আয়না
ইমন চৌধুরী
বাড়িটা ভাঙ্গা হবে। এই বাড়ির জায়গায় ফ্ল্যাট উঠবে। অবনী এবং অনিন্দ দুই ভাই, এই বাড়ির পরিবর্তে ওরা দুটো থ্রি-বিএইচকে ফ্ল্যাট পাবে, একটা সংসার ভেঙ্গে দুটো হবে। ওদের লাভই হবে ক্ষতি হবে শুধু অপর্ণার। অপর্ণার আর নিজের বলতে কোন বাড়ি থাকবে না।
আগামী দুই বছর ওদের সবাইকে ভাড়া বাড়িতে থাকতে হবে, ভাড়া অবশ্য লাগবে না, সে খরচ প্রমোটারই জোগাবে। দুই বছর পরে ফ্ল্যাট হয়ে গেলে ওরা আবার ফিরে আসবে। অবনী এবং অনিন্দ দুই ভাই-ই মাকে আশ্বাস দিয়েছে মা যখন যার কাছে ইচ্ছে থাকতে পারবেন। অপর্ণা ওদের কথার উত্তর দেননি, হেসেছেন শুধু। বিনয়বাবু মারা গেছেন এখনো এক বছর হয়নি।
হাতে আর দুইদিন মাত্র সময়, গাড়ি এসে এ-বাড়ি থেকে জিনিসপত্র নিয়ে যাচ্ছে ভাড়াবাড়িতে। কম জিনিস তো নেই! বাড়িটা তো আজকের নয়, বিনয়বাবুর বাবা গৌরিকিশোর ঘোষ এই বাড়ি নির্মাণ করেছিলেন।
যবে থেকে এ-বাড়ির নিয়তি নির্দিষ্ট হয়ে গেছে তবে থেকে অপর্ণা মাঝে মাঝে এ-বাড়ির জীর্ণ দেওয়ালগুলোতে হাত বোলান, কান পেতে শোনার চেষ্টা করেন কেউ কি কোন কথা বলছে? কেউ কি দীর্ঘশ্বাস ফেলছে?
চেয়ার টেবিল খাট আলমারি বেশিরভাগ ইতিমধ্যে ভাড়া বাড়িতে চলে গেছে। বইপত্র জামা কাপড় বাক্স বন্দি হয়ে পরে আছে, কিছু চলে গেছে কিছু প্রতীক্ষায় আছে।
অপর্ণার জিনিসপত্র উনি গুছিয়ে নিয়েছেন। গোছাতে গিয়েই লক্ষ করেছেন যে ওনার নিজের বলতে খুব বেশি কিছু নেই, একটা সুটকেসেই সবকিছু ধরে গেছে। এখন ওর ঘর প্রায় ফাঁকা, কালই অপর্ণা চলে যাবেন এই বাড়ি ছেড়ে। কবে প্রথম এসেছিলেন এ-বাড়িতে? মধ্যেরাতে ছাদে দাঁড়িয়ে সেই শুরুর দিনটা মনে করার চেষ্টা করতেই চোখ জলে ভরে ওঠে। বেশিদিন নেই আর ওর জীবনের, তবু এত মায়া রয়ে গেছে।
ঠাম্মি...
তিন্নির গলার স্বর। নাতী নাতনীদের মধ্যে তিন্নিই ওকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। আঁচলে চোখ মুছে ফিরে তাকান অপর্ণা।
কী রে এত রাতে যে, ঘুমাসনি এখনো?
তিন্নির চোখদুটো জ্বলজ্বল করে ওঠে। ‘একটা জিনিস দেখবে ঠাম্মি?’
কী?
তিন্নি হাতের আড়াল থেকে ম্যাজিকের মতো একটা আয়না বেড় করে আনে। চমকে ওঠেন অপর্ণা। প্রায় কেড়ে নেন উনি আয়নাটা তিন্নির হাত থেকে।
এটা কোথায় পেলি?
তিন্নির ঠোঁটে রহস্যময় হাসি ফুটে ওঠে। অপর্ণা তিন্নির উত্তরের জন্যে প্রতীক্ষা করেন না, উনি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আয়নাটা দেখতে থাকেন। রুপোর দিয়ে বাঁধানো একটা হাত আয়না। খুব ঝগড়া হয়েছিল নতুন বউয়ের সাথে, বিনয়বাবু মান ভাঙ্গানোর জন্যে রুপোর আয়না কিনে এনেছিলেন।
হারিয়ে গেছিল আয়নাটা, আজ নয় সে প্রায় তিরিশ বছর আগের কথা। কত খুঁজেছে অপর্ণা, পায়নি। তারপর জীবনের ঝড়ে জলে এক সময় মন থেকে মুছেই গেছিল এই রুপোর আয়না। আজ ঘর ভাঙ্গবে, তার আগে আবার সে আয়না গোপন ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। অপর্ণা নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। এই আয়না ওর এই কোঁচকানো চামড়ার সাথে পরিচিত নয়, হয়তো সে ওকে চিনতে পারছে না।
আমাকে দেবে ঠাম্মি আয়নাটা?
মুখ তুলে তাকায় অপর্ণা নাতনীর দিকে। নাতনীকে আজ অবধি কখনো সে না বলেনি। কিছুক্ষন চুপ করে থাকে সে। তারপর দুদিকে মাথা নাড়িয়ে বলে, ‘না দিদি ভাই, এটা তো দিতে পারবো না।’
তিন্নি কেমন চুপসে যায়। যেন ও ভাবতেই পারেনি ঠাম্মি ওকে না বলতে পারে। এখন ও যে ঘরে থাকে সেই ঘরে আগে দাদু ঠাকুমা থাকতো, পুরনো বই-এর তাকে হলুদ হয়ে যাওয়া কাগজের আড়ালে আয়নাটা দেখতে পেয়ে ওর প্রথমেই মনে হয়েছিল এ-জিনিস ঠাম্মির। কিন্তু ও ভেবেছিল আয়নাটা ঠাম্মি নিজে থেকেই ওকে দিয়ে দেবে। ঠাম্মির তো জিনিষপত্রে তেমন মোহ নেই।
দুজনেই কিছুক্ষন চুপ করে থাকে। হঠাৎ তিন্নি বলে ওঠে, ‘ঠাম্মি আয়নাটা কি তোমাকে দাদু দিয়েছিল?’
নাতনীর দিকে তাকিয়ে হঠাৎ কেমন যেন লজ্জা পেয়ে যায় অপর্ণা আর লজ্জা পেয়েছে এটা বুঝতে পেরে আরোই রাঙ্গা হয়ে ওঠে সে, খুব অস্পষ্ট স্বরে বলে সে, ‘হ্যাঁ...’
মুহূর্তে অপর্ণাকে জড়িয়ে ধরে তিন্নি, ‘তাই ভাবি আমার ঠাম্মিটা এত লজ্জা পাচ্ছে কেন... এই আয়না তোমারই থাকবে, শুধু আমি এসে মাঝে মাঝে মুখ দেখে যাবো।’
অপর্ণার চোখ আবার জলে ভরে উঠেছে। বাড়িটা ভেঙ্গে যাবে, কিন্তু স্মৃতিরা মরবে না মোটেই। লুকিয়ে থাকবে জীবনের আনাচে কানাচে। এমন হঠাৎ হঠাৎ বেড়িয়ে আসবে, চমকে দেবে। অপর্ণা আয়নার দিকে চেয়ে থাকবে, স্মৃতিরা আয়নায় ফুটে উঠবে।
কিছুই হারায় না জীবন থেকে, ফিরে আসে, ফিরে ফিরে আসে।
No comments:
Post a Comment