Tuesday, September 22, 2020

শেষ বিকেলের আলো - সঞ্জয় কর্মকার

শেষ বিকেলের আলো

সঞ্জয় কর্মকার   

                                         

মনটা একটুও ভাল নেই ঋতমের। আসলে, বাবা ওকে আজ স্পষ্ট করেই বলে দিয়েছে, 'তন্ময়কে তুমি আমাদের বাড়িতে আর এ্যালাও করবে না। ওদের স্মার্ট ফোন নেই বলে যখন তখন এখানে এসে উৎপাত করবে তা মেনে নেওয়া যাবে না। এখন যা পরিস্থিতি তাতে বাইরের মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করাটা যথেষ্ট রিস্কি। তাছাড়া, তন্ময়ের বাবা এই ক'দিন আগেই হায়দ্রাবাদ না কোথা থেকে যেন লেবারের কাজ করে ফিরল। তার থেকেও যদি কিছু একটা...।'

    বাবার কথার রেশ ধরেই মা রান্নাঘর থেকে গলার সুর চড়িয়ে বলছিল, ‘আমি রোজই সাবধান করি কিন্তু তোমার ছেলে সেকথা শুনলে তো! আর তন্ময়ের বাবা-মায়েরও সাহস আছে বটে! দখছে পৃথিবী জুড়ে এইরকম একটা ভয়ঙ্কর রোগ। হাজার হাজার মানুষের প্রাণ পর্যন্ত চলে যাচ্ছে। তারপরেও এইটুকু ছেলেকে দিব্যি বাড়ির বাইরে ছেড়ে দিচ্ছে!'

    মা-বাবার কথাগুলো শুনে তখন ভারি কষ্ট হচ্ছিল ওর। তন্ময়ের  মুখটা মনে পড়ছিল বারবার।

    কতদিন হয়ে গেল স্কুলটা বন্ধ রয়েছে। পিনাকী স্যারের টিউশন ব্যাচেও  কবে যে পড়াশোনা শুরু হবে তার কোন ঠিক নেই। অনলাইনে সব ক্লাস হচ্ছে বটে তবে এরকম পড়াশোনায় মন বসছে না একটুও। ঋতম ওর ঘরের পশ্চিমদিকের জানালার সামনে এসে দাঁড়ায়। বাইরের আকাশটায় সূর্যের শেষ আলোর রঙ লেগেছে এখন। সামনের ওই দেবদারু গাছের ফাঁক দিয়ে সেই আলোর ঝর্ণা নেমে আসছে ওদের বাড়ির একচিলতে বাগানে। কী করছে এখন তন্ময় কে জানে! পিনাকী স্যারের নোটস্ আর একটাও পাবে না ও। কেউ তন্ময়কে হেল্পও করবে না। সেই ছোটবেলা থেকেই তন্ময় ওর বেস্ট ফ্রেন্ড। আর সেই জন্যেই তো অনলাইন ক্লাসের নোটসগুলোর জন্য এখানে একটু আসত। অথচ মা- বাবা...

    আজ প্রায় পনের দিন হয়ে গেল তন্ময়ের সঙ্গে কোনরকম যোগাযোগ নেই ঋতমের। শেষবার যখন তন্ময় এসেছিল তখন বাবা-মায়ের কথা মতই ও তন্ময়কে বাড়ির  গেটে দাঁড় করিয়ে বলেছিল, 'ফোনের নেট ব্যালান্স শেষ হয়ে গ্যাছে রে। বাবা বলেছে আপাতত কিছুদিন রিচার্জ করবে না। যখন রিচার্জ করবে তখন না হয় তোকে আমি বাড়িতে গিয়ে জানিয়ে আসব।' কথাগুলো শুনে কেমন যেন একটা অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল তন্ময়। মুহূর্তেই চিকচিক করে উঠেছিল ওর চোখদুটোও। কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকার পর শেষে  দ্রুত পা চালিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেছিল রাস্তার বাঁকে। তন্ময় কি বুঝতে পেরেছিল সব কিছু! কথাটা ভাবলেই লজ্জায় কুঁকড়ে যায় ঋতম।

    'কোথায় গেলি বাবান? এদিকে একবার আয় তো।' বাবার কন্ঠস্বর শুনে ভাবনায় ছেদ পড়ে ঋতমের। এক দৌড়ে ও চলে যায় বাবার কছে। বাবা এখন ডায়নিংরুমে বসে ল্যাপটপ নিয়ে অফিসের কাজকর্ম করছে। ঋতমের পায়ের শব্দ শুনেই ওর বাবা বলে ওঠে, 'চল, একটু ঘুরে আসি।'

    'তুমি তো অফিসের কাজ করছ বাবা। আমরা তাহলে কোথায় যাব এখন?'

    ঋতমের প্রশ্ন শুনে ওর বাবা বলে, 'আসলে, আর একটা জরুরি কাজ পড়ে গ্যাছে। একজন কিছু টাকা পায় আমার কাছে। টাকাটা দিতে যাব। ভাবছি তোকেও সঙ্গে নিয়ে যাই। তোর একটু বাইরে বেরোনোও হবে।'

    'তুমি টাকা ধার করেছ বাবা! কিন্তু তুমি তো কখনও...।' ঋতম ওর বাবার দিকে বড়ো বড়ো চোখ করে তাকায়।

    ছেলের কথাটা শেষ হওয়ার আগেই এবার ঋতমের বাবা বলে ওঠে, 'টাকাটা তন্ময়ের থেকে ধার করেছি। তন্ময় এখন আনাজপাতি বিক্রি করছে। সকাল বেলা আমার কাছে খুচরো টাকা ছিল না। তাও ছেলেটা ব্যাগ ভরে শাক-সব্জি তুলে দিয়ে বলল, তুমি নিয়ে যাও কাকু। পরে দ্যাখা হলে টাকা দিও। আর আমি তো এখন পড়াশোনা করছি না। তাই ঋতমকে বোলো ও যেন আমার নোটস নিয়ে চিন্তা না করে।'

    'সেকি, তন্ময় পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে বাবা? কিন্তু তন্ময় তো আমাদের ক্লাসের সেকেন্ড বয়। এবার ফার্স্ট হওয়ার জন্য খুব খাটছিল ও।' চরম বিস্ময়ে বলে ওঠে ঋতম।

    'তন্ময় যাতে ফার্স্ট হতে পারে তাই তো এই টাকাটা এক্ষুনি দিতে যাচ্ছি। এখানে দশ হাজার টাকা আছে। অনলাইনে পড়াশোনার জন্য একটা স্মার্ট ফোন কিনেও কিছু টাকা থেকে যাবে ওর বাবার হাতে। শুনলাম তন্ময়ের বাবা কাজ হারিয়ে এখন ঘরে বসে আছে। তা তুই কী বলিস?'

    বাবার কথাগুলো শুনে চোখ-দুটো চকচক করে ওঠে ঋতমের। আকস্মিক বেজে উঠল শঙ্খ ধ্বনি। মা এখন সন্ধ্যা দিচ্ছে তাহলে।


      

1 comment:

  1. লেখাটি মন ছুঁয়ে গেল দাদা।চোখ ভিজে এলো।খুব ভাল লাগলো।অনেক শুভকামনা দাদা।

    ReplyDelete