সুখপাখি
নন্দিতা মিশ্র চক্রবর্তী
বাস ছেড়েছে বেশ সকালে। স্থানীয় ট্যুর কোম্পানির ভাড়া করা বাস। বাসের দুলুনিতে বেশ একটা ঘুমের ভাব এসেছিল সুলতার। শীতের সকালের নরম রোদ তার মুখের উপর থেকে সরে সরে যাচ্ছে। অনেকদিন পরে রোজকার বিরাট কাজের বোঝা নামিয়ে রেখে বেড়াতে যাচ্ছে সে। একটা সুখের ওম মনের যাবতীয় মেঘকে সরিয়ে রেখেছে তার। এমন সময় ও-ও-ও একটানা একটা কান্নার শব্দে চমকে তাকাল সুলতা। একটা বাচ্চা কাঁদছে। আড়াই বছরের একটা ফুটফুটে ছেলে, চোখদুটো ভারী সুন্দর। বাচ্চার কান্না থামাতে পারছেন না, ওর পাশে বসা ভদ্রলোক। মনে হয় উনিই বাচ্চাটার বাবা। সুলতার দুটো সিট পেছনে বসেছে ওরা। সুলতার চোখ খুঁজতে থাকে, মা নেই বাচ্চাটার? তার হাতদুটো এগিয়ে যেতে চায়, মনে হয় সে ছুটে গিয়ে পিঠ চাপড়ে কান্না থামিয়ে দেয়, বাচ্চাটার মুখটা খুব চেনা চেনা মনে হয় সুলতার। একটা অদ্ভুত মায়া বোধ জাগে তার বুকের ভেতর
কিছুক্ষণ পরে সে বুঝতে পারে সত্যিই বাচ্চাটার মা নেই। সে বাবার সঙ্গে যাচ্ছে এবং ওর খুব খিদে পেয়েছে। ট্যুর ম্যানেজার সকালে বাসে ওঠার আগে সবাইকে চা বিস্কুট দিয়েছিলেন। জলখাবার কখন কোথায় করাবে কে জানে? সুলতা ব্যাগ থেকে তার তৈরি একটা মাফিন কেক বের করে বাচ্চাটাকে দিল। তার ব্যাগে এমন কয়েকটা বেরনোর আগে ভরে এনেছিল সে। দোকানের জন্য বাকিগুলো পাঠিয়ে নিজের খাবার জন্য দুটো চিকেন বান আর চারটে মাফিন ব্যাগে রেখেছিল, কখন দরকার হয়! এখন কাজে লাগল। বাচ্চাটা গোগ্রাসে খেয়ে নিল। এবার সুলতার নজর গেল লোকটার দিকে, লোকটা বেশ সুন্দর দেখতে। বাচ্চাটার সঙ্গে আলাপ করল সুলতা। ওর নাম চাঁদু।
লোকটা চাঁদুকে নিয়ে একটা সিট এগিয়ে এসে বসল। বাসে সব সিট ভর্তি হয়নি। সুলতার দিকে কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
'আমি অরুনাভ। একা ছেলেকে নিয়ে এসে সমস্যায় পড়েছি। আমার এখনও ঠিক অভ্যাস হয়নি।'
সুলতা অনেক প্রশ্ন অরুনাভকে করতে পারল না। তবে তার মনে এল প্রশ্নগুলো। ভদ্রলোকের স্ত্রী কোথায়? অভ্যাস হয়নি! তার মানে কি তাদের ডিভোর্স হয়েছে? নাকি ওনার স্ত্রী মারা গেছেন? সুলতা লোকটাকে দেখল। চমৎকার নীল রংয়ের একটা শার্ট আর অফ হোয়াইট প্যান্ট পরেছেন অরুনাভ। চোখে চশমা। তবু তার ভেতর থেকে আয়ত চোখদুটো দেখা যাচ্ছে। এমন সুন্দর বাবা বলেই ছেলেও বুঝি এত সুন্দর।
বাস থেমেছে। অরুনাভ সুলতার সঙ্গে একই টেবিলে জলখাবার খেতে বসল। সুলতা সরে যেতে চেয়েছিল। অরুনাভই তাকে ডেকে নিল। সুলতা হাত মুখ ধুতে বেসিনে এসে আয়নায় নিজেকে দেখে চমকে উঠল। নিজের এতখানি বয়সের কথা সে যেন ভুলেই গেছিল। মাথার চুলে রং করা নেই ভালো মত। সামনের দিকে স্পষ্ট পাকা চুলের ইঙ্গিত। চোখের নীচে গভীর কালি। কেক প্যটিসের দোকানটা দাঁড় করাতে দিবারাত্রি পরিশ্রমের ফসল ফলেছে শরীরে! বয়সের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে মেদ। মুখে গলায় সর্বত্র মেদ জমেছে। নিজের প্রতি কখনও নজরই দেয়নি সে। মনের গভীরে বিষণ্ণ হয়ে উঠল সুলতা। আবার বাসে ফিরে এল সবাই। বাস চলতে শুরু করল। বাস যাচ্ছে রাজগীর। গয়া, নালন্দা হয়ে ফিরবে পাঁচদিন পরে।
সিটে মাথা হেলিয়ে বসে বসে নিজের স্বামীর কথা মনে করতে লাগল সুলতা। তারা বছর খানেক থেকেছিল একসঙ্গে। মদ খেয়ে একদিন গায়ে হাত তোলায়, সুলতাও তাকে ফিরে মেরেছিল। সুলতার শরীর বরাবর শক্ত পোক্ত। লম্বায় সে ছিল তার বর দিলীপের সমান। মার খেয়ে দিলীপ উপুড় হয়ে পড়ে যায় আর বেকায়দায় একটা দাঁত ভেঙে যায় তার। সুলতা পরদিন তার মামা বাড়িতে ফিরে যাবার পর দিলীপের মা বলে পাঠিয়েছিলেন,
'অমন ডাকাতে মেয়েকে আর আমাদের দরকার নেই। আমরা ছেলের আবার বিয়ে দেব।'
সে কথা মেনে দিলীপ সত্যিই আবার বিয়ে করেছিল। সকাল বিকেল মামার চায়ের দোকানের বাসন মাজতে মাজতে সে তার বরের আবার বিয়ের খবরটা পেয়েছিল। তারপর নির্লিপ্ত মুখে আলুরদমের আলুসেদ্ধ করেছে সুলতা। তার চোখে জল আসেনি, মনে এতটুকু জ্বালাও ধরেনি। সে দিলীপকে কখনও ভালোবাসেনি। সুলতা একেবারে নিরক্ষর নয়। স্কুলে মাধ্যমিক পাশ করেছিল এক চান্সে।
তারপর বহু সংগ্রাম আর ধার দেনা করে সুলতা নিজের কেক আর বেকিং শেখার বিদ্যে দিয়ে একটা দোকান করেছে সখের বাজারে। বলতে নেই সেই দোকান এখন বেশ ভালোই চলছে। সেই টাকাতেই সে বেড়াতে বেরিয়েছে।
কেকের অর্ডার পৌঁছাতে কোন্নগরে শ্বশুরবাড়ির পাড়ায় এসে সে দিলীপের বউকে ওদের ছেলে সহ দেখতে পেয়েছিল। বউটা ফর্সা। চাঁদুর মত দেখতে একটা গোলগাল বাচ্চা ছিল বউটার কোলে। দিলীপের বউ বাচ্চা নিয়ে বারান্দায় বসেছিল। সেই বারান্দা! চলে আসলেও কেন যেন নিজের জায়গায় অন্য কাউকে ঠিক মেনে নিতে পারেনি সুলতা। সেদিন হঠাৎ তার বুকের ভেতর কেমন যেন কাঁটার খোঁচা লেগেছিল। সে এরপরে ওই পাড়ায় আর যায়নি, তবে বাচ্চাটার মুখটা সে ভুলতেও পারেনি।
সুলতা এখন একটা নিজস্ব ঘর করেছে মামাবাড়ির পাশে। সেখানে সে একা থাকে। মামার চায়ের দোকানটা এখন মামার দুই ছেলে পালা করে সামলায়। মামা মামি মারা গেছেন। সবকিছু বেশ বদলে গেছে। বদলেছে সুলতার ভাগ্যও। সে এখন আর পরমুখাপেক্ষী নয়, বরং উপার্জনশীল। তবে আগের মতই সুলতা এখনও একা। নিজের একাকীত্ব ভুলতে সে দিনরাত দৈত্যের মত পরিশ্রম করে। কেকে, প্যাটিস, পুরভরা চিকেন বান, পিজা সব সে তার বিরাট ওটিজিতে নিজেই বানায়। স্কুল কলেজের ছেলেপুলেরা বিকেল হতেই ভীড় জমায় দোকানে। ওদের কথাবার্তা শুনতে সুলতার ভালো লাগে, এভাবেই বেশ সময় কেটে যায় তার।
রাজগীরে অরুনাভ আগ্রহী হয়ে সুলতার পাশের ঘরটা নিয়েছে এবং সুলতাও তাতে আপত্তি করেনি। তার মনের ভেতর কেমন একটা মায়াবী আলোর হাতছানি। বিকেলে মায়াদেবী উদ্যানে বেড়াতে যাবার জন্য রেডি হয়ে আসতে সে সব থেকে দেরি করল। সে তিনবার চুল বেঁধেছে আর খুলেছে। পরার জন্য একটাও ভালো শাড়ি তার নেই! মায়াদেবী উদ্যান থেকে বেরিয়ে সে নিজের জন্য একটা ফর্সা হবার ক্রিম কিনল। এছাড়া কিনেছে এক জোড়া পাথর বসানো ঝোলা দুল, পারফিউম আর হেয়ার কালার। আজ সে একটা হলুদ রংয়ের সালোয়ার কামিজ পরেছে। অনেকদিন আগে বিয়ের পর বেড়াতে গিয়ে সে এটা পরেছিল। দিলীপ তখন তাকে খুব ভালো লাগছে বলেছিল। এতদিন পরে সেটা বেশ টাইট হয়েছে তার শরীরে। তবু শাড়ির চেয়ে এটাতেই তার নিজেকে বেশ মানানসই মনে হয়েছে, অন্তত বয়সটা একটু কম লাগছে এই পোশাকে।
বিশ্বশান্তি-স্তুপ, জীবকের আম্রকানন যাওয়ার কথা পরেরদিন সকালে। অরুনাভ আর সুলতা ঘোড়ার গাড়িতে পাশাপাশি বসেছে, চাঁদু সুলতার কোলে। যেন একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ সংসার। সুলতার মনে হয়, তাকে অরুনাভর দরকার। এত অল্পবয়সে বউ নেই বেচারার। সে নিজেও কম কষ্ট পায়নি সারাজীবন। এবার যদি তাদের দিন বদলায়, ক্ষতি কী!
বিশ্বশান্তি স্তুপে সুলতা বেখেয়ালে কখন অরুনাভর হাত চেপে ধরেছে, রোপওয়েগুলো দুরন্ত বেগে উপরে উঠছে আর নামছে এবং সেখানে সবাইকে একা বসতে হবে। সুলতা বলে সে রোপওয়েতে যাবে না। মৃদুভাষী অরুনাভ বলে ওঠে,
''আমি আগে এখানে এসেছি, ভয় পাবেন না। একদম সেফ।''
কথাটা সুলতার ভালো লাগে। কেউ তার সিদ্ধান্তকে বাধা দিচ্ছে, এই ঘটনা সচরাচর হয় না। তার জগতে সুলতা বড়ো একা। তার ঘরে খাবার জল দিতে আসে যে ছেলেটা, সে ছাড়া আর দোকানের খদ্দেররা ছাড়া তার সঙ্গে কথা বলার মানুষও কেউ নেই।
পরেরদিন সুলতা ট্যুর কোম্পানির লোকজনের মাধ্যমে জানতে পারে অরুনাভ কলকাতার কলেজে পড়ায়। সুলতা একটু শঙ্কিত হয়, সে বলতে গেলে একেবারে অশিক্ষিত! অরুনাভ আর চাঁদুর ব্যবহার মুহূর্তেই সেই ব্যবধান মিটিয়ে ফেলল। নালন্দায় রাশি রাশি পুরনো ইঁটের পাঁজা। কত কথা যেন জমে আছে সেইসব ইঁটের রাশিতে। সেখানে ভাণ্ডারঘরে বিরাট বড়ো মাটির চাল রাখার পাত্রে এখনও কিছুটা পোড়া চাল পড়ে আছে। এই এত বড়ো বিহার নাকি আগুন জ্বেলে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল! সেই অতীতের বীভৎসতা সে যেন উপলব্ধি করতে পারল। সুলতা বিভোর হয়ে প্রাচীন দালান আর মঞ্চগুলো চেয়ে দেখছিল। অরুনাভ মগ্ন সুলতাকে দেখতে দেখতে বলে উঠল,
'আপনার মধ্যে একধরণের প্রাচীন ভারতীয় ধ্রুপদী সৌন্দর্য আছে! এখানে আপনাকে চমৎকার মানিয়েছে।'
কথাটা সুলতার মনে কাঁপন ধরালো। সে শিউরে উঠল। পাঁচটা দিন যেন এক পলকে শেষ হয়ে গেল। ফেরার পথে অরুনাভ সুলতার দোকানের ঠিকানা নিয়েছে, বলেছে একদিন অবশ্যই সে আসবে।
ফিরে আসার পর থেকে অন্যমনস্ক সুলতা। দোকানে হিসেব করতে গিয়ে বারবার ভুল হয়ে যাচ্ছে তার। বাড়িতেও ভুল হচ্ছে। উপাদান এতটুকু কম বেশি হলে কেকের বারোটা বেজে যায়, তা মাঝে মাঝেই যাচ্ছে। দোকানের ছেলেটাও বলল,
'দিদি তোমার কি শরীর খারাপ নাকি গো?'
শরীর ছাড়াও তার যে আরও একটা বস্তু আছে, জীবনে তার খোঁজ পায়নি কখনও সুলতা। সে বলে, 'না রে সব ঠিক আছে।' সমস্তদিন ধরে সে যেন কীসের জন্য প্রতীক্ষা করে। কাকে দেখতে মন চাইছে তার? সুলতা তা জানে। ফেরার ঠিক চারদিন পর তার ফোনে টু টাং করে অনেকগুলো মেসেজ এল। হোয়াটস অ্যাপে অরুনাভ কয়েকটা ছবি পাঠিয়েছে।
সুলতা ছবিগুলো নিয়ে মেতে উঠল। নিজের ছবিগুলো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল অনেকবার। হোয়াটস্ অ্যাপে উত্তরে কী লিখবে ভেবে না পেয়ে অনেকগুলো চিয়ার্স ইমোজি পাঠিয়ে দিল সে। ছবিগুলো একদিন বাঁধিয়ে নিয়ে এল সে, তারপর দোকানের দেওয়ালে সেগুলো টানিয়ে দিল। খাবার কিনতে এসে অনেকেই জানতে চায় 'ছবিতে আপনার পাশে উনি কে?'
সুলতা গর্বের সঙ্গে অনেক কথা বলে। শুনে অনেকে ওর সামনে কিছু না বললেও, বাইরে বেরিয়ে মুখ বেঁকিয়ে বলে,
'আধবুড়ির রস কত!'
অনেকে আবার রসিকতা করতে ইচ্ছে করেই বলে,
'আচ্ছা দিদি লোকটার কি বউ নেই?'
উত্তরে সুলতা অনেক গল্প করে। 'বেচারার বউ মরে গেছে। ভদ্রলোকের ছোটো ছেলে নিয়ে একা অফিস সামলাতে হচ্ছে। রান্নাবান্না ঘর সংসার ব্যাটাছেলে অত পারে কখনও!'
বলার সময় সে টের পায়, এইসবই তার কল্পনা। অরুনাভর পরিবার সত্যিই কে কে থাকে? কিছুই সে জানে না। অরুনাভ কেন একা চাঁদুকে নিয়ে একা এসেছিল তা-ও সে জানে না। সে তখন মন থেকে সব সন্দেহ উড়িয়ে দিয়ে ভাবে, একবার যখন অরুনাভ তার দোকানে আসবে সে সব কথা জেনে নেবে। অরুনাভর ফোন নম্বরটাতে ফোন করার দুর্নিবার লোভ হয় তার। রোজই ভাবে একবার ফোন করে কথা বলবে। তারপর কেমন ভয় হয় সুলতার। সে লেখাপড়া তেমন জানে না। অরুনাভ শিক্ষিত মানুষ! সুলতা গুটিয়ে যায়।
দিন কাটতে থাকে। সুলতার দীর্ঘ প্রতীক্ষা দীর্ঘতর হতে থাকে। অরুনাভ তার দোকানে আসে না। সুলতা একটা নতুন ধরণের মাংসের প্যাটিস বানিয়ে খদ্দেরদের বহু প্রশংসা পেল। সে তীব্র ভাবে কামনা করতে থাকে অরুনাভকে এই প্যাটিস খাওয়াবে, কিন্তু অরুনাভ এল না। সুলতার মনে পড়ে তার সঙ্গে থাকা সাধারণ ভাবে তৈরি বান খেয়ে অরুনাভর সে কী মাতামাতি! সুলতা বাড়িতে একটা বড়ো কেক আর কয়েকটা সেই বিশেষ প্যাটিস বানালো, তারপর মন থেকে দ্বিধা দ্বন্দ ঝেড়ে ফেলে অরুনাভর নম্বরে ফোন করল।
অরুনাভ ফোন ধরে উচ্ছসিত গলায় বলল,
'আরে! আপনি! কতদিন পর! তারপর বলুন কেমন আছেন?' সুলতা হঠাৎ কিছু বলতে পারে না। তার গলা শুকিয়ে এসেছে। তবু সাহস সঞ্চয় করে বলে,
'চাঁদু আর আপনার জন্য কেক আর প্যাটিস বানিয়েছি। ভাবছিলাম ওগুলো দিতে যাব।'
'সো কাইন্ড অফ ইউ! আসুন তাহলে, প্লিজ! চাঁদুও আপনার কথা বলছিল। আর পারলে কালই আসুন! কাল একটা বিশেষ দিন!'
সুলতা ঠিকানা খুঁজে বের করে বিকেল পাঁচটা নাগাদ অরুনাভর বাড়িতে পৌঁছে গেল। দরজা খুলে অরুনাভ তাকে স্বাগত জানাল। আজ সুলতার মনে অনেক প্রশ্ন, সব উত্তর জেনে তবেই ফিরবে সে। অরুনাভ সুলতার দিকে চেয়ে লজ্জিত মুখে বলল,
'আমারই একবার যাওয়া উচিত ছিল, কিন্তু কী ভয়ানক ঝামেলায় যে জড়িয়ে পড়েছিলাম, অবশেষে আজ সবকিছু ঠিক হতে চলেছে। এবার একটা কথা বলি আপনাকে। জানেন,
'চাঁদু কিন্তু আমার ছেলে নয়!' সুলতা হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। অরুনাভ বলে চলে,
''চাঁদুর মা বিহারের লোক, বাবা বাঙালি। ওরা কোন্নগরে থাকে। চাঁদু মায়ের সঙ্গে ভাগলপুরে মামাবাড়ি গিয়ে ওখানকার মেলায় হারিয়ে গেছিল। ওকে আমি পেয়েছিলাম বিহারে একটা কাজে গিয়ে। ওখানে একটা মন্দিরের সামনে ওকে একা দেখতে পাই। তখন ওর সিকিউরিটির কথা ভেবে, ওকে নিয়ে চলে আসি। পুলিশে খবর দিতে ভরসা হয়নি। এত ছোটো ও! কোথায় কোন হোমে পাঠিয়ে দেবে! কলকাতায় ফিরে আসি। আমার ওর কথা শুনে মনে হয়েছিল, ও রাজগীরের মত একটা জায়গার কথা বলছে, অবশ্য নানা রকম পরস্পর বিরোধী কথা বলছিল ও। অতটুকু শিশুর পক্ষে এটাই স্বাভাবিক, তারপর ওখানকার থানা থেকে একটা ফোন পাই। তাই ওকে নিয়ে ওই ট্যুরে গেছিলাম। ভেবেছিলাম ওর মায়ের কাছে যদি কোনোভাবে ফিরিয়ে দেওয়া যায়! পরে ভেবে দেখলাম ও বাংলা জানে, বলতেও পারে। তখন এখানেও পুলিশে খবর দিয়ে একটা মিসিং ডায়েরি করি। তারপরই ওর বাবা মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ হয়ে গেল, ওরাও বিহারে আর এখানকার থানায় জানিয়েছিল।
আমি একা মানুষ। অবসর কাটে গানবাজনা করে। এই কয়েকদিন ওসব একদম মাথায় উঠেছিল! আজ কিন্তু চাঁদুকে নিতে ওর মা বাবা এখানে আসবেন! তবুও চাঁদুর জন্য মন খারাপ করছে খুব, মায়ায় বেঁধে ফেলেছে ও আমাকে।''
সুলতা চাঁদুকে কোলে নিল। চাঁদু সুলতাকে চিনেছে। একলাফে ওর কোলে উঠে বসেছে। সুলতা চাঁদুর মুখটা দেখতে থাকে। মুখটা ওর আবার চেনা চেনা মনে হয়। খানিকটা যেন দিলীপের মুখ! কোন্নগরে বাড়ি বলল তো! সুলতা বলে ওঠে,
'ওর বাবার নাম কি বলুন তো?' অরুনাভ বলে,
'দিলীপ পাল।'
শুনে সুলতা স্তব্ধ হয়ে যায়।
'চেনেন নাকি?'
'চিনি। বিলক্ষণ চিনি'
'তাহলে তো ভালো হল আরও!'
'জানেন এই লোকটা একসময় আমার স্বামী ছিল। এখন বউ বাচ্চা নিয়ে আমার সামনে থেকে দিব্যি সুখে গটগট করে বাড়ি ফিরে যাবে।'
'বুঝেছি। দাঁড়ান, লোকটাকে একটু শিক্ষা দেবেন নাকি?'
'কী করবেন?'
'আপনি টিপ পরেন? একটা টিপ পরুন। নিছক একটা মজা করব।'
'আমার কাছে তো টিপ নেই।'
'তাহলে লিপস্টিক? আছে?'
'আছে।'
'তাই দিয়ে কপালে একটা মস্ত বড়ো টিপ এঁকে নিন।'
সুলতা আয়নার সামনে এল। চাঁদু দৌড়ে এসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে রাখল ওকে। একহাত পিছনে দাঁড়ানো অরুনাভর মুখে দুষ্টুমির হাসি। সুলতা আয়না দেখে দেখে লিপস্টিক দিয়ে সত্যিকারের বউদের মত লাল টিপ আঁকতে লাগল। যদিও সে জানে, আয়নার ওই ফ্রেমে তার টিপ সমেত সবটাই নকল। আয়নায় চোখ রেখে সুলতা মুহূর্তের সেই সুখটুকুই গায়ে মেখে নিতে লাগল। হঠাৎ ওকে অবাক করে দিয়ে অরুনাভ বলে উঠল, আমার কাছে এই মজাটা সত্যি হলে মন্দ হয় না! কিন্তু তা কি সম্ভব?'
মুহূর্তে সুলতার দু গালে যেন দু মুঠো আবির ছড়িয়ে পড়ল আর তা দেখে অরুনাভও এবার তার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেল।
ভালো লাগল গল্পটা।
ReplyDelete