসেবে। 

   একটা জিনিস লক্ষণীয়, আত্মহত্যার আগে অনেকের মধ্যে কিছু ব্যবহারিক পরিবর্তন দেখা যায়। যদি আগে থেকে লক্ষ্ করা যায় এবং তা সহানুভূতির সঙ্গে সমাধানের চেষ্টা করা হয় বা কাউন্সেলিং করা হয় তাহলে কিছুটা হয়তো সমাধান হতে পারে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, মানুষের মন বড় জটিল। কখন কে উপস্থিত, কখন কে অনুপস্থিত থাকে সেই মনের ক্যানভাসে তা অত্যন্ত ভালো মানসিক খেলোয়াড়ও  বুঝিয়ে বলতে পারে না। এ-যেন জটিল গুহার থেকেও দুর্গম! উঁচু পাহাড়ের থেকেও উঁচু! বেশ কিছু আধুনিক কবিতার মত দুর্বোধ্য! এই মনকে যতই সবুজ তরুণ চটপটে ছটফটে বলি না কেন এর কোথাও একটা অবুঝ বিষয়টা থেকে যায়। যে জীবন আমরা সৃষ্টি করিনি কোথা থেকে পাই তাকে নষ্ট করার অধিকার? 

   একটা জীবন একটি লড়াই। একটা জীবন একটা খেলা। তার সাফল্য আছে ব্যর্থতা আছে। কিন্তু হেরে যাওয়া মানে কি জীবনকে শেষ করে দেওয়া? একটু অপেক্ষা কি প্রয়োজন নেই? সহনশীলতার কি দরকার নেই একটুও? ভেবে দেখার কি অবকাশ নেই একদম? আসুন আমরা নতুন সূর্যের প্রতীক্ষা করি নতুন আলোর পথ তৈরি করি নতুন সমাজের পরিকাঠামো ভাবি। আরো একটু সহানুভূতির বৃষ্টি ঝরাই। আরো একটু মানুষকে মানবিক হয়ে ভালোবাসি। তার মানুষের পাশে দাঁড়াই  যে কয়েক দিন ধরেই বড়ো একা একা। তাকে বোঝার চেষ্টা করি। তাকে জানার চেষ্টা করি। তাকে আত্মীয়ের মতো আত্মহত্যার বদলে আত্মবোধ জাগাই তাদের আত্মস্থ করি যে জীবনের প্রতি টান থাকে বলেই জীবনকে ঘিরেই গড়ে ওঠে টানাপোড়েন এবং এটাকে কাটিয়ে ওঠার নামই প্রকৃত জীবন। 


 

No comments:

Post a Comment